(ওরা কাশ্মীরের মেয়ে, যেখানে অগণিত পুরুষ নিখোজ হয়ে যান। সেই ভূ-স্বর্গের মেয়ে।কিছু দিন আগে ওদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে এসেছেন
নীলশ্রী বিশ্বাস)
শ্রীনগরের বাটমালু এলাকায় যাবো বলে অটোরিকসায় চড়ে বসেছি। রিকশা চালক কাশ্মীরি হিন্দিতে বুঝিয়ে দেয়, জলদি করো' শ্রীনগরে সন্ধে ছাড়ে ছটার পর মেয়েরা একা একা চলাচল করে না। কারণ বেইজ্জত হওয়ার ভয় থাকে, স্পষ্ট জানিয়ে দেয় চালক।
তবে কি শহরটা দিনে রাতে আলাদা? যে প্রান্তে আমি থাকছি সে দিক-টায় পর্যটকদের ভীর বেশি। অলিগলি পেরিয়ে তাসলিমার বাড়ী পৌছেছি। আট বাই আট ফুটের ঘরে গৃস্থালির খুটিনাটি ছড়ানো। মাঝারি সাইজের কাবা-র ছবি বাধাই করা দেওয়ালে। চিনে মাটির ফুল-পাতা-আকা কাপে কেহওয়া (কাশ্মীরি চা) আসে। হাল্কা ধোয়ার ফাকে আমি প্রথম তাসলিমাকে নজর করি। টেনেটুনে বয়স ২৫ বছর হবে।
২০০৫ এর কোনো এক দিনে লালচক (শ্রীনগরের মূল অফিস বাজার এলাকা) আতর বিক্রেতা নাজির আহমেদকে সেনাবাহিনী গাড়ীতে তুলে নিয়ে যায়। নাজির ছোট ঠেলায় করে আতর, জপমালা, ধুপ, বইপত্তর বিক্রি করত। ২১ বছরের তাসলিমা আড়াই বছর আর চল্লিশ দিনের দুটো সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীকে খোজা আরম্ভ করে। এক জেল থেকে অন্য জেলে, এক ইন্টাররোগেশন ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে। আজ খবর আসে সে অনন্তনাগের জেলে। অন্যদিন শোনে তাকে গুলমার্গের জেলে বদলি করা হয়েছে। নাজিরকে কোথাও খুজে পায় না স্ত্রী তাসলিমা। বছর ঘুরে যায়। হঠাতই সীমান্তবর্তী গন্ধারবাল জেলায় তিন শহিদের সঙ্গে নামহীন কবরে পাওয়া যায় নাজিরকে। তবে কি কাশ্মীরে সবাই জঙ্গি? বেসরকারী সূত্রে (এ পি ডি পি এবং জে কে সি সি এ-র সূত্র অনুযায়ী) মৃত মানুষের সংখ্যা ৭৫,০০০, হারিয়ে গেছেন ১০,০০০ এর-ও বেশি। তারা সবাই নিশ্চয় জঙ্গি কাজকর্মের সাথে যুক্ত, না হলে কী করেই বা এই অভিযোগ ওঠে যে ওয়ারেন্ট ছাড়াই তাদের গ্রেফতার করছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী? গত মে মাসেও সাড়া কাশ্মীরে মোতায়েন ছিল ছয় লক্ষের বেশি সেনা। সুরক্ষার তারনায় দু লক্ষ পরিবার ছন্ন ছাড়া, প্রতিটি পরিবার থেকে মানুষ নিখোজ।
আগুনের ফুলকি সবেচেয় বেশী এসে পড়েছে মেয়েদের জীবনে। শান্ত গেরাস্থালি থেকে পথে বেড়িয়ে মোকাবিলা করতে হচ্ছে জীবনকে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ, সেনা বাহিনী ও প্রশাসনকে-ও। স্কুলের গণ্ডি পার না হওয়া এই মেয়েরা নিখোজ স্বামীর খোজে দিল্লী অবধি ছুটে গিয়েছেন, সাহায্য চেয়েছেন আদালতের। আশায় ঘাটতি পড়েনি। অধিকাংশ মেয়ে বুক বেধে আছেন, কবে ফিরবে স্বামী, ভাই বা ছেলে। আর সত্যিই যদি তারা কোন দিন না ফেরে তাহলে মেয়েরা চায় একটু দেখতে তাদের মৃতদেহ।
