কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। কথাটা পুরো সত্য বিপ্লবী চে গুয়েভারার ক্ষেত্রে। কারণ তিনি যে সত্যি কীর্তিমান। বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে যে কীর্তি তিনি রেখে গেছেন, তা বেঁচে থাকবে তত দিন, যত দিন বাঁচবে পৃথিবী।
আর বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতেন বলেই তার শত্রুরও অভাব ছিল না। সেই শত্রু কি আর ছোটখাটো শত্রু? তার শত্রু ছিল খোদ যুক্তরাষ্ট্র। অন্য সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদেরা তো ছিলই। মানুষের অপ্রাপ্তি আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন বলে শত্রুরা খুঁজে বেড়াত তাকে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য শত্রুরা সফলও হয়েছিল। বলিভিয়ার সেনাবাহিনীর এক মদ্যপ সৈনিক ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর পরপর নয়টি গুলি করে হত্যা করে 'সন্ত্রাসী' গুয়েভারাকে।
চে পৃথিবী ছেড়েছেন ঠিক, কিন্তু পৃথিবী কি তাকে ছেড়েছে? উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম, কোথায় নেই এই বিপ্লবী! লাতিন আমেরিকায় তো বটেই, আছেন এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকায়। যে বলিভিয়ার সৈনিকদের হাতে প্রাণ হারান চে, সেই বলিভিয়া থেকে শুরু করে কানাডা, ফিলিস্তিন, নেপাল হয়ে বাংলাদেশ, সব অঞ্চলের মানুষের মনেই জায়গা করে নিয়েছেন এই গেরিলা নেতা। কিউবা, ভেনেজুয়েলা, আর্জেন্টিনার কোটি কোটি মানুষের কথা আর না-ই বা বললাম। শুধু এটুকু বলি, তাদের হৃদয় থেকে নিয়ে ক্লাব, ক্যাফে, গাড়ি, টিশার্ট এমনকি ক্যাপেও শোভা পায় এই বিপ্লবীর ছবি। তার শৈল্পিক মুখচিত্রটি যেন বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে উঠেছে।
যখন যে দেশ চরম বৈষম্যে ডুবে গেছে, সেখানেই শোষণমুক্ত করতে চলে গেছেন এই মহাবিপ্লবী। পুরো নাম এর্নেস্তা চে রাফায়েল গুয়েভারা দে লা সেরনা। তবে চে নামেই সমধিক পরিচিত। অসমসাহসী এই বিপ্লবীর জন্ম ১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনার রোসারিও শহরে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে চে ছিলেন বড়। তবে তার জীবনটা ছিল বেশ বিচিত্র। খেলাধুলায় সব সময়ই ছিলেন প্রথম। শৈশবে সপ্তাহে একটিমাত্র পোশাক পরতেন। কৈশোর থেকেই কবিতার প্রতি আসক্তি ছিল তার। ১৯৪৮ সালে ডাক্তারিতে পড়ার ইচ্ছা জাগে। ভর্তি হন মেডিক্যাল কলেজে। ঠিক ওই সময় বন্ধুকে নিয়ে তার মোটরসাইকেলে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণ ছিল এক বিস্ময়। কিন্তু শৈশবের সেই হাঁপানি সেরে ওঠেনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
ডাক্তারি পড়তে গিয়ে চে একসময় চষে বেড়ান সমগ্র লাতিন আমেরিকা। ১৯৫৩ সালের ৭ জুলাই ঘুরতে বের হন বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস, এল সালভাদরের উদ্দেশে। ১৯৫৪ সালের শুরুতে মেক্সিকো পেঁৗছান এবং একটি হাসপাতালে চিকিৎসক পদে চাকরি নেন। দীর্ঘ এই ভ্রমণে মানুষের প্রতি নিপীড়ন রেখাপাত করে তার হৃদয়ে। বিষয়টি তাকে এতটাই নাড়া দেয় যে মনে মনে পণ করে ফেলেন, বিপ্লব ছাড়া এসব বঞ্চিতের মুক্তি সম্ভব নয়। সেই থেকে শুরু। যোগ দেন গুয়াতেমালার প্রেসিডেন্ট জাকোবো আরবেনজ গুজমানের সঙ্গে সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে। ১৯৫৪ সালে পুঁজিবাদীদের ইশারায় গুজমান-এর ক্ষমতাচ্যুতি চে মেনে নিতে পারেননি। ফলে পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংসের নতুন প্রতিজ্ঞায় হাত মেলান কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো আর রাউলের সঙ্গে। তখন তিনি মেক্সিকো সিটিতে।
মার্কিন মদদপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাত করতে ১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর ফিদেল-রাউলসহ যাত্রা করেন কিউবায়। দুই বছর গেরিলা যুদ্ধের পর সফল হন। উৎখাত করেন বাতিস্তা সরকারকে।
কিউবায় সরকার গঠন করেন ফিদেল কাস্ত্রো। ১৯৬১ সালে কিউবার শিল্পবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। দায়িত্ব পান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের। একই সময়ে দেশের সামরিক বাহিনীর পরিচালক (পরামর্শক)। এ সময় তিনি সংস্কারের মাধ্যমে পাল্টে দেন কিউবার চেহারা।
কিন্তু এত সব লোভনীয় পদও আটকে রাখতে পারেনি চে-কে। কারণ বিপ্লব যে তার মন থেকে দূর হয় না। তাই কিউবা সরকারের প্রতি হাতজোড় অনুরোধ করে বলেন, 'তোমরা আমাকে যেতে দাও। আমার কানে বাজছে নিপীড়িতের কান্না, শুনতে পাচ্ছি বঞ্চিতের আর্তনাদ। তোমরা আমাকে ফিরিয়ো না। আমাকে যেতে দাও ওদের উদ্ধারে। যেতে দাও।' এভাবেই সব ছেড়ে বৃহত্তর বিপ্লবে অংশ নিতে ১৯৬৫ সালে কিউবা ত্যাগ করেন চে।
১৯৬৫ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি মাত্র ১২ জন সহচর নিয়ে কঙ্গোয় পেঁৗছান এবং গৃহযুদ্ধে অংশ নেন। কিন্তু বিপ্লবচেষ্টা ব্যর্থ। এরপর অংশ নেন বলিভিয়ার বিপ্লবে। ১৯৬৬ সালের শেষ দিকে চে বলিভিয়ায় গেরিলা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। বলিভিয়ার সেনাবাহিনীর ভাষ্য অনুযায়ী, শোষণমুক্তির আন্দোলনের অবিস্মরণীয় এই নেতা ওই বছরের ৭ অক্টোবর গ্রেফতার হন। দু'দিন পর গুলি করে হত্যা করা হয় 'স্বদেশ, নয় বিপ্লব' ধারার প্রবর্তক এই গেরিলা যোদ্ধাকে।
চে চলে গেলেও যে বৈপ্লবিক চেতনা মানুষের মনে গেঁথে রেখে গেছেন, তা শোষিত আর বঞ্চিতের হাতিয়ার। শোষণে-বঞ্চনায়-নিপীড়নে তাই বারবার ভেসে ওঠে সেই চিরচেনা মুখ।