আজ দিনটাই যেন শুরু হয়েছে কেমন ভাবে। প্রথমে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হল, আবার এখন রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিন সকালে কমপক্ষে পাঁচটা রিকশা সবসময়ই দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার মোড়ে। অন্য কোন দিন পেল না, আজকেই যেন এরকম হতে হবে। আসাদগেট গিয়ে দাঁড়ালাম। আটটা বাজে। শুনেছিলাম ফার্স্ট ইয়ারের জন্য নাকি সাড়ে সাতটায় সংসদ ভবনের সামনে থেকে ভার্সিটির বাস ছাড়ে। প্রথম দিনই বাস গেল মিস হয়ে। ধুর, কার মুখ দেখে যে উঠেছিলাম আজকে!!
ছোটবেলায় দাদুবাড়িতে থাকতে মাঝেমাঝে দুষ্টুমি করে লাল পিঁপড়ার বাসায় পানি ঢেলে দিতাম। অনেকগুলো পিঁপড়া পিলপিল করে চারপাশে ছড়িয়ে পড়তো। মাটি যেন লাল পিঁপড়া দিয়ে ঢেকে যেত! আসাদগেটে এই সকালবেলা মানুষ দেখে আমার ছোটবেলার লাল পিঁপড়াগুলোর কথা মনে পড়ছে।
হানিফ আর সুপার বাসের অবস্থা দেখে তো আমার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা হল। দরজায় ঝুলে ঝুলে যাচ্ছে মানুষ!
কি করবো, কিছুই বুঝতে পারছি না। প্রথম ক্লাসের দিনই এত হ্যাপা পোহাতে হচ্ছে! নাকি যাবোই না? নাহ, প্রথম দিনই ক্লাস মিস দেব??
ঢাকায় অনেকগুলো খারাপ লাগার বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে অসহ্য যেটা সেটা হল এই অসহ্য ট্রাফিক জ্যাম। কিন্তু জীবনে প্রথমবারের মত জ্যামকে মনখুলে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে হল! সিগন্যালের ওপাশে লাল ডাবলডেকারটার সামনে লেখা আছে “জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের জন্য”। ভাগ্য ভালো। নিচতলায় সিট খালি আছে। হলে থাকবো কিনা তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। ভালই হল সিদ্ধান্ত নিতে। প্রতিদিন এভাবে কষ্ট করে যাওয়া সম্ভব না। হলেই উঠে যাবো।
বুড়োমতন একজন স্যার এসে প্রায় বিশ মিনিটের মত কথা বললেন। সারমর্ম হল, ম্যাথমেটিকসে ভর্তি হয়ে জীবনের “আনন্দ” যা কিছু ছিল, তা বিসর্জন দিয়েছি আমরা। কোর্স আউটলাইনে যে কি কি বললেন, কিছুই বুঝলাম না। হতাশ হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি অন্যরাও মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ক্লাস শেষ হতেই একগাদা ছেলেমেয়ে আমাদের ক্লাসরুমে ঢুকে পড়ল। সবাই দেখি মুখ গম্ভীর করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে রইলাম।
একগাদা নিয়ম কানুনের লিস্টি ধরিয়ে “ইনফরমাল” ওরিয়েন্টেশন দিয়ে সবার অবস্থা ঝড়ো কাকের মত করে বিদায় নিলেন তাঁরা।
**
- এই মেয়ে, এদিকে এসো।
ইমিডিয়েট সিনিয়র এক আপু ডাকছেন। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম। গত সপ্তাহে “ইনফরমাল” ওরিয়েন্টেশনের পর আসলে এমনিতেই সবাইকে ভয় ভয় লাগছে। ভাইয়া আপুরা বলে দিয়েছেন সব বন্ধুদের চিনে নিতে, যাঁদের চিনবো না তাঁরা সবাই সিনিয়র। দেখলেই অবশ্যই সালাম দিতে হবে।
- জ্বি আপু, আসসালামুআলাইকুম।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুমি যেন কে? আমাদের ডিপার্টমেন্টের না?
