somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের বুকে হাজার বছরের ইসলামী ঐতিহ্য - নিউজিয়ে মসজিদ ভ্রমণ

২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১১:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



চীনের রাজধানী বেইজিং—এক শহর যেখানে প্রাচীন ইতিহাস আর আধুনিক সভ্যতা হাত ধরাধরি করে চলে। সি-ফুড, সিল্ক, চা আর টেকনোলজির রাজত্বে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে আপনি যদি একটুখানি নির্জনতা, আধ্যাত্মিক শান্তি আর ইতিহাসের নিঃশব্দ কাহিনী খুঁজতে চান, তবে আপনাকে নিয়ে যেতে হবে এক অনন্য স্থানে—নিউজিয়ে মসজিদ (Niujie Mosque)।
এটি শুধু বেইজিংয়ের নয়, পুরো চীনের প্রাচীনতম মসজিদগুলোর মধ্যে একটি। এর গায়ে লেগে আছে হাজার বছরের ইতিহাস, ইসলামি স্থাপত্য আর চীনা সংস্কৃতির অপূর্ব মেলবন্ধন।





ইতিহাসের পাতায় নিউজিয়ে মসজিদ

নিউজিয়ে মসজিদের সূচনা প্রায় এক হাজার বছর আগে, ৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে, লিয়াও রাজবংশের শাসনামলে। স্থানীয় এক মুসলিম নেতা নাসরুদ্দিন (Nasruddin)-এর উদ্যোগে মসজিদটি নির্মিত হয়। এর অবস্থান ছিল মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকায়, যেখানে হুই সম্প্রদায়ের মুসলিমরা বসবাস করতেন।
এই অঞ্চল ছিল “গরুর রাস্তা” হিসেবে পরিচিত, যার চীনা নাম “Niu Jie” — এখান থেকেই মসজিদটির নামকরণ।

পরবর্তীতে মিং (1368–1644) ও চিং (1644–1911) রাজবংশের সময়কালেও মসজিদটির সংস্কার এবং সম্প্রসারণ করা হয়। তবে মূল কাঠামোর ঐতিহ্য বজায় রেখে প্রতি সংস্কারে সংযোজিত হয়েছে আরও চীনা শিল্পরীতির স্পর্শ।


স্থাপত্য: ইসলামি সৌন্দর্য আর চীনা শিল্পের মেলবন্ধন

নিউজিয়ে মসজিদে ঢুকলেই প্রথম চোখে পড়ে চীনা মন্দিরের মতো কারুকার্যপূর্ণ প্রবেশপথ। কিন্তু ভেতরে যতই এগোবেন, ততই আবিষ্কার করবেন এর ইসলামি আধ্যাত্মিকতা।
• স্থাপনার শৈলী: মসজিদটি মূলত কাঠের তৈরি। পুরো স্থাপত্যে চীনা প্যাগোডা ধাঁচের ছাদ, বাঁকানো কার্নিশ, রঙিন নকশা ও সোনালি ড্রাগনের অলংকরণ চোখে পড়ে। কিন্তু আপনি জানবেন, এটি কোনো মন্দির নয়—এটি একটি মসজিদ, যার ভিতরে কেবলা রয়েছে পশ্চিমমুখী, কিবলা দেয়ালে খচিত কুরআনের আয়াত ও আরবি ক্যালিগ্রাফি রয়েছে।
• মসজিদের আয়তন: প্রায় ১০,০০০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। একইসাথে ১,০০০ জন মুসল্লি এখানে নামাজ আদায় করতে পারেন।
• প্রধান হল (Prayer Hall): ভেতরের নামাজের জায়গাটি বিশাল, চারটি স্তম্ভে দাঁড়িয়ে আছে ছাদের কাঠামো, আর তার নিচে রয়েছে নরম কার্পেট ও খাঁটি আধ্যাত্মিক পরিবেশ।
• মিম্বর ও মেহরাব: কাঠের তৈরি, হাতে খোদাই করা সূক্ষ্ম কারুকাজ। মেহরাবটি পশ্চিম দিকে, মক্কার দিকনির্দেশনায়।
• নারীদের প্রার্থনা কক্ষ: আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে, যা অনেক আগে থেকেই চীনের মসজিদগুলোর একটি বিশেষ দিক।



একটি জীবন্ত ঐতিহ্য ও শিক্ষার কেন্দ্র

নিউজিয়ে মসজিদ শুধু নামাজের স্থান নয়; এটি একটি ইসলামিক শিক্ষা কেন্দ্রও বটে। এখানে রয়েছে একটি পাঠাগার, যেখানে আরবি, কুরআন ও ইসলামি ইতিহাস বিষয়ক বই রয়েছে। এছাড়াও এখানে ধর্মীয় ক্লাস, শিশুদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়।

স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো এখান থেকেই পরিচালিত হয়। শুক্রবারের জুমা কিংবা ঈদের নামাজের সময় এই মসজিদ হয়ে ওঠে জীবন্ত এক মিলনমেলা।



ভ্রমণ টিপস: আপনি যদি নিউজিয়ে যেতে চান…
• অবস্থান: ১৮, নিউজিয়ে স্ট্রিট, জিচেং ডিস্ট্রিক্ট, বেইজিং
• যেভাবে যাবেন: বেইজিং সাবওয়ের লাইন ৭ ধরে Niujie স্টেশন, সেখান থেকে হাঁটলেই মসজিদ
• খোলা সময়: প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত
• প্রবেশ মূল্য: বিদেশিদের জন্য বিনামূল্যে প্রবেশ, তবে দান করা যেতে পারে
• পোশাকবিধি: শালীন পোশাক পরা আবশ্যক, নারীদের জন্য মাথা ঢেকে যাওয়া উত্তম




ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা: সময় যেন থেমে গিয়েছিল

নিউজিয়ে মসজিদে ঢোকার মুহূর্তটা যেন অন্যরকম। চারপাশে ব্যস্ত বেইজিং শহরের কোলাহল, অথচ এর মধ্যে মসজিদের প্রাঙ্গণে ঢুকতেই এক নিঃশব্দ প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে মনে। আরবি ক্যালিগ্রাফির নিপুণ কারুকাজ, কাঠে খোদাই করা সূরা ইয়াসিনের আয়াত, ভেতরের আলোর নরম ছায়া — সব কিছুই বলে, “ইতিহাস এখানে এখনো বেঁচে আছে।”



শেষ কথা: চীনের বুকেও ইসলাম আছে, ছিল এবং থাকবে

নিউজিয়ে মসজিদ কেবল একটি ধর্মীয় স্থান নয়—এটি ইসলামের সহনশীলতা, চীনা সংস্কৃতির উদারতা এবং সময়কে অতিক্রম করে টিকে থাকা বিশ্বাসের প্রতীক।
আপনি যদি বেইজিং ঘুরতে যান, প্রাচীর বা প্যালেসের ভিড়ের বাইরে গিয়ে একটিবার এই মসজিদে প্রবেশ করুন। আপনি ফিরে পাবেন এক নিঃশব্দ আত্মিক অভিজ্ঞতা, ইতিহাসের স্পর্শ আর ধর্মের সার্বজনীন সৌন্দর্য।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজামী, মুজাহিদ, বেগম জিয়াও বিজয় দিবস পালন করেছিলো!!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২০



মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেগম জিয়ার মুরগী মগজে এই যুদ্ধ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না; বেগম জিয়া বিশ্বাস করতো না যে, বাংগালীরা পাকীদের মতো শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার থেকে

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×