somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কীত্তনখোলা ইন সিডনি অলিম্পিক পার্ক

১৫ ই মে, ২০১৪ সকাল ৯:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আচ্ছা কীত্তনখোলা নদীটা কোনখানে কওতো? লোকটি আমার হাত টেনে ধরে।
দুইহাতে দুটো ফুচকার প্লেট নিয়ে আমি শারমিন কে খুঁজছিলাম। মেলায় প্রচণ্ড ভিড়। কেউ হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া দায়। এমন সময় এই উটকো লোকের ঝামেলায় ভিষণ বিরক্ত লাগলো। প্রায় বলেই ফেলেছিলাম, হোয়াট দ্যা ফাক...কিন্তু লোকটার মুখের তাকাতেই নিজেকে সামলে নিলাম। ষাটোর্ধ্ব একজন বৃদ্ধের সাথে এভাবে কথা বলাটা বোধহয় উচিত হবে না। তার বদলে বললাম, জ্বী কাকে খুঁজছিলেন যেন?
কীত্তনখোলা নদী, কই কবার পারো?
কীত্তনখোলা নদী! এটা কোন স্টলের নাম আমি মনে করার চেষ্টা করলাম। বনফুল, হাটবাজার, বনলতা, রেশমী, বাংলা ইন সিডনি...ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম মায়াবী শাড়ি ঘর, হাজির বিরিয়ানি, অস্ট্রোবাংলা অষ্টব্যাঞ্জন, কোথাও কিত্তনখোলা নদী নামের কিছু চোখে পড়লো না। আমি মাথা নাড়লাম, না চাচা এই নামে কোন স্টল মেলায় নাই মনে হয়। পাশের পরোটা কাবাবের দোকানটা দেখিয়ে বললাম, আপনি এক কাজ করেন, ওই দোকানের কাউকে জিজ্ঞেস করেন, ওরা হয়তো জানবে। বলে হাতটা ছাড়িয়ে সামনে এগুতে চাইলাম।
লোকটা আমার হাত ছাড়লো না। আমার চোখের উপর চোখ রেখে বললো, ক্যান তুমি বাংলাদেশে থিকা আসো নাই?
এবার আমি না রেগে পারলাম না। ঝাঁঝের সঙ্গে বললাম, বাংলাদেশ থেকে আসি নাই মানে! আমাকে দেখে কী ইংরেজ মনে হয়!
তালি কীত্তনখোলা নদী চিনো না ক্যান! লোকটা অবাক বিস্ময়ে বললো।
কীর্তনখোলা নদী চিনবো না কেন? কিন্তু এইখানে...হঠাৎ আমি বুঝতে পারলাম লোকটা সত্যি সত্যি কীর্তনখোলা নামের নদীটি খুঁজছে! এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম! অস্ট্রেলিয়ার অলিম্পিক পার্কের মাঠে বরিশালের কীর্তনখোলা নদী! আমি ভালো করে লোকটার দিকে তাকালাম। ক্লান্ত ভেঙ্গে পড়া চেহারা।কপালে ভাঁজের আঁকিবুকি। মাথাভর্তি কাশবনের মতো সাদা চুল। ভারি চশমার আড়ালে চোখ দুটোতে ধূসরতার ছায়া।মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।গায়ে চেক শার্টের ওপর খয়েরি একটা চাদর আড়াই প্যাচে জড়ানো। কালো ঢিলেঢোলা প্যান্টের সাথে চামড়ার পাম শু, যেন প্রাইমারি স্কুলের খগেন মাস্টার আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। একটু পরেই মাথায় হাত রেখে বলবেন, আশীর্বাদ করি, বড় হও। আমি খানিকটা নরম সুরে জিজ্ঞেসা করলাম, চাচা আপনার সাথের মানুষজন কই? সাথের মানুষজন!
লোকটা গাল চুলকে মনে করার চেষ্টা করে। ও সাথের মানুষজন, তারাতো সব বর্ডারের ওপার। কোন বর্ডার! আমি অবাক হই। কেন তুমি বর্ডার চেনো না! এইপারে বাংলাদেশ, ওইপারে ইন্ডিয়া। চেনো না? লোকটা এমন ব্যাকুল হয়ে পশ্ন করে যে তাকে নিরাশ করতে ইচ্ছা করে না।