- জ্বি আপু। আমি মুনিয়া মেহজাবীন, গণিত বিভাগ, ৩৭ তম ব্যাচ, প্রীতিলতা হল, হোম ডিস্ট্রিক্ট যশোর।
- হুম। ডাকনাম কী?
- আপু, মুন।
- হলে থাকো?
- জ্বি না আপু, আজকে উঠবো।
- ও আচ্ছা। ঠিক আছে যাও।
সালাম দিয়ে চলেই আসছিলাম। হঠাৎ আবার ডাকে জমে গেলাম।
- শোন মুন, এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমিও প্রীতিলতাতেই থাকি। ৩** নম্বর রুমে। এসো।
- জ্বি আচ্ছা আপু। আসসালামু আলাইকুম।
গেল হপ্তায় ক্লাসরুমে এই আপুটাকেই মনে হচ্ছিল যেন বাঘিনী। আজকে কেন যেন মনে হল, নাহ, আপুটাতো বেশ ভালো!!
ক্লাস শেষ আজকের মত। মেহের চত্বরের দিকে পা বাড়ালাম। সিনিয়রদের দেয়া অনেকগুলো নির্দেশের একটা হল সবাই যেন একসাথে থাকে সবসময়। সবাই যেন ক্যাম্পাস চেনে। আজকে সবাই মেহের চত্বরে বসছে।
ক্যাম্পাসটা আসলেই চমৎকার। ডেইরি গেটে নেমে শহীদ মিনার পর্যন্ত রাস্তার মাঝ বরাবর বড় বড় গাছের সারি। গেট থেকে একদম সমাজবিজ্ঞান ভবনের আগ পর্যন্ত সারি সারি টিনের ছাউনি দেয়া টং দোকান। এর নাম মেহের চত্বর। এটা নাকি ক্যাম্পাসের প্রাণকেন্দ্র। সবসময় জমজমাট থাকে।
এই এক সপ্তাহে নিজের আগ্রহেই হোক, আর সিনিয়রদের প্রেশারেই হোক, ক্যাম্পাস সম্পর্কে মোটামুটি হলেও একটা ধারণা হয়ে গিয়েছে। শাহাদাত ভাইয়ের দোকানে বসলাম সবাই।
আড্ডা তখন তুঙ্গে। নিতান্ত বাধ্য না হলে অবশ্য আসতাম না এখানে। এখানে বসে আড্ডার চেয়ে গনরুমের কোন এক কোনায় বসে গল্পের বই পড়তে আমার বেশি ভালো লাগে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। পেছনে হোহো শব্দে হাসি শুনে ফিরে তাকালাম। বারেক ভাইয়ের দোকানে বেশ কয়েকজন ছেলে আড্ডা দিচ্ছে। একজনকে আমি চিনি। আমার ডিপার্টমেন্টেরই, আমার চেয়ে দুই ব্যাচ সিনিয়র। ৩৫ ব্যাচের।
বখাটে ছেলেরা মেয়ে দেখলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু একটা মেয়েও যে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে পারে একটা ছেলের দিকে, এখন নিজে এভাবে তাকিয়ে না থাকলে আমার তা কোনভাবেই বিশ্বাস হত না। তাঁর পাশের ছেলেটার দিকে আমি আক্ষরিক অর্থেই চোখ বড় করে তাকিয়ে রইলাম একদৃষ্টিতে।
গালে কাটা দাগওয়ালা একটা ছেলে ভুসভুস করে নাকমুখ দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে, দু আঙ্গুলে আলতো করে ধরে আছে সিগারেটটাকে যেন হাতেরই কোন অংশ। বাঁহাতে চায়ের কাপ থেকে হাল্কা ধোঁয়া পাকিয়ে উঠছে উপরের দিকে। মে মাসের মেঘলা এই দুপুরে মেহের চত্বরের অতি স্বাভাবিক একটা ঘটনা; কোন হিসেবে যে আমার কাছে হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের কোন ঘটনার মত লাগলো মাথায় ধরলই না ব্যাপারটা। সিগারেটের ধোঁয়াকে মনে হল যেন কুয়াশা। ছেলেটাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। এরকম অসম্ভব রকমের মায়াময় হাসি আমি আর কোথাও দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না।
