ছবি: ওদের আছে স্বপ্ন
১.
গরীব ছেলেটা খুব সখ করে পড়তে এসেছে। বাবা স্কুলে আসতে বারণ করেছিলো তাই বাবার সাথে সে কি তার অভিমান। কথা কওয়া বন্ধ সেই তিন দিন। ময়লা কুড়াবে না আর - এই তার প্রতিজ্ঞা, সে সাদা পৃষ্ঠায় ঝকঝকে অ, আ লিখে ভরাবে, পড়তে শিখবে - এইটুকুই তার সাদামাটা স্বপ্ন। তীব্র অভিমান, নাকি কাল বিকেল থেকে না খাওয়া পেটের তীব্র ক্ষুধায় ব্ল্যাকবোর্ড আর বোর্ডের সাদা লেখা সব মিলেমিশে এক হয়ে যায় ছেলেটা বুঝতে পারে না।
২.
উপরের শব্দগুলো চয়ন করা হয়তো আমার, কিন্তু ঘটনাটার বর্ণনা রুবেলের। আবুল হাসান রুবেল যার প্রতিষ্ঠায় 'আমাদের পাঠশালা' তৈরী হয়েছে। একদিন ক্লাসের কোনায় কাঁদতে দেখে যখন জানতে চায় তার কাঁদার কারন - অনেক কষ্টে জানা যায় খিদের জ্বালায় কাদছিলো লাজুক ছেলেটা। হয়তো গরীব হতে পারে কিন্তু খিদার কষ্টে ক্লাসে বসে পড়ায় মন না দিতে পেরে কাঁদতে হচ্ছে এটা স্বীকার করতে অনেক লজ্জার বাঁধ ভাঙ্গতে হয়েছিলো ওকে সেই দিন। আমাদের পাঠশালায় আসা অনেক ছেলেমেয়েরা সেই রকম পরিবার থেকেই আসে যেখানে দুই বেলা ভরপেট খাওয়াটা বিলাশিতা, যেখানে বাবা মায়ের সাথে সাথে পাঁচ বছরেরর মাসুম অথবা স্বপনকে জীবিকার সন্ধান করতে হয়। এই শিশুগুলোর স্বপ্নকে, তাদের কেবল অক্ষর জ্ঞানই না তাদের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা দেওয়ার তাগিদ থেকেই আমাদের পাঠশালার জন্ম, কার্যক্রম আর পথ চলা।
৩.
ভারতের বিজ্ঞানী ও বিগত প্রেসিডেন্ট এপিজে আবুল কালামের বই 'ইগনাইটেড মাইন্ড' এর উৎসর্গে তিনি উল্লেখ করেছেন স্নেহাল থাক্কার নামের ১২ ক্লাসের একটা মেয়েকে। উৎসর্গের কারন হিসেবে তিনি লিখেছিলেন: ২০০২ সালে যখন তিনি আনন্দালয় উচ্চ বিদ্যালয়ে ছাত্র ছাত্রীদের সাথে কথা বলতে গিয়েছেন তখন একটা প্রশ্ন উঠে এসেছিলো, হু ইজ আওয়ার এনিমি? আমাদের প্রকৃত শত্রু কে?
অনেক উত্তর পান সেদিন আবুল কালাম, কিন্তু যেটার সাথে সবাই একমত হয় সেটা হলো, আওয়ার এনিমি ইজ পভার্টি। 'আমাদের শত্রু দারিদ্রতা'।
এপিজে আবুল কালাম উৎসর্গে মোটাদাগে বলেছিলেন, "এই দারিদ্রতাই আমাদের সব সমস্যার মূল কারন এবং একে মোকাবেল করাই হোক আমাদের একমাত্র কাজ।"
যে ছেলেটার কথা দিয়ে এই পোস্টের শুরু তার মতো শিশুদের মানুষ হয়ে ওঠাকে গলা টিপে প্রতিদিন যে দানবটা হত্যা করেই যাচ্ছে তার নাম দারিদ্রতা। এ এক গণহত্যা।
কেবল শিক্ষার নামে বিদেশী এনজিওরা নাম লিখতে শিখানোর স্কুলের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করবে, গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা যা এখনো কেরানী বানানোর শিক্ষা এবং শিক্ষাকে আনন্দময় করার সামান্যতম প্রচেষ্টা যেখানে নেই তা দিয়ে এই গণহত্যার প্রতিকার করা সম্ভব নয়। সম্ভব অন্যরকম প্রচেষ্টার যা নতুন পথ দেখাবে, শেখাবে সরকার ও নীতিনির্ধারকদের এবং সেইরকম এক প্রচেষ্টার নাম 'আমাদের পাঠশালা'।
৪.
