টকশোতে সেদিন দেখলাম দেশের প্রখ্যাত নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন; ঢাকার যান চলাচল এমন এক পর্যায়ে গিয়েছে যে এখন কোনো ব্যবস্থাই আর কাজ করবেনা। এর সমাধান হচ্ছে বিকেন্দ্রিকরন, অর্থাৎ মানুষের গন্ত্যব্যের কেন্দ্রগুলো ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু বিকেন্দ্রিকরন তো হোলো দীর্ঘমেয়াদী, তাই বলে এখনি কিছু করা যাবেনা, সেটা বোধহয় ঠিক না। আইন শক্ত ভাবে প্রয়োগ করে আর ছট ছোট কিছু স্ট্রাকচার নির্মাণ করে এখনি অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব।
ফিলিপাইনে একটি কোর্স করার সময় দুজন থাই বন্ধু খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল । তাদের মুখ থেকেই শুনেছিলাম ব্যাংককে একসময় যানযটের কারনে অফিসমুখী জনতা ভোর বেলা সকালের নাস্তা হাতে নিয়ে বাসে আরোহন কোরতো এবং বাসে বসেই তা সেরে ফেলতো, কারন গন্তব্যে যেতে দুই ঘণ্টা লাগত। এই অবস্থার সমাধান তারা করেছে আকাশ রেলের মাধমে। তবে পুর্নাংগ সমাধান যে হয়েছে তাও বলা যাবেনা। উল্লেখ্য, আমাদের দেশেও আকাশ রেলের পরিকল্পনা হয়েছে সেই ২০০৫ এ। বাস্তবায়ন বোধহয় দেখে যেতে পারবোনা।
আকাশ রেল.. ব্যংককের একটি গন পরিবহন মাধ্যাম
ব্যাংককেও একসময় আমাদের মত আবর্জনা নিয়ে সমস্যা ছিল। এ নিয়েও একটি ঘটনা শুনেছিলাম; একদিন এক দম্পতি মটরসাইকেলে করে সকালে অফিসে যাওয়ার সময় বাসা থেকে সঙ্গে আনা ময়লার পুটুলিটা টুপ করে রাস্তার পাশে ফেলে দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে লুকিয়ে থাকা পুলিশ মটরসাইকেলের নাম্বার টুকে নিল। দুদিন পর সেই দম্পত্তি পোস্টে একটি পার্সেল পেল। খুলে দেখল তারা যে ময়লার পুটুলিটি রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল সেই ময়লা এবং সাথে জরিমানার নির্দেশ তদের হাতে ফিরে এসেছে। এখন ব্যংককের রাস্তায় সিগারেটের ছাই ফেললেও জরিমানা।
প্রায়ই দেখি ঢাকার ভি আই পি রোডে চকচকা গাড়ির জানালা খুলে জুসের বা চিপসের খালি প্যাকেট রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। তারা কারা? বেশিরভাগ দেখি স্কুল ফেরত বাচ্চাদের নিতে আশা নতুন গাড়ীর মালিক হওয়া অভিবাবকরা। শিশুকে তারা কি শিক্ষা দিচ্ছে?
রাস্তার পাশে দোকানের কর্মচারীরা দোকান ঝাড়ু দিয়ে সব ময়লা দোকানের সামনেই রাস্তায় ছুড়ে দিচ্ছে যেখানটা কিছুক্ষন আগে ডি সি সি কর্মীরা পরিস্কার করেগিয়েছিল। হকার ফেরিওয়ালা তাদের বর্জ ফুটপাথেই ফেলে যাচ্ছে। একদা অপরিস্কার বলে পরিচিত কলকাতা শহরেও দেখেছি রাস্তার পাশের দোকানদাররা দিনশেষে ফুটপাত ঝাড়ু দেবার পর লোহার শলাকা দিয়ে খুচিয়ে পানি যাবার জন্য ড্রেন পর্যন্ত পরিস্কার করছে। ভারতের সব রেল স্টেশান এখন ধূমপান মুক্ত এবং পরিস্কার। কিভাবে হলো?