সম্বিত ফিরে পেতেই হকচকিয়ে তাকালাম এদিক ওদিক। কেউ খেয়াল করল কিনা। নাহ, ওরা সবাই তুমুল বেগে ইকবাল স্যারের মুন্ডুপাত করতেই ব্যস্ত। ক্লাস শুরুর এক সপ্তাহের ভেতরেই উনি টিউটোরিয়াল নেয়ার তারিখ দিয়ে দিয়েছেন। পরশুদিন পরীক্ষা।
**
- আসসালামুআলাইকুম ভাইয়া।
এই কথাটুকু উচ্চারণ করতে আমাকে গত প্রায় আট মাস ধরে নিজেকে কত সাহস দিতে হয়েছে শুধু আল্লাহই জানে। আজকে সকাল থেকেই সুযোগ খুজছিলাম। মেহেরে গিয়ে বসে আছি প্রায় আধা ঘণ্টা। এমন সময় তিনি এলেন। অবশেষে তাঁর নিয়মিত আড্ডার জায়গা বারেক ভাইয়ের দোকানে গিয়ে পায়ের উপর পা তুলে চা সিগারেট অর্ডার করলেন, আর এদিকে আসন্ন সম্ভাব্য মহাপ্রলয়ের কথা চিন্তা করে আরেকটু সংকুচিত হলাম। কচ্ছপদের এই মুহূর্তে আমার হিংসা হচ্ছে। কি সুন্দর একটা খোলস আছে, চাইলেই বাইরের দুনিয়া থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
ও হ্যাঁ, বলাই তো হয় নি। সেমিস্টার না হয়ে ইয়ার সিস্টেম হওয়াতে গণিত বিভাগের শিক্ষকদের অশেষ “স্নেহ” আর ক্লাস নেয়ার প্রেশারে আট মাসেই আমাদের জীবন ঠিকই কয়লা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু একাডেমিক লাইফ সেকেন্ড ইয়ারে প্রায় উঠি উঠি করছে।
সেদিনের পরে ছেলেটার খোঁজ বের করতে খুব একটা বেশি কষ্ট করতে হয় নি। দুদিন পরেই আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই বারান্দায় হাঁটতে দেখে মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকা এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, কে রে উনি? জবাবটা আসলে শুনা আমার উচিৎ হয় নি। তাহলে এরকম মন ভাঙ্গার কষ্টটা পেতে হত না।
মহামান্য আমাদের বিভাগেই পড়েন। সেদিন সাথে থাকা ভাইয়ার মত তিনিও ৩৫ ব্যাচ। অসম্ভব মায়াকাড়া চেহারা আর দেবদূতের মত নিষ্পাপ হাসির পেছনে যুবকের এই পরিচয় আমি কেন, কোন মেয়েই কখনও চাইবে না। সহজভাবে একটা কথাই দেয়া যায়; দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন এই বান্দা। ২২১/বি নম্বর রুমে রুমমেট না থাকলেও নাইন মিলিমিটারের পিস্তল ঠিকই থাকে। টেবিলের উপর নাকি থাকে তাঁর অতিপ্রিয় স্টীলের ছোট একটা শেকল। মারামারির সময় হাতে পেঁচিয়ে নিলে নাকি এক ঘুষিতেই কুপোকাত হয় প্রতিপক্ষ। অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট, তবে পড়ালেখার সাথে তাঁর বিশেষ শত্রুতা। কেউ নাকি কাউকে দেখতে পারেন না। ক্যাম্পাসে ‘বিখ্যাত’ বা ‘কুখ্যাত’ কোন বিশেষণ দেয়া হবে তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে, তারপরে যে “ক্যাডার” বিশেষণ দেয়া যায় এবং তা যে আসলে অতিশায়নের কিছু হবে না এটা হলফ করে বলা যায়।