উপরের ভুমিকাটুকু যথেষ্ট নয় এই গণহত্যার আনুষাঙ্গিক সমস্যাগুলো তুলে ধরার জন্য। তারপরেও ওখানেই থামছি। প্রসঙ্গটা গত শনিবারে সামহোয়্যার ইনের পাঠকদের 'আমাদের পাঠশালা'য় আড্ডা এবং সেই আড্ডায় আমরা যে উদ্যোগের খসড়া করেছি সেইটা। এইবার তাতেই ঢোকা যাক।
প্রথমত ঘোষক হিসেবে আমার একটা ক্ষমাপ্রার্থনা প্রয়োজন। মুড়ি ও পিয়াজুর কথা বলা হইলেও ভর দুপুরে ঢাকায় যে পিয়াজু ভাজা হয় না, বিশেষ করে মিরপুরে, তা সম্পর্কে আমার চরম অজ্ঞানতার কারনে (জানা গ্যাছে বিকাল ৪টা পরে তা ভাজা শুরু করে)। পিয়াজুর অভাব পুরন করেছে তার খালাতো ভাই সিঙ্গারা। পরে অবশ্য আমরা দুপুরের খাবার খেয়েছিলাম যারা থাকতে পেরেছে তাদের নিয়ে এবং তারপরে যারা শেষতক থেকে ছিলাম তারা চা খেলাম কৌশিকের বৈঠকখানায়।
আড্ডায় প্রায় ত্রিশ জনের মতো আড্ডাবাজ জড়ো হয়েছিলো। কারো নাম বাদ পড়লে মন্তব্যে যোগ করে দিয়েন, আমি আপডেট করে দেবো:
আরিফ জেবতিক ও ভাবী, আরিল ও জানা (সাথে কিন্নরী), রাসেল (সাথে ঋক), জামাল ভাস্কর, কৌশিক, রাসেল (২), পথিক, লিটা, অনঙ্গ, অন্য আনন, মানচুমারা, স্বর্ণা, আইরিন সুলতানা, সাদিক, শামীম, মুন্সিয়ানা, মেসবাহ য়াজাদ, অনন্ত, মুজাহিদ আলম, প্রতু্ৎপন্নমতি। এছাড়াও পাঠশালার রুবেল এবং আমাদের পাঠশালার শিক্ষকদের ভেতরে কয়েকজন।
"আগে গেলে বাঘে খায়, পিছে গেলে সোনা পায়" থিওরী অনুসারে একদম শেষ পর্যন্ত আমরা যারা ছিলাম (হাতে গোনা পাঁচ কুতুব) তারা মাটিতে আর সোফায় লেটকে পেটকে আড্ডা দিলাম কৌশিকের ড্রইংরুমে। সেইটা ছিলো বিশুদ্ধ আড্ডা, কেবলই ব্লগের আড্ডা।
৫.
