somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ম্যারিয়েটা, জ্যাক এবং অতঃপর ভ্যালেরী

০১ লা জুন, ২০০৭ দুপুর ১২:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের লাখো শরণার্থীর করুন জীবন কাঁদিয়েছিলো বৃটিশ তরুনী ম্যারিয়েটাকে। শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহ এবং বাংলাদেশের পে আন্তর্জাতিক প্রচারণায় তিনি তখন আত্মনিয়োগ করলেন। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি আহার নিদ্রা ত্যাগ করে বাংলাদেশের জন্য তহবিল আর সমর্থন জোগার করে চললেন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে এমনকি নিজের বাড়িটিকেই ‘একশন বাংলাদেশ’ এর অফিস বানিয়ে তিনি করেছিলেন বাংলাদেশের জন্য অন্যরকম এক যুদ্ধ। এমনকি ব্র্যাকের ফজলে হাসান আবেদ যখন পাকিস্তানীদের হাতে বন্দি তখন তাঁকে উদ্ধার করে লন্ডনেও নিয়ে যান এই ম্যারিয়েটাই।
যুদ্ধ শেষ হলো। দেশ স্বাধীন হলো। তিনি তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশে এলেন। কিন্তু দেখলেন ভিন্ন এক বাংলাদেশ। দেশজুড়ে তখন লোভ আর কামড়াকামড়ি। যে দেশটার জন্য, যে মানুষগুলোর জন্য তিনি এতকিছু করলেন সেই মানুষগুলোর কুৎসিত রূপ তিনি দেখতে পেলেন। প্রতিবাদ করায় তাকেও নানাবিধ অপবাদ দেওয়া হলো। লজ্জায় অপমানে ঘৃণায় তিনি দেশে ফিরে গিয়ে নিজের শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করলেন।
ম্যারিয়েটার মৃত্যু নিয়ে আমরা কখনোই অনুতপ্ত হতে পারিনি। এমনকি তাঁর স্মরণে এবং তাঁর নামে একান্তই ব্যাক্তিগত উদ্যোগে যে বইয়ের দোকানটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো- শাহবাগের আজীজ সুপার মার্কেটের নিচতলার সেই ‘ম্যারিয়েটা’ দোকানটিতেও স¤প্রতি লেগেছে নতুন সাইনবোর্ড। আহ্ শান্তি... এবার আমরা তার নামগন্ধও মুছে ফেলতে পেরেছি। বিদায় ম্যারিয়েটা।

২.
১৯৭২ সালে সাহায্য সংস্থা কনসার্ণের হয়ে বাংলাদেশে আসেন জ্যাক প্রেগার। যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশে তখন অসহায় মানুষের অভাব নেই। অভাব নেই অনাথ বাচ্চার। জ্যাক এদের সেবা করতে করতে মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হয়ে দেশে ফিরে গেলেন। কিন্তু থাকতে পারলেন না, বাংলাদেশ ও এদেশের মানুষকে ভালোবেসে আবার তিনি ফিরে এলেন এবং সম্পূর্ণ নিজ উদ্যেগে কমলাপুরে একটা শিশু হাসপাতাল করলেন। তৎকালীন সরকার তার কাজে মহাখুশি হয়ে তাকে অনুরোধ করলো অভাবী ও অনাথ শিশুদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র তৈরির। এনায়েতপুরে জমিও বরাদ্দ করলো সরকার, আশ্রয় কেন্দ্রও হলো, অনাথ শিশুরা সেখানে সহি সালামতে বেড়েও উঠতে লাগলো।
আর এই করতে গিয়েই জ্যাক টের পেলেন যে অভাবী শিশুদের দত্তক দেওয়ার নামে এদেশের প্রচুর শিশু পাচার হয়ে যাচ্ছে ইউরোপে। এবং ব্যাবহার করা হচ্ছে পর্ণোগ্রাফিতে। জ্যাক এর প্রতিবাদ করলেন এবং এই শিশু পাচার ঠেকাতে উঠে পরে লাগলেন। কিন্তু হায়, তিনি যে একা এক বিদেশী। আর পাচারচক্রের লোকজনের হাত যে খোদ সরকারেও প্রভাব বিস্তারী তা তো তিনি জানতেন না। আইনি সহায়তার জন্য তিনি গেলেন ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদার কাছে, তিনি পরামর্শ দিলেন এসব ব্যাপারে নাক না গলাতে। কিন্তু জ্যাক নাক গলানো বন্ধ করতে পারলেন না। ফল যা হবার তাই হলো- তাঁকেই শিশু পাচারকারী ও ইহুদি চর আখ্যা দিয়ে দেশছাড়া করা হলো।
জ্যাক এখনো নাকি বেঁচে আছেন, কলকাতার হাওড়া ব্রিজের নিচে ও আশপাশের বস্তিতে তিনি নাকি এখনো বিনাপয়সায় রোগীর সেবা করে যাচ্ছেন। সারা ভারতে তিনি ডাক্তার জ্যাক নামে জনপ্রিয়। কেউ কেউ তাকে মাদার তেরেসার সাথেও তুলনা করে।
আমরাই কেবল তাকে চিনতে পারলাম না... হা কপাল।