যাই হোক, মাত্র এক মাসের মাথায় খুবই হতাশার সাথে আবিষ্কার করলাম, আমার কাছে প্রচন্ডরকম অনাকাঙ্ক্ষিত যতগুলো ‘গুন’ আছে, সবই তাঁর মধ্যে থাকার পরেও তাঁর প্রতি কৌতূহল আমার বিন্দুমাত্র কমছে না। এক মাস যেতে নিতান্তই অসহায় হয়ে আবিষ্কার করলাম এই ব্যক্তি আমার ধারেকাছে থাকলেও প্রচণ্ড ভয় যেমন পাই, সাথে সাথে কেমন যেন একটা কষ্ট বুকের ভেতর ফেনিয়ে ওঠে। মনে হয় আমি যেন ভেতরে ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছি এখনই! চোখে শুধুশুধুই পানি এসে পড়ে। যে যাই বলুক, অন্তত ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে বলে কেউ বলে নি আমাকে। তারপরও কেন যেন ঘুরে ফিরে উনি যেখানে যান সেখানে যাওয়ার জন্য অদম্য একটা ইচ্ছা জাগে।
ও, এই “উনার” নাম হচ্ছে শাহরিয়ার হোসেন; সৌম বলেই চেনে সবাই ক্যাম্পাসে। নিজেকে বুঝাই; এধরণের ছেলে আমি ঘৃনা করি। মনে মনে কষে কিছু গালাগাল দিই। সামনে গেলে আবার ঠিকই গলা শুকিয়ে যায়। তবুও অজানা আকর্ষণে বারবার শুধু কথা বলতে ইচ্ছে হয়। জানি, হয়তো চিনবেই না। বা চিনলেও এড়িয়ে যাবে। বা একটা ধমক দিলে? এই ব্যক্তিটাকে আমি যে পরিমাণ ভয় পাই, আমার সাথে শক্ত গলায় একটা কথা বললেও যে আমি ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিব তা একদম নিশ্চয়তা বলতে পারি।
সেকারনেই দীর্ঘ প্রায় আটমাস লাগা শুধু এই কথা বলার সাহসটুকু জোগাড় করতে। তাও প্রায় গত এক সপ্তাহ নিজের সাথে যুদ্ধ করেছি আজকে এই কাজ করার জন্য। এত অপছন্দ; অপছন্দ কি, ঘৃনা করার পরেও যে তাঁর সাথে আমার কথা বলার এই ইচ্ছা, এটা দেখে নিজেই নিজের উপর আশা ছেড়ে দিয়েছি। অবশেষে আজকে একলা পেয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়েছি।
- ওয়ালাইকুমসালাম, ভালো আছো?
তাঁর অব্যর্থ তীর সেই ভুবনভুলানো নিষ্পাপ হাসি দিয়ে যদি একথা না জিজ্ঞেস করতেন তাহলে আমি সত্যি সত্যি মনে হয় কেঁদে দিতাম ভয়ে।
সবসময় দূর থেকে দেখে আসা এই ‘ডাকাইত’ স্বভাবের ছেলের ব্যক্তিত্ব যে এমন হতে পারে, ধারনায় ছিল না। এই ছেলে পদে পদে আমাকে চমকে দিচ্ছে, কনফিউজড করে দিচ্ছে। এত মার্জিতভাবে কথা বলছে, অথচ আমার কল্পনায় তখন ভাসছে পেপার কাটিং এর ছবি। সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ভবনের ছাদে এই গত সপ্তাহেই প্রতিপক্ষের এক কর্মীকে কুপিয়ে যখন গুরুতর আহত করেছিলেন, বাংলাদেশের সব কয়টা সংবাদপত্রে তাঁর নাম এসেছিল। কিংবা পুরাতন কলা ভবনের পাশে সেদিন সন্ধ্যায় প্রতিপক্ষ গ্রুপের ৩৩ ব্যাচের ওই ভাইয়ের হাত ভেঙ্গে দেয়া... সব যেন মাথায় একসাথে গুনগুন করছে। মিলাতেই পারছি না কোনভাবে।
