“আপনার তো ডায়াবেটিস!” চিকিৎসকের এই কথা শুনে সেদিন যেন একটা ধাক্কা খেয়েছিলেন মনির সাহেব। দীর্ঘদিন শারীরিক দুর্বলতায় ভোগা সত্ত্বেও চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বরাবরই অনাগ্রহ ছিল তাঁর। প্রধান কারণ - ওষুধ এবং উপদেশ। এই ওষুধগুলো একটা সকালে, একটা বিকালে অথবা খাওয়ার আগে নয় পরে, অথবা এটা করা যাবেনা, ওটা করা যাবেনা - এই সব হাবিজাবি। এসব মেনে চলা তাঁর পক্ষে অসম্ভব- আর তাই শুনতেও চান না এসব নিজের পকেটের টাকা খরচ করে। সেইবার যাও গিয়েছিলেন ছেলে-মেয়ের চাপে পড়ে, তখনই জানতে পারলেন - তাঁর ডায়াবেটিস। একেবারেই দমে গিয়েছিল তাঁর মনটা। মনে হয়েছিল জীবনটা থেকে সব রঙ- আনন্দ এক দমকা বাতাসে হারিয়ে গেল। চিকিৎসকের উৎসাহ বাণী আর তাঁর কানেই ঢুকেনি।
মনির সাহেবের সন্তানেরাও ব্যাপারটি প্রথম থেকেই খেয়াল করেছেন। ভেবেছেন সময় গেলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু, ইদানীং মনির সাহেব প্রায়ই মন খারাপ করে বসে থাকেন। নিয়ম মেনে চলার কথা বললেই রাগারাগি করেন। দিনের পর দিন অবস্থা খারাপ হয়েই চলেছে। রক্তে শর্করাও নিয়ন্ত্রণে থাকছেনা। ফলে একটা মানসিক অশান্তি আর চাপের মধ্যে দিন কাটছে পরিবারের সবার। আপনজনদের একজন দিনের পর দিন মন খারাপ করে বসে থাকলে কারই বা ভালো লাগে!
মনির সাহেবের মতো আমাদের আশে-পাশে বা পরিবারের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা একই সাথে ডায়াবেটিস ও বিষণ্ণতায় আক্রান্ত। ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ- যার সম্পর্কে আমরা প্রায় সবাই পরিচিত। আমরা সবাই জানি, এ রোগে একজন মানুষের ঘন ঘন প্রশ্রাব হয়, অতিরিক্ত পানির তৃষ্ণা পায়, বেশী বেশী খিদা পায়। সেই সাথে আমরা এও জানি, ডায়াবেটিস হলে যে কোনো ক্ষত দেরীতে শুকায়, হাত –পা জ্বালাপোড়া করে এবং আরও অনেক কিছু। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে, আজকাল শরীর দুর্বল বোধ হলেই কিংবা মাথাটা ঝিম ঝিম করলেই চিকিৎসক যদি ডায়াবেটিসের পরীক্ষা না দেন, তবে তাঁকে রোগী বা তাঁর স্বজনদের সমালোচনার পাত্র হতে হয়। ডায়াবেটিসের এ সকল শারীরিক সমস্যা সম্পর্কে আপাত-সচেতন অনেকেই জানেন না বা বুঝতে পারেন না - ডায়াবেটিসের সাথে মানসিক রোগ বা মানসিক সমস্যারও একটা যোগসূত্র রয়েছে। বিশেষত বিষণ্ণতার। এই অজানা বা অল্প জানা দিকটা নিয়েই আজকের আলোচনা।
ডায়াবেটিসের সাথে মানসিক রোগের রয়েছে বহুমাত্রিক সম্পর্ক। বস্তুতঃ এদেরকে পাঁচটি বড় দাগে চিহ্নিত করা চলে। এসব হোল-
১. ডায়াবেটিসের কারণে মানসিক রোগঃ ডায়াবেটিসের কারণেই হতে পারে বিষণ্ণতা (Depression), খাদ্যাভ্যাস বিষয়ক সমস্যা (Bulimia Nervosa, Anorexia Nervosa), উদ্বিগ্নতা জনিত সমস্যা (Anxiety Disorder), স্মৃতিভ্রংশতা (Dementia) প্রভৃতি।
২. মানসিক রোগের কারণে ডায়াবেটিসঃ বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, বিষণ্ণতা প্রভৃতি থেকেও হতে পারে ডায়াবেটিস। গবেষকদের মতে, এর সম্ভাবনা মোট মানসিক রোগীদের মধ্যে শতকরা বারো ভাগ।