এক কালে শেয়ালদা রেল স্টেশন যেখানে নোংরা আবর্জনার জন্য পা ফেলতেও ঘেন্না করতো, আজ সেটা কি ঝক ঝকে তকতকে
এই সেই কলকাতা নিউ মার্কেট যা একদা ছিল ধুলি ধুসরিত আর যত্র তত্র ছিল আবর্জনার স্তুপ
স্কুলে পড়ার সময় আমাদের বিলেত ফেরত এক স্যার বলেছিলেন তিনি যখন বিলেতে তার ইংরেজ এক বন্ধুর সাথে হাটছিলেন, দেখলেন বন্ধুটি রুমালে থূত ফেলে তা পকেটে রেখে দিলেন। স্যার ত অবাক। শেষে বন্ধুটি বললেন ইংরেজরা ব্যাক্তিগত ভাবে নোংড়া হতে পারে তবে সমস্টিগত ভাবে পরিস্কার। আর আমরা তার উল্টোটা। আমরা যত্রতত্র এখানে সেখানে কফ থুথু পানের পিক সিগারেটের অবশিষ্টাংশ ছুড়ে নিজে পরিস্কার থাকছি কিন্ত চারপাশ যে নোংড়া বা দুষিত করছি তা নিয়ে ভাবি না।স্বাস্থ্য সচেতনতা তো দূরে থাক আমাদের মাঝে পরিচ্ছন্নতা বা সৌন্দর্য্যবোধ কোনটাই নেই ।
আমার এক বন্ধু বলেছিল গ্রামের নৌকার মাঝি যখন ঢাকায় এসে রিক্সা চালায় তখন রাস্তাকে নদীর মতই মনে করে, যেদিকে খুশি সেদিকেই যায়। গ্রামের পরিবেশ প্রাকৃতিক ভাবেই পরিস্কার। বাড়ী ঝাড়ু দিয়ে উঠানের পাশে ফেলে দেয়া ময়লা বর্ষায় ধুয়ে যায়। গ্রামে যেখানে সেখানে থুতু ফেললে তাৎক্ষনিক শুকিয়ে যায় নগর জীবনে এই অভ্যাস বজায় রাখা সম্ভব না। তাই অভ্যাস পরিবর্তন দরকার। দরকার সচেতনতা এবং বাধ্য করা তাহলেই অভ্যাস বদলাবে। উদাহারনগুলো সে কারনেই বললাম।
ফুট-ওভার থাকতেও রাস্তা দিয়ে পার হওয়া যায় বলেই ত সবাই তা করছে। কিছুদিন পুলিশ ব্যাবস্থা নিল, আমরাই সমালোচনা করে তা বন্ধ করে দিলাম। বিশেষজ্ঞরা বলে জনগনকে সচেতন করতে হবে। আমার মনে হয় অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের মত কড়া ব্যবস্থা দরকার তাহলেই বোধহয় আমরা সচেতন হয়ে যাব। সচেতনতা মানে শুধু জানা নয়, মানসিকতার পরিবর্তন এবং কাজে প্রয়োগ, তিনটাই। যেমনটি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে চলার সময় আমরা কিন্ত সবাই সচেতন।
ঢাকার যান চলাচলের মহা পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়েছে বেশ আগে (২০০৫) কিন্তু তার প্রকল্পগুলো অগ্রাধিকার মাফিক বাস্তবায়ন হচ্ছেনা। টকশো তে তাও বলা হোলো। কিন্তু কেন? কারন সাধারন জনগনের স্বার্থ অগ্রাধিকার পায় নাই, পেয়েছে গাড়ীওয়ালা সুবিধা ভোগীরা। আগে তারা, তারপরে আমজনতা, এটাই বাস্তবতা। কে বলবে জনতার অগ্রাধিকারের কথা?
তারপরও কিছু করা যায়ঃ
• ছোটো ছোটো স্ট্রাকচার যেমন ফুটপাতের হকার বাজারগুলো দোতালায় (ফুটওভার গুলো চওড়া করে) সেখানে স্থানান্তরিত করা, রেল লাইনের বাজার গুলো (মালিবাগ, মগবাজার, কাওরানবাজার)রেল লাইনের উপর প্রশস্থ ছাদের মত বা ফুট ওভারের মত পাকা করে তার উপর স্থানান্তরিত করা।
• শাপলা চত্বর, সোনার গাঁ চত্বর এরকম বিশাল চৌরাস্তা চত্বরে মাটির নীচে বাহুমুখী আন্ডার পাস সহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য জায়গা করা।
• সকল উত্তর-দক্ষিন প্রলম্বিত রাস্তাগুলোর উপর পর্যাপ্ত ফ্লাইওভার ইউ-টার্ন, রাইট টার্ন এবং চওড়া ফুটওভার ব্রীজ নির্মান করা।
• পাশাপাশি ফুট ওভার ব্রিজের সাথে শপিং মলগুলোর ওভারহেড সংযোগ করা যা অনেক শহরেই দেখা যায় ।
• বনশ্রীর পাশের খালকে যাতায়াত উপযোগী করা।
• রাস্তার উপর পার্কিং ও ডাস্টবিন বন্ধ করা, কিছু রাস্তা একমুখী করা, বাসের লেন নির্দিস্ট করা, ব্যস্ত শপিং এলাকায় গাড়ী নিষিদ্ধ করা (গাউছিয়া, নিউমার্কেট)।
• রাস্তায় বাস দাড় করিয়ে "গলাচিপা" করে গাড়ী আটকানো কঠোরভাবে বন্ধ করা
• ভি আই পি চলাচলের জন্য রাস্তা বন্ধ না করা,
• কিছু জায়গায় আলাদা রিক্সা লেন করা
এইজাতীয় ছোটো ছোটো আরো অনেক উপায় বের করে যানযটের মোটামুটি সমাধান এখনি করা যেতে পারে। প্রতিদিন যানজটের জন্য যে পরিমান টাকা অপচয় হয়, যে পরিমান ক্ষতি হয় এসব স্ট্রাকচার করতে এবং আরো বেশি লোকবল নিয়োগে তারচেয়ে অনেক কম টাকা লাগবে বলেই আমার বিশ্বাস। তবে ট্রাফিক পুলিশ এবং প্রাইভেট কোনো আউটসোর্স সংস্থা জড়িত করে মানুষকে বাধ্য করার বিকল্প নেই।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১০:৪৮