**
ভয়াবহ অবস্থা এখন আমার। অদ্ভুত একটা রোগ হয়েছে। কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। পানি অনেকক্ষণ ধরে ফুটাতে থাকলে যেমন বাষ্প হয়ে নাই হয়ে যায়, আমার অবস্থাও সেরকম। প্রচণ্ড তিরিক্ষি মেজাজ দশা পার করে এখন আমি শীতনিদ্রা দশায় আছি। মেজাজ সবসময় গরম হতে হতে নাইই হয়ে গেছে। সবাইকে দেখলেই অসহ্য লাগে; এরমধ্যে শুধু শান্তির জায়গা একটাই। রুমের জানালার সাথে লাগোয়া আমার বিছানা। লেকের দিকে তাকিয়ে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এমন না যে স্বাভাবিক জীবন থেমে আছে। ক্লাস ঠিকই করি। তবে সেটাকে আদৌ ক্লাস করা বলে কিনা তাতে আমার না হোক, আমার বন্ধুবান্ধবের ঘোরতর সন্দেহ। ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে পুরো ক্লাসের সময় পার করে দেয়াকে ‘ক্লাস করা’ মানতে তাদের ব্যাপক আপত্তি। ইতোমধ্যে তাদের নানান রকম ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল, শেষে একঘরে করার হুমকি সবই প্রয়োগ করা শেষ। কয়েকদিন পর আমার পেটে বোমা মারার হুমকি দিয়েও বের করতে পারে নাই কোন কথা। রুমমেট দেখে আমি ক্লাস থেকে এসে সারাদিনই গুম হয়ে পড়ে থাকি বিছানায়। ও তো আর বুঝে না। আমি যে চুপ করে থেকে নিজেকে গালাগাল করি আর বুঝাই।
‘সৌম মরুক গিয়ে। ও মরলে আমার কি?’
‘সৌমের মত ছেলের এটাই প্রাপ্য’
‘সৌম একটা খারাপ ছেলে, খারাপ ছেলে, খারাপ ছেলে।’
‘মেয়ে, তুই সৌমর কেউ না। জীবনে কথাই বলেছিস একদিন। হয়তো তাঁর মনেও নেই, আর ও তোর দুই ব্যাচ সিনিয়র। নাম ধরে ডাকিস কেন মনে মনে?’
লাভ হয় না কোন। সেদিনের কথাই আসলে এখনো পর্যন্ত সৌমের সাথে বলা আমার একমাত্র কথা। প্রায় প্রতিদিনই দেখতাম বারেক ভাইয়ের দোকানে। মেহের চত্বর জমিয়ে রেখেছে। শুধু আরেকবার এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে পারতাম না। কিছু একটা যেন পা টেনে ধরতো। ইচ্ছে হত গিয়ে বলি, ‘এই ছেলে, সমস্যা কী তোমার? হ্যাঁ? সমস্যা কী? এরকম কর কেন?’
ইচ্ছে শুধু ইচ্ছেই থেকে যেত। আবার পরের মুহূর্তেই নিজের উপর রাগ লাগতো ইচ্ছেটা হওয়ার জন্য। কী মুশকিল!!
সেদিন ও হাসতে হাসতে বলেছিল, “ক্যাম্পাসলাইফ এনজয় করবা, আড্ডা দিবা, ঘুরবা।” মনে মনে জবাব দিয়েছিলাম, “সব করবো। তোমাকে নিয়ে; একসাথে। করবা তুমি ছেলে?”