৩. আলাদা রোগ কিন্তু একসাথেঃ একজন লোকের ভিন্ন ভিন্ন ভাবে একসাথেই থাকতে পারে ডায়াবেটিস এবং মানসিক রোগ। অর্থাৎ, এদের কোনটাই অপরটার জন্য দায়ী নয়।
৪. মানসিক রোগের ওষুধের কারনেঃ মানসিক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কিছু ঔষধ আছে, যেগুলো দীর্ঘমেয়াদে সেবন করলে ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি থাকে, বিশেষতঃ যদি কোন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ব্যতীত সেবন করা হয়।
৫. ডায়াবেটিস ও মানসিক রোগের একই ধরণের উপসর্গঃ বেশ কিছু শারীরিক ও মানসিক উপসর্গ আছে- যেমন দুর্বলতা, অবসাদ্গ্রস্ততা, নিদ্রাহীনতা, হাতের তালু- পায়ের তালুতে জ্বালাপোড়া অনুভূতি- ডায়াবেটিস এবং মানসিক রোগ উভয় ক্ষেত্রেই থাকতে পারে। একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকই পারেন এসবের যথাযথ কারণ বের করে চিকিৎসা করতে এবং সমস্যার সমাধান দিতে।
যাই হোক, এবার আসি মূল আলোচনায়- ডায়াবেটিস ও বিষণ্ণতার ব্যাপারে কিছু কথায়।
আসলে, ডায়াবেটিস হয়েছে- এই কথাটাই আমাদের প্রায় সবার জন্যই একটা হতাশা জাগানিয়া ব্যাপার। নিত্যদিনের যে জীবনযাপন তাতে বাধ্যবাধকতা আর নিয়মের কড়াকড়ি কারই বা ভালো লাগে। প্রিয় খাবার গুলো আর খাওয়া যাবেনা, আজীবন নিয়ম মেনে চলতে হবে- এই সব ভাবনাই হতাশায় ভরিয়ে দেয় মনটাকে। সাধারণত এটা হয় সাময়িক একটা ব্যাপার, যা ধীরে ধীরে সময়ের ব্যবধানে স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু, অনেক সময় এটা হয়ে যায় দীর্ঘমেয়াদী বা স্থায়ী। প্রয়োজন হয় চিকিৎসার।
গবেষকদের মতে, একজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত লোকের ক্ষেত্রে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা দুই থেকে তিন গুন বেশি। বলা হয়, প্রতি তিনজনের একজন ডায়াবেটিস রোগী বিষণ্ণতার শিকার হন। আর, রোগের পর্যায়ে না হলেও বিষণ্ণতা আক্রান্ত করে পঁয়তাল্লিশ শতকরা ডায়াবেটিস রোগীকে। বাংলাদেশে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে বিষণ্ণতার হার শতকরা পনের ভাগ, যদিও অন্য একটি গবেষণায় এর হার শতকরা ছত্রিশ ভাগ। এর পিছনে মূল কারণ অজানা হলেও, বেশ কিছু ব্যাপারকে দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যেমন- ঐ ব্যক্তির ব্যক্তিত্ত্ব, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন পদ্ধতি, শরীরের অভ্যন্তরস্থ কিছু হরমোনের পরিমানের পরিবর্তন, ‘আমি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত’ এই ধরণের চিন্তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি। এসবের মধ্যে নিজেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ভেবে হতাশ হয়ে পড়াকেই বেশী কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর পোশাকি নাম Reactive Depression.