অন্যান্য পোষ্টে আমাদের পাঠশালা সম্পর্কে কথা হয়েছে, রাসেল অনেক আগে পোস্টে স্কুলটা সম্পর্কে লিখেছিলো। তারপরে কৌশিক এবং আমিও লিখেছি। তাই সেই বিস্তারিততে যাচ্ছি না। যাচ্ছি কাজের কথায়। আমাদের পাঠশালার কি দরকার এবং আপনি আমি কি করতে পারে।
প্রথমত: এটা পরিস্কার হওয়ার দরকার যে আমাদের পাঠশালা একটা সফল এক্সপেরিমেন্টাল মডেল যেখান গতানুগতিক মুখস্ত বিদ্যা সর্বস্ব এবং উপনীবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার তলানী চেটেপুটে খাওয়া কেরানী বানানোর শিক্ষাকে প্রতিস্থাপন করার চমৎকার উদাহরন। এটা কেবল দু:স্থ শিশুদের স্কুল হয়ে থাকতে চায় না, কিন্তু আপাতত গরীবদের জন্য দুয়ার খুলেছে কারন তাদের জন্য অন্য সব দরজা হয় বন্ধ অথবা দরজার ওপারে অন্ধকার। আমাদের পাঠশালার শিক্ষা দেওয়া নিয়ে যা কিছু ভাবনা তা আমাদের দেশের আর হাজারটা স্কুলে ইমপ্লিমেন্ট করানো গেলে সোজা ভাষায় মেধার উৎকর্ষতার বিপ্লব আনার যায়গাটায় যাওয়া যায়।
ঠিক সেই জায়গায় দাড়িয়ে আমাদের এই উদ্যোগকে কেবল একটা স্কুলের জন্য কিছু করা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। আমাদের পাঠশালার জন্য সহায়তার এই উদ্যোগটা আমরা মডেলের পূর্ণাঙ্গতার দিকে যাওয়ার উদ্যোগ হিসেবে দেখতে চাই এবং মডেলটাকে যাতে আরো রেপ্লিকেট করা যায় আরো গড়ে তোলা যায় আমাদের পাঠশালা তারই ধারাবাহিকতা আমরা দেখতে চাই।
৫.
গরীবের স্কুল, কিন্তু বিদেশী সাহায্য নিয়ে কেন নয়?
আমাদের দেশে এই ধরনের প্রোজেক্টগুলোতে যেখানে বিদেশী এনজিওর অর্থ সাহায্যে সয়লাব অবস্থা সেখানে স্বভাবতই আমরা ধরে নেই যে বিদেশের এনজিও থেকে টাকা এনেইতো এরকম স্কুলের খরচ দেওয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে আমরা রহিম করিমরা কেন নিজেদের পকেট স্কুল চালাবো?
প্রথমত: বিদেশী সাহায্যে ও ম্যানেজমেন্টে এই এনজিও পরিচালিত অনেক স্কুলই বেজায় ফাঁকির একটা জায়গা। এই বিষয়ে যারা খুব কাছ থেকে এনজিওগুলো দেখেছেন, তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে ফার্স্টহ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স নিয়েছেন তারা অনেক ভালো জানাতে পারবেন যে কতটা ফাঁকিবাজী তাদের প্রোজেক্টগুলোতে। শিক্ষার নামে অনেক জায়গাতেই চলে মাস শেষে কখন রিপোর্ট লিখে পরের কিস্তির ফান্ডিং তোলা, কি করে ফান্ডের টাকার সিংহভাবে মালিকদের পকেটে নেওয়া যায় এবং কি করে ১২০০ টাকায় একজন শিক্ষক দিয়ে ৪০০ ছাত্রকে পড়ানো যায়। এমনও উদাহরন আছে এইসব বিদেশী এনজিওর স্কুল প্রোজেক্টে শিক্ষার নামে দু:স্থ শিশুদের কেবল নাম স্বাক্ষর করা শেখানো হয়, শেখানো হয় অক্ষর জ্ঞান, ব্যস ঐ পর্যন্তই। কিন্তু শিক্ষা বলতে যা বোঝায় নাম স্বাক্ষর করার ক্ষমতা - এদুটো কখনোই এক নয়। শিক্ষার সামগ্রিক জায়গাটায় এরা ব্যর্থ এবং তা নিয়ে তাদের মাথা ব্যাথা নেই কারন তাদের কাছে এটা টাকার লেনদেনের প্রোজেক্ট।
আমাদের পাঠশালাকে অনেক বিদেশী সংস্থা অর্থ সাহায্য দিতে চাইলেও তা গ্রহন করা হয় নি ঠিক এই কারনে যে আমরা স্বনির্ভর হতে চাই, আমরা সমাজের অংশগ্রহন চাই। কারন সেটাই টেকশই উন্নয়নের একমাত্র পথ।
৬.