শুধু মনে মনেই বলেছি অবশ্য। মুখে বলার অসঙ্গত সাহস বা ইচ্ছা হত না। এই অদ্ভুত দোটানা থেকে উদ্ধার করতেই মনে হয় একসাথে বিদ্যুতবেগে ঘটনাগুলো ঘটে গেল। উত্তপ্ত তাওয়া থেকে চুলায় পড়া মনে হয় একেই বলে। রুমে কেউ না থাকলে চোখে মনে হয় পানির একটা ট্যাপ বসিয়ে দেয় উপরওয়ালা। রাগ, ক্ষোভ, ভালবাসা সব একসাথে পানি হয়ে বের হয় চোখ থেকে অঝোরে।
থার্ড ইয়ার ফাইনালের মাত্র কয়েকদিন আগে সৌমদের গ্রুপ ক্যাম্পাস থেকে আউট হয়ে গেল। ওদের প্রতিপক্ষ গ্রুপ দখল করল ক্যাম্পাস। শুনলাম কমপক্ষে দুই বছর আর ওরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারবে না।
মিথ্যে বলব না। একটু খুশিই হলাম। দুই বছর ড্রপ খেলে তো তাহলে আমাদের সাথে ক্লাস করবে সৌম। মনে মনে মরমে মরে গেলাম। কতটা স্বার্থপর হলে আমি ওর ক্ষতি চাই আমার জন্য। কিন্তু মন জিনিসটা বড়ই ত্যাঁদড়। নিয়ন্ত্রনে থাকে না যে!!
**
বেশ কয়েকমাস কেটে গেল। আমিও ধীরে ধীরে রোবট থেকে মানুষ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। সৌমের কথা মনে হলে মনে অজান্তেই হাসির ভঙ্গিতে ঠোঁটটা একটু বেকে যায়, এই যা।
সৃষ্টিকর্তা মনে হয় যখন জাহাঙ্গীরনগরে চান্স পাইয়ে দিয়েছিলেন, বিশেষ কতগুলো শর্ত মনে হয় কপালে লিখে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে প্রথমটাই মনে হয় যে কখনও শান্তিতে থাকতে পারব না। একটুও যদি শান্তি আসতে থাকে তাহলে তা নষ্ট করার পবিত্র দায়িত্ব উনি সাথে সাথে পালন করবেন। ঘটনাও তাই হল।
ডিপার্টমেন্টে গিয়েছি ক্লাস করবো। কয়েকদিন পরেই ফাইনাল শুরু হবে। ম্যাথ বিল্ডিং এর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। অপরিচিত প্রায় বিশ ত্রিশ জন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই হঠাৎ চাদরের আড়াল আর কোমর থেকে চাপাতি আর লোহার পাইপ বের করল। ভয় পেয়ে যেই ডিপার্টমেন্টে ঢুকে পড়ব, তখনই র্যাবের একটি কালো গাড়ি এসে থামল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে পুলিশ, র্যাব বা সামরিক বাহিনীর কেউ আসলে অনুচিত হলেও তাদের প্রতি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা অবহেলার দৃষ্টি থাকে সাধারণত। সেই অবহেলা মেশানো কৌতূহলের দৃষ্টি দিয়েই মনে হল জমে গেলাম। সৌম নামছে গাড়ি থেকে। সাথে চার পাঁচজন কালো পোশাক পড়া র্যাবের লোক।
সৌমকে নামতে দেখেই ছেলেগুলো হইহই করে উঠলো, আর সাথে সাথে র্যাবের সৈন্যরা সৌমকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওরা হইহই করে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু কাছে আসছে না।
এসবের দিকে আসলে তখন নজর দেয়ার মত অবস্থা আমার নেই। সৌমর ছোট করে ছাঁটা চুল আর মলিন শুকনা মুখ, এটা দেখার পরই মনে হল বুকে কেউ একশ মন ওজনের হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরেছে আমাকে। হাঁটুগুলো যেন আমার ভার নিতে পারছে না। দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মুখে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও সেই নিষ্পাপ হাসির কোন ছায়া দেখতে পারলাম না। আমার দিকে তাকিয়ে একটা ম্লান হাসি দিয়ে হেঁটে গেল ও পরীক্ষার হলের দিকে।
আচ্ছা, যদি বুঝত, আমি কিভাবে তখন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছি ভেতরে, তাহলেও কি ওরকম একটা ম্লান হাসি দিয়ে চলে যেত?