অপরদিকে একজন লোক যদি দীর্ঘদিন বিষণ্ণতায় ভুগেন এবং চিকিৎসার বাইরে থাকেন তবে তাঁর ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। গবেষকদের মতে, মোট ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের শতকরা সাত ভাগেরই পিছনে বিষণ্ণতা একটি প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। এর পেছনে অবশ্য বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করা যায়, যেমন- বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হলে নিজের প্রতি যত্ন নেওয়া হয়ে উঠে না, নিয়মমতো খাওয়া-দাওয়া এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করা হয়না, শারীরিক পরিশ্রম কমে আসে, শরীরে ইনসুলিনের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়- ফলে ইনসুলিন কার্যকারিতা হারায় প্রভৃতি। দীর্ঘমেয়াদের বিষণ্ণতা আবার অন্যান্য মানসিক রোগেরও জন্ম দেয়; যেমন- অনেকে হতাশা কাটাতে অতিরিক্ত ভোজনবিলাসী হয়ে পড়ে, অনেকের মধ্যে বিভিন্ন অস্বাভাবিক এবং ক্ষতিকর ধারণার (Delusion) জন্ম হয়- যার ফলে রোগীর নিজের যত্ন নেওয়াটা বন্ধ হয়ে যায়। আর এসবের পরিণতিতে দেখা দেয় রক্তে শর্করার উচ্চমাত্রা- অর্থাৎ ডায়াবেটিস।
পিছনের কারণ যাই হোক, একজন লোকের যদি একই সাথে ডায়াবেটিস ও বিষণ্ণতা উভয়ই দেখা দেয়- তবে অবশ্যই তা গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। নাহলে, ডায়াবেটিস বা বিষণ্ণতা কোনটাই নিয়ন্ত্রণ করা যাবেনা। করা যাবেনা বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার নিরাময়। রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়, ডায়াবেটিসের জটিলতা অনেক বেড়ে যায়, শারীরিক অক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে ডায়াবেটিসের কারণে বিষণ্ণতারোধী ওষুধের কার্যকারিতা কমে যায়। ফলে বেড়ে যায় চিকিৎসার খরচ। সবচেয়ে বড় কথা, এই ধরণের রোগীদের মনে জন্ম নিতে পারে আত্মহত্যা প্রবণতা- যা একটা ভয়াবহ সমস্যা।
আর তাই, রোগীর নিজের এবং বিশেষভাবে তাঁর পরিচর্যাকারীদের উচিৎ সবসময় খেয়াল রাখা – রোগীর মধ্যে বিষণ্ণতার কোন লক্ষণ দেখা দিচ্ছে কিনা, আচার -আচরণে কোন অস্বাভাবিকতা দেখা যাচ্ছে কিনা, মনের মধ্যে কোন হতাশা বা অসহায়ত্ব জন্ম নিচ্ছে কিনা, খাদ্যাভ্যাসে কোন পরিবর্তন আসছে কিনা প্রভৃতি। রোগীর নিকটজনদের মনে রাখতে হবে, এধরণের রোগীদের একটা সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে -বিষণ্ণতার অনুভূতিকে অস্বীকার করা, নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা করা। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম এই প্রবাদ বাক্য মেনে রোগীকে সবসময় উৎফুল্ল রাখা, কর্মব্যস্ত রাখা, নিয়ম মেনে চলার জন্য উদ্বুদ্ধ করা – এসবই হতে পারে ডায়াবেটিসের রোগীদের মধ্যে বিষণ্ণতা গড়ে উঠা রোধ করার হাতিয়ার। একই ভাবে, বিষণ্ণতায় আক্রান্ত বা বিষণ্ণতার জন্য চিকিৎসাধীন ব্যক্তিরও উচিৎ নিয়মিত বিরতিতে ডায়াবেটিসের পরীক্ষা করা। রোগীদের উচিৎ নিজের শরীরের যত্ন নিজেই নেয়ার অভ্যাস করা। আর যে সব রোগী নিজের যত্ন নিজে নিতে অক্ষম, তাঁর স্বজনদের উচিৎ ভালোভাবে এবং সবসময়ের জন্যই তাঁর প্রতি খেয়াল রাখা। আর প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে দেরী না করাই ভালো। প্রসঙ্গত, বলে রাখা ভালো- রোগী যদি অতিরিক্ত রকমের অস্বাভাবিক চিন্তাভাবনায় (delusion)আটকে যায়, আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠে, যদি বিষণ্ণতারোধী ওষুধ কার্যকারিতা হারায় বা পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় তবে অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
শুধু তাই নয়, যে সব রোগী শুধু ডায়াবেটিসে অথবা বিষণ্ণতায় আক্রান্ত তাদের উভয়ের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য রাখতে হবে - যেন তাঁরা অন্যটাতে আক্রান্ত হয়ে না পড়েন।
সবশেষে মনে রাখবেন- রোগী, রোগীর আপনজন, ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সবার সমন্বিত চেষ্টা এবং সমন্বিত চিকিৎসাই পারে ডায়াবেটিস ও বিষণ্ণতায় আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ রাখতে; সেই সাথে তাঁর জীবনটাকে আরও উপভোগ্য করে তুলতে।
সবাই ভালো থাকবেন – এই কামনা।
বিঃদ্রঃ লেখাটি একসময় banglanews24.com -এ প্রকাশিত হয়েছিল। নিচের লিঙ্কটি এখন আর কাজ করছেনা বলে লেখাটি পুনরায় প্রকাশ করা হল। এর পরবর্তী লেখাগুলো সময়ে সময়ে প্রকাশ করার ইচ্ছা রাখি।
এখানে ক্লিক করুন
ভালো থাকুন সবাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১২:০০