কত জনের কথা বলব? ত্রিকোলবালের মাহমূদা, যে তার প্রেমিক গুলাম নবীর জন্য সাত বছর প্রতীক্ষায়। ঔষধের কারবারী গুলামকে নাকি গুলমার্গের কোন এক গ্রাম থেকে তুলে নিয়ে যায় ভারতীয় বাহিনী। হাঞ্জিবেরার ফাইয়াজের জন্য অপেক্ষারত তার বৃদ্ধা মা। ২৫ বছরের আব্দুল হামীদের জন্য প্রতিরাত ঘুমহীন কাটাচ্ছেন তার মা আজরা বেগম। মুহাম্মাদ মকবুল তিনি ছিলেন মাধ্যমিক স্তরের স্কুল শিক্ষক, স্কুল থেকে বাড়ী ফেরার পথে আজ বারো বছর যাবত নিখোজ। স্ত্রী আফরোজা আর বড় মেয়ে রেহানা তার মৃতদেহ পাওয়ার অপেক্ষায়।
রেহানা বলল, আমার কাশ্মীর জ্বলছে . . তোমরা আমাদের ছেড়ে দিচ্ছনা কেন? আমি দ্বন্দ্বে পড়ে যাই। কই একবারেও তো পাকিস্তানের কথা বলছেনা কেউ! তারপর সংক্ষিপ্ত একটা মন্তব্য করে ছোট বোন সুলতানা। যার অর্থ, দিদি আর বলিস না।
এভাবেই ভারতীয় সেনাদের অভিযানের নামে ধরপাকড়, খুন আর অত্যাচারের অভিযোগ শুনতে থাকি।
বারামুল্লা জেলার প্রত্যেকটা গ্রামের মানুষ নিখোজ। নিখোজ গুলমার্গ, অনন্তনাগ, তনমাগ, কপুওয়ারা গন্ধারবাল জেলার বহু মানুষ। রাতের অন্ধকারে, দিনের আলোয়, কাজ থেকে ফেরার পথে দোকান থেকে বাড়ী থেকে এমনকি শোবার ঘর থেকে মানুষকে অপহরণ করেছে ভারতীয় সেনারা। কোন বিচার নেই, কোনো প্রতিকার নেই। কারণ, হিউম্যান রাইটস শব্দটা ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে প্রজোয্য নয়। কাশ্মীরে সেনার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া সহজ নয়-সরাসরি ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হতে হয়। কোর কারণ ছাড়াই তল্লাসী করতে পারে, তুলে নিয়ে যেতে পারে যে কাউকে। আর্মড ফোর্সেস এক্ট সুরক্ষার নামে এক আইন, যা ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে দেয় নিরংকুশ ক্ষমতা। রাজ্য মানবাধিকার কমিশন কাগুজে বাঘের চেহারা নিয়েছে। আদালত পর্যন্ত পৌছানো দূরের কথা, নিকটবর্তী থানা নাকি এফ আই আর-টুকুও নেয় না। ঘুস চায়। অসংখ্য মেয়ে পিটিশনার হিসাবে এ কথাটা প্রমাণই করতে পারে না যে, তাদের ভাই, স্বামী, ছেলে নিখোজ হয়েছে।
যখন হাজারো মহিলার জীবন বিধ্বস্ত, যখন তারা প্রায় ধরেই নিয়েছেন যে, প্রিয়জনেরা আর ফিরবে না, তখন গোটা কাশ্মীরের এ সকল মহিলাকে এক জায়গায় করেছেন এক আগুনে মহিলা। নাম তার পারভীনা আহামগার। কাশ্মীরের প্রতিটি পরিবার যাকে এক ডাকে চেনে। ১৯৯০ সালের আগষ্ট মাসে তার ষোল বছরের ছেলে জাভেদকে ধরে নিয়ে যায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা। একাদশ শ্রেণীর ছাত্র জাভেদ স্কুল থেকে তখন বটমুলার বাড়িতে ফিরছিলো। ১৮ বছর ধরে জাভেদ নিখোজ।
(সূত্র : ভারতীয় আনন্দবাজার পত্রিকা, ১১ ডিসেম্বর ২০০৮)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।