বুঝলাম, এবার তবে ক্যালকুলেটর
আমাদের পাঠশালাকে ঠিকভাবে চালাতে প্রতি মাসে দরকার হয় ৭৫,০০০ টাকা। শিক্ষকদের বেতন এখানে ততটুকুই দেওয়া হয় যা না দিলে ঢাকায় সন্মানের সাথে একজন মানুষ জীবন যাপন করতে পারে না। এখানে অপচয় যেমন নেই তেমনি কার্পণ্যও নেই পাঠশালার। এছাড়া খরচ আছে বাসা ভাড়ার, ইলেকট্রিক বিল, গ্যাস ও পানির। খরচ আছে সব ছাত্রছাত্রীর বইখাতা, পেন্সিল, রং, তুলি ইত্যাদির।
এই যে ৭৫,০০০ টাকা এর পুরোটাই ব্যক্তিগত ডোনেশনের মাধ্যমেই এসে থাকে। আমাদের পাঠশালার বান্ধব হিসেবে অনেকে এককালীণ, মাসিক বা বাৎসরিক কনট্রিবিউশন করে থাকেন।
আমরা যদি ১০০০ জন মানুষ প্রতি মাসে ১০০ টাকা আমাদের পাঠশালায় দিতে পারি তবে এক লক্ষ টাকার একটা ফান্ড সহজেই উঠে আসে। আজকালকার ফাস্টফুডের যুগে প্রতি মাসে ১০০ টাকা খুব আহামরী কিছু নয়। এরচে ঢের অপচয় আপনি আমি করে থাকি।
আপাতত আমরা চাই আপনাদের সহায়তা, পাঠশালার বান্ধব হিসেবে নিজেদের সংযুক্ত করায়। এককালীণ অর্থ সাহায্যও হতে পারে। পাঠশালার একটা লাইব্রেরী গড়ে উঠছে খুব দারিদ্রতার ভিতরে। তাতে শিশুদের পড়ার উপযোগী দান করা যেতে পারে। প্রয়োজন অন্তত দুটো কম্পিউটার যাতে উপরের ক্লাসের বাচ্চাদের কম্পিউটার জ্ঞান দেওয়া যায়। প্রয়োজন ক্লাস সিক্স থেকে অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত এর সম্প্রসারণ।
এই যখন ঘটনা তখন আপনাদের কাছে আমাদের পাঠশালার এইটুকুই দাবী যে আপনার পাঠশালার বন্ধু হয়ে একে সামনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবেন। যেটা খুব আশার কথা তা হলো আমাদের আড্ডায় আমরা ইতিমধ্যেই আমাদের পাঠশালার বান্ধব হিসেব নাম লিখিয়েছি, আমাদের পকেটে হাত পৌছেছি এবং আমাদের অঙ্গীকার করেছি গেল শনিবার। এবার আপনাদের সেই অঙ্গীকারে আমন্ত্রন জানাই
৫.
যেখানে টাকা পাঠাবেন:
আবুল হাসান রুবেল
একাউন্ট নং: ১৩৯ ১০১ ১৩৪৪৪
সুইফ্ট কোড: DBBLBDDH
ডাচ বাংলা ব্যাংক
ইমামগঞ্জ শাখা
ঢাকা, বাংলাদেশ।
যারা দেশের বাইরে আছেন এবং আমাদের পাঠশালায় কন্ট্রিবিউট করতে চান তাদের জন্য পেপ্যাল একাউন্টের মাধ্যমে অনলাইন ডোনেশন:
http://www.mysticalchemydesign.com/donate.html
পাঠশালার বান্ধবা হওয়ার একটা ফর্ম আছে। রুবেলকে অনুরোধ করছি ফর্মটার একটা স্ক্যান কপি পাঠাতে। আশা রাখি কয়েকদিনের মধ্যে তা শেয়ার করতে পারবো।
স্বচ্ছতা নিশ্চতি করতে আপনাদের সব ডোনেশনের টাকার অংক (নাম উল্লেখ ব্যতীত) আমাদের পাঠশালার ব্লগের আপডেট করা হবে।
ঠিকানা:
http://amaderpathshala.blogspot.com/
আমাদের পাঠশালার জন্য প্রাথমিকভাবে ১০০০ জনের বান্ধব সংগ্রহে আপনাদের তরফ থেকে অনলাইন ও অফলাইন সব ধরনের সহায়তা কামনা করছি।
৬.
বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে। আপনিও থাকুন, আপনিও অংশ নিন।
প্রথমত: সমই নাই।
দ্বিতীয়ত: এখনই সময়।
তৃতীয়ত: আপনি না থাকলেও ব্যাপারটা ঘটবে, তবু আপনাকেই চাই।
ত বু আ প না কে ই চা ই ।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০০৯ রাত ২:৩৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




