জেলা স্কুলের দুটি সেকশনের ৪০+৪০ = ৮০ জন ছাত্রের মাঝে আমি ছিলাম এ সেকশনের। প্রচন্ডরকম অন্তর্মুখিতাজনিত কারনে অল্প কয়েকজন ছাড়া পুরো ক্লাসের সবার সাথে বন্ধুতা আমার স্কুল থেকে বের হবার সময়ও সেভাবে হয়ে উঠেনি। অার সোহেল ছিলো আমার সম্পুর্ণ বিপরীত মেরুর। প্রচন্ডরকম আমুদে ও আড্ডাপ্রিয়, সর্বোপরী আমাদের স্কুলের কাছেই তার বাবার নুপুর নামে বিশাল বিপনীবিতান থাকার কারনে সে আমাদের সমীহ পাবার এক্সট্রা দাবীদারও ছিলো। ক্লাসের দুরন্ত ছেলেদের গ্রুপটির একটিভ সদস্য বলতে যা বুঝায় তা সে ছিলো। স্কুলে থাকার সময় ক্লাসমেট থেকে বন্ধুতা অন্তর্মুখি আমার সাথে বহির্মুখি সোহেলের তাই সেভাবে হয়ে উঠেনি। তবে দুর থেকে তাকে কিছুটা ঈর্শাও কি করতাম ? স্কুল পেরিয়ে কলেজ পর্যায়েই সেই ৮০ জন কে যে কখন কোথায় তরী ভিড়িয়েছিলো তা এত বছর পর আমার ভালো করে মনেও পড়ে না। কেউ ঢাকায়, কেউ চট্টগ্রামে, কুমিল্লায়, নোয়াখালীতে, সিলেটে, রাজশাহীতে, কেউবা দেশের বাইরে সেই সুদুর কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা ইউক্রেনে। কলেজ-ভার্সিটি পেরিয়ে চাকুরী জীবনে প্রবেশের পর একে একে সেই স্কুলের বন্ধুদের আবার খুঁজে পাওয়া। আজ ফেবুতে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আমাদের সেই ৮০ জনের মাঝে প্রায় ৫০ জন আছে। চাকুরী জীবনে প্রবেশের কয়েক বছর পর আমি সেই ফেলে আসা স্কুলের শহরে আবার যাই শুধুই ছেলেবেলার স্মৃতির পাতা উল্টাতে। তখনি সোহেলের সাথে দেখা তাদেরই সেই বিপনীবিতান নুপুরের সামনে। দেখেই দুহাতে জড়িয়ে ধরে ভিতরে নিয়ে গেলো। ততদিনে তার বাবা ওপারের বাসিন্দা। ও নিজেই তাদের প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করে। অনেক অনেক গল্প, কোনমতেই সে ছাড়বে না। সবচাইতে অাশ্চর্য্যের বিষয়, আমিতো সেই ছোটবেলার প্রাণবন্ত, ড্যামকেয়ার সোহেলকে খুঁজছি, কিন্তু এ কে ? জীবন মানুষকে কতটা পাল্টে দেয় ? এরপর অনিয়মিতভাবে হলেও ফোনেই কথা হতো। মাঝে মাঝেই সে আমাকে যেতে বলতো। কিন্তু আমি হলাম শিঁকড় ছেড়া মানুষ, মাইজদী যদিও আমার জন্মশহর নয়, তবে ছেলেবেলার শহরে আমার কেউ নেই, কিছু নেই, শুধুই একরাশ স্মৃতি ছাড়া। তাই যাব যাচ্ছি করেও আমার আর যাওয়া হয়ে উঠেনি। ও ঢাকায় আসলে দেখা হতো, তবে দু একবারের বেশী না। এর ভিতর সে বিয়েও করেছিলো নিজের পছন্দে। পরে একদিন শুনি সে ঢাকারই কোথাও চাকুরী করে কি একটা প্রতিষ্ঠানে। শুনে প্রচন্ড আশ্চর্য্য হয়েছিলাম তাদের প্রচন্ড আর্থিক সচ্ছলতার কথা ভেবে। মাথা থেকে সব চলেও গিয়েছিলো পারিবারিক বা অফিসিয়াল ব্যাস্ততার কারনে। কিভাবে যেনো তার মোবাইল নাম্বারটা হারিয়েও ফেলি এরই মাাঝে। তাই যোগাযোগ যা ছিলো তাও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একদিন শুনি সোহেল অসুস্থ্য। ঢাকারই কোন হসপিটালে ভর্তি আছে। কি একটা জরুরী কাজে আটকে পড়ে তাকে দেখতে যেতে পারিনি। অবশ্য ভাল হয়ে যাবার পর কয়েকবারই ফোনে কথা হয়েছিলো। ওর সাথে সর্বশেষবার দেখা ও কথা হয়েছিলো সম্ভবত মিরপুর ডিওএইসএসের কোন এক বিয়ের প্রোগ্রামে।গত কালই সকালবেলায় মান্নার ফোন পেয়ে উচ্ছসিত হতে না হতেই বজ্রাঘাত - দোস্ত শোন, সোহেল নাইরে। কয়েক সেকেন্ড কথা বলতে পারি নি, মুহূর্তেই সবকিছু অর্থহীন হয়ে গেলো, আমি যে উত্তরায় গুরুত্বপূর্ণ অফিসিয়াল মিটিংএ এ্যাটেন্ড করতে যাচ্ছি, তাও আর গুরুত্বপূর্ণ লাগছে না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ড্রাইভার পিছন ফিরে দুবার তাকালো, অামি ঠিক অাছি ইশারা করে তাকে সামনে তাকিয়ে সাবধানে গাড়ী চালাতে বললাম। প্রায় দুশ মাইল পেরিয়ে শেষবারের মত তাকে দেখাটাকি আমার উচিত ছিলো না ? নিজেকেই প্রবোধ দিলাম, এখনতো শুধুই বাইরের নশ্বর দেহটাই বাকী আছে, সোহেলতো চলেই গেছে। প্রথমে রুবেল, এরপর তুই ? এই মিছিলে আমরাও আসছি বন্ধু, আজ বা কাল। ভাল থাকিস বন্ধু, যেখানেই থাকিস। সক্রেটিস এর ভাষায়ই বলি, Death may be the greatest of all human blessings.
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১:৩২