খুবই অবাক লাগে আমার। ও পরীক্ষা দেয় কিভাবে?? ডিপার্টমেন্টের বাইরে এতগুলো ছেলে ওকে মারার জন্য ঘুরঘুর করছে এটা মাথায় নিয়ে পরীক্ষার হলে ভালো করে সব লিখতে পারে তো?
নাহ, এই অবান্তর ছেলের জন্য কিসের এত চিন্তা করছি??
**
রাতের বাসে ক্যাম্পাসে ফিরছি। আমার খুব কাছের একজন বন্ধু, যে কিনা ওর অনুসারী ছিল, একদিন বলেছিল সৌম নাকি হলে ফেলে যাওয়া স্টীলের শেকলটা খুব মিস করে। আজকে প্রায় ঘণ্টা তিনেক খুঁজে ওরকম একটা শেকল কিনে আনলাম। কেন আনলাম নিজেও জানি না। সাপ্লাই কার্ভের আপওয়ার্ড স্লোপের মত এরকম ব্যাখ্যা না দিতে পারা কাজের সংখ্যার গ্রাফও দিন দিন উপরেই চলেছে।
কিন্তু এখন কেমন যেন পাথর পাথর লাগে নিজেকে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন একদম আমার আবেগের বারোটা বাজিয়ে তেরটা হ্যাং আর চৌদ্দটা ঝুলিয়ে দিয়েছে। কান্নাও আসে না আর। ফেসবুকে এখনো নিয়মিত ফলো করি ওর স্ট্যাটাস আপডেট। মেধা যে নষ্ট হয় না তার প্রমান দিয়ে এখন সে এমবিএ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে। আমিও ক্যাম্পাসলাইফে পড়ন্ত বেলায়। হয়তো আর দু এক মাস আছি বড়জোর। মাস্টার্স প্রায় শেষের দিকে। একটা মানুষকে একই সাথে ঘৃণাও করা যায় আর ভালও বাসা যায় এরকম বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা যেদিন ক্লাস শুরু করেছিলাম, স্বপ্নেও ভাবি নি। তবে অনেক হয়েছে। আর না।
কোনদিন যদি দেখা হয় ওকে অনেক কথা বলার আছে আমার। ষ্টীলের শেকলটা যে তাঁর প্রিয় আড্ডাখানা বারেক ভাইয়ের দোকানে রেখে এসেছি সেটা বলতে হবে, কতগুলো রাত না ঘুমিয়ে থেকেছি, রুমমেট বলত, ‘তোর চোখের নিচের কালিগুলো ধার দে। কালকে টিউটোরিয়াল পরীক্ষা। কলম নাই।’ এসব বলতে হবে, প্রতিদিন আশা করেছি আজকে থেকে কোন মন্ত্রবলে ও ক্যাম্পাসে থাকা শুরু করবে আবার, কেউ মারতে চাইবে না ওকে; তা বলতে হবে না...?
অনেক কথা বলার আছে ওকে। জমিয়ে রেখেছি সব। একসাথে বলব।
ডিসক্লেইমারঃ প্রায় বছর দেড়েক আগে ফেসবুকে একটা পোস্ট হোম পেজে আসে। সেখানে জেইউ ক্রাশ এন্ড কনফেশন পেজে ৩৭ তম ব্যাচের জনৈক আপুর লেখা একটি পোস্ট আসলে এই গল্পের মূল থিম। ৩৫ ব্যাচের এর সেই ভাই বছর দেড়েক আগে পোস্টটি পাবলিশ হবার সময় আসলেই ঢাবির আইবিএতে এমবিএ করছিলেন। আমি সত্যি বলতে জানিও না ৩৫ এ সৌম ভাই কিংবা ৩৭ এ মুন আপু নামে কোন আপু আছে কিনা। যদি কোন ক্ষেত্রে নাম বা বিভাগ মিলে যায় সেটা নিতান্তই কাকতালীয় বিষয়। এবং সে জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। তবে হল, ব্যাচ, রুম এসব তথ্য যতদূর জানি ঠিকই আছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ২:৩২