৩.
তুলনায় তো ভ্যলেরী টেলরের অনেক সৌভাগ্য। তাকে দেশ থেকে তাড়ানো হয়নি, গুপ্তচরের অপবাদ দেওয়া হয়নি, তাঁকেও আত্মাহুতি দিতে হয়নি। বদলে দেওয়া হয়েছে সন্মানসূচক নাগরিকত্ব। বছরের পর বছর কাজ করার স্বাধীনতা। সিআরপির মতো একটা আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান তিল তিল করে গড়ে তোলার সুযোগ। তাঁর তো ধন্য হয়ে যাওয়া উচিত। এবং সরেই যাওয়া উচিত, সুবিধাবোগীরা নাহলে ফায়দা লুটবে কিভাবে ?

৪.
ভ্যালেরীকে অকর্মন্য করে দেওয়া হয়েছে, কেন করা হয়েছে তা খুব স্পষ্ট। সিআরপি এখন আর ছোটখাট কোনো বিষয় না... অনেক বড় ব্র্যান্ড। কিছু পাঘাতগ্রস্ত লোকের পিছনে সময় ব্যায় না করে বরঞ্চ সিআরপি এখন হরিলুটের কাজে ব্যাবহৃত হতে পারে। পাঘাতগ্রস্তদের দিয়ে কি হবে ? তারচেয়ে লোভীদের ভান্ডার পূর্ণ হউক।
এবং এই কাজে ভ্যালেরী টেলর এক বড় বাঁধা, তিনি যে ম্যানেজমেন্ট বোঝেন না (ম্যানেজমেন্ট শব্দটার বাংলা প্রতিশব্দ কি ধান্ধাবাজী ?) ! অতএব তাকে সরাও।

৫.
ম্যারিয়েটা এবং ডক্টর জ্যাকের পরিনতি আমাকে ভাবিত করে, ভয় জোগায়। ভ্যালেরীকে এখনো তাও দেশে থাকতে দেওয়া হচ্ছে, এমনকি শোপিস হিসেবে সিআরপিতেও রাখা হচ্ছে। কিন্তু যদি ভ্যালেরী বা তার পে আমরা যারা আমজনতা তারা বেশি চিৎকার চেঁচামেচি করি তাহলে ? তাহলে কি ভ্যালেরীকেও অপমান করে দেশছাড়া করা হবে ? যেমনটি করা হয়েছে ম্যারিয়েটা বা ডক্টর জ্যাকের েেত্র ?
করতেই পারে, তারা যে ভীষণ শক্তিমান, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে তাদের অনেক লম্বা লম্বা হাত। তুলনায় ভ্যালেরী যে নিতান্তই শিশু... শিশুতোষ।

৬.
ভ্যালেরী আদতেই একেবারে শিশুদের মতো। গতবছর একটা টিভি অনুষ্ঠান নির্মাণকাজে প্রায় সারাদিন তাঁর সাথে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। তখন দেখেছি একটা পূর্ণবয়স্ক শিশুমন। কি নিষ্পাপ। আমার জীবনে এমনতরো মানুষের দেখা আগে আর পাইনি কখনো। মজা করেই তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- বিয়ে করবেন না ? তিনি বলেছিলেন- ‘আমি সিআরপিকে বিয়ে করেছি, আর কিছু চাইনা।’ এরকম একজন মানুষের সাথে এরকম অমানবিক কাজ কোনো মানুষ করতে পারে ? জানিনা। যারা করছে তারা কি মানুষ ?

৭.
ম্যারিয়েটা বা ডক্টর জ্যাকের বেলায় কিছুই করা যায়নি... ঠেকানো যায়নি তাদের অসহায় পরিণতি। আমাদের জাতিগত লজ্জার পরিমান অনেকই বেড়েছে কেবল। কিন্তু আর বাড়াতে চাইনা। ভ্যালেরী টেলরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখতে আমরা আমাদের ুদ্র সাধ্য নিয়ে যা কিছু সম্ভব তাই করবো। জনে জনে বলে বেড়াবো। ১৪ কোটি মানুষ আমরা, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ালে যে সাগরের ঢেউ ঠেকিয়ে দেওয়ার শক্তি রাখি।
৫৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×