মাথা নেড়ে বলি, বর্ডার কে না চেনে! লোকটা খুশি হয়।বাংলাদেশের ছাওয়াল হইয়া বর্ডার চিনবা না, তা কী হয়! এইবার কীর্তনখোলাডা কোন দিকে কওতো?
শারমিনের কাছে গরম গরম ফুচকা নিয়ে পৌঁছানোর আশা আমি ছেড়ে দেই। যে পাগলের পাল্লায় পড়েছি তাতে অস্ট্রেলিয়ার এই বৈশাখী মেলায় কীর্তনখোলা নদী পয়দা না করে আমার মুক্তি নেই। বাধ্য হয়ে মিথ্যা কথা বলতে হয়, চাচা ওই যে মাঠের যেখানে স্টেজ, ওখানে গেলেই নদী পাবেন। আমার ইশারা করা দিকটাতে লোকটা তাকায়।
ওই যে পতাকা উড়তিছে, সোনার বাংলা হইতেছে ওইখানে? জ্বী ওইখানে, আমি হেসে মাথা ঝাঁকাই। লোকটা হঠাৎ রেগে ওঠে। আচ্ছা তুমি কি সত্যিসত্যিই দ্যাশের ছাওয়াল কওতো?
লোকটার প্রশ্নের ঝাঁঝে আমি কুকড়ে যাই। আমতা আমতা করে বলি, জ্বী বাংলাদেশেই আমার বাড়ি। দাদার বাড়ি ফরিপুর, নানার বাড়ি খুলনা।
তাইলে তুমি জানো না ক্যান!
কী জানি না!
পতাকার নিচে কোন নদী নাই। আমি খুঁজছি বুঝলা। হাত দিয়ে সে লাল সবুজের মিলনমেলায় এক টুকরো বাংলাদেশ হয়ে থাকা মেলার মাঠটাকে দেখিয়ে বলে, পুরা দ্যাশটা খুঁজছি। সবাইরে জিগাইছি, গালে বাংলাদেশের মানচিত্র, জামায় লাল সবুজ পতাকা, শাড়িতে গ্রাম বাংলার ছবি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষের ওপর লোকটার চোখ একবুক হতাশা নিয়ে ঘুরে আসে, কীত্তনখোলার খবর কেউ কইতে পারে না!
আচ্ছা কীর্তনখোলা নদী দিয়ে আপনি কি করবেন চাচা? আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বলি।
রঙ পাল্টাবো বাবা।
রঙ পাল্টাবেন, আমি আকাশ থেকে পড়ি, কীসের রঙ?
লোকটা বুক পকেটে হাত দিয়ে প্লাস্টিকে মোড়ানো একটা প্যাকেট বের করে।এইটার রঙ, বলতে বলতে সে প্যাকেট খুলে জিনিসটা আমার সামনে মেলে ধরে।
পাসপোর্ট!
হ বাবা ইন্ডিয়ার পাসপোর্ট। কীত্তনখোলার জলে ধুইয়া এইটারে সবুজ বানাইতে চাই। কীত্তনখোলা আমার বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষ, হে আমারে সারাদিন কলকল কইরা ডাকে। কয়, তুইতো আমার পোলা, আইয়া পড়! লোকটার চোখে জল ছলছল করে, যেন পুত্র হারানোর শোকে কীর্তনখোলা নিজেই কান্না চেপে কাঁদছে। নাছোড়বান্দা ভিক্ষুকের একটা টাকা চাওয়ার মতো করে লোকটা আমার হাত আঁকড়ে ধরে বিষণ্ন কণ্ঠে বলে, নদীডার কাছে আমারে একটু নিয়া যাও না বাপ।

আমি ফ্যাল ফ্যাল করে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকি। হাত নয়, লোকটা যেন আমার কলিজা টেনে ধরে রেখেছে। আমার প্রচণ্ড হাঁসফাঁস লাগে। হাজার চেষ্টা করেও নতুন পাওয়া অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট এর নিচে হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের সবুজ মুখটা আমি মনে করতে পারি না!

৩০/০৪/১৪
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×