somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফিরতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারায় ][ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

০৮ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফিরতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারায়
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম


==========================================
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা হলো দেশের অধঃপতিত ও রোগাক্রান্ত বাস্তবতার 'ঘনীভূত অভিপ্রকাশ'। যেসব অপশক্তি ও রুগ্ণ প্রবণতাগুলো নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার জন্ম দিয়েছে তা মোটেও বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। দেশ, রাষ্ট্র, সমাজের সামগ্রিক চেহারাই এই ঘটনার মধ্যে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। সবার মনে প্রশ্ন_ কীভাবে উদ্ধার পাওয়া যাবে এই ভয়ঙ্কর অধঃপতন থেকে? আমার মতে, এ প্রশ্নের সহজ জবাব হলো_ উদ্ধার পাওয়া যাবে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার কর্তব্য সম্পাদনের মধ্য দিয়ে। কী সেই 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারা'?

জাতি হিসেবে এ যাবৎকাল পর্যন্ত আমাদের গৌরব করার মতো যত কিছু আছে, তার মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের বিজয়ী গৌরবগাথা। প্রায় চার দশকের বেশি অতিবাহিত হওয়ার পরও জাতি সেই গৌরবের তিলক, বিজয়ের অমূল্য চিহ্ন বহন করে চলেছে। একাত্তর আমাদের বিজয় দিয়েছে, গৌরব দিয়েছে। সেই বিজয়-গৌরব ম্লান হওয়ার নয়। ম্লান হয়নি কিছুমাত্র।
কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চম দশকে পদার্পণ করার পরও জাতি আজ কঠিন এক প্রশ্নের সম্মুখীন। একাত্তরের অমূল্য বিজয়ের সেই গৌরবের সুধা কি জাতি ধরে রাখতে পেরেছে? অমূল্য বিজয়ের সেই ফসল কি দেশবাসীর ঘরে ঘরে তুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে? এই প্রশ্নের দ্ব্যর্থহীন জবাব হচ্ছে, না! এই না পারার মধ্যেই পরাজয়ের গ্গ্নানি, হতাশার দুঃখবোধ দেশের মানুষকে দংশন করে চলেছে।
এই গ্গ্নানি আর দুঃখবোধের জন্য কিন্তু একাত্তরের বিজয় দায়ী নয়। দায়ী একাত্তর-পরবর্তী প্রায় চার দশকের ঘটনাবলি। ইতিহাসের মাপকাঠিতে বিচার করে এ কথা স্বীকার করে নিতে হয় যে, একাত্তরের অর্জিত বিজয়সম্ভারকে আরও সমৃদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধারাকে দৃঢ়মূল করা তো দূরের কথা, সে দিনের বিজয় ও সাফল্যগুলোকে পরিপূর্ণভাবে ধরে রাখাটাও সম্ভব হয়নি। আরও এগিয়ে যেতে না পারাটা নিঃসন্দেহে বেদনাবহ, কিন্তু কিছু একটা অর্জনের পরও তা ধরে রাখতে না পারার গ্গ্নানি ও যন্ত্রণা অপরিসীম। জাতির জন্য এটা একটা কলঙ্ক। সেই কলঙ্ক মোচনের কাজটিই এখনও জাতির সামনে প্রধান কর্তব্য হিসেবে বিরাজ করছে।
একাত্তরের বিজয়ী মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে সংগঠিত হয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠিত ও প্রগতির পথে বিকশিত হওয়ার অমূল্য সুযোগ এনে দিয়েছিল। বিজাতীয় শক্তির ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে আমরা সেদিন যে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, সেই রাষ্ট্রে সাম্য, মৈত্রী, শোষণমুক্তি, শান্তি, স্বাধীনতা ও প্রগতির পথে নবজীবনের সূচনা করার পথ তৈরি হয়েছিল। জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছিল যুগান্তকারী পটপরিবর্তন সাধন করে নবযুগ সূচনার বাস্তব সম্ভাবনা।
বাঙালি জাতির দীর্ঘকালের গণসংগ্রামের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের মরণপণ প্রত্যয় ও দেশবাসীর সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে আমরা আমাদের দেশের সংবিধান রচনা করেছিলাম। বাহাত্তরে রচিত সেই সংবিধানে ভাষা ও রূপ পেয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা ও ধারা। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা_ এই চার নীতিকে ঘোষণা করা হয়েছিল রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে। ঘোষণা করা হয়েছি যে, এই চারটি নীতির ভিত্তিতেই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে।
আত্মশক্তির ওপর দাঁড়িয়ে স্বাধীন জাতীয় বিকাশের ধারায় দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে 'জাতীয়তাবাদ'কে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। সেই জাতীয়তাবাদের প্রত্যয়ের মাঝে ছিল গভীর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী উপাদান। যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে, যার ঔপনিবেশিক ধরনের শোষণ-শাসনের জিঞ্জির ভেঙে আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলাম, সেই পাকিস্তান ছিল আমেরিকাসহ বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী একটি রাষ্ট্র। সাম্রাজ্যবাদ তার 'ভাগ কর-শাসন কর' নীতি অনুযায়ী সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে, ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে, প্রতিক্রিয়াশীল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ করে পাকিস্তানের সৃষ্টি সম্ভব করে তুলেছিল। এই কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্মের আগে থেকেই 'পাকিস্তান আন্দোলন' ছিল সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রমূলক খেলার সঙ্গে গাটছড়া বাঁধা। রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর সেই পাকিস্তান রাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল সাম্রাজ্যবাদের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-সামরিক আধিপত্যবাদী স্ট্র্যাটেজির একটি প্রধান হাতিয়ার। সিয়াটো, সেন্টো ও বিভিন্ন পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বদৌলতে পাকিস্তান হয়ে উঠেছিল বিশ্বের এই অঞ্চলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একটি সামরিক ও রাজনৈতিক আউটপোস্ট। পাকিস্তান পরিণত হয়েছিল মার্কিন ও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির অবাধ শোষণের লীলাক্ষেত্রে।
অনেক দিন পর্যন্ত জাতীয়তাবাদী কোনো কোনো রাজনৈতিক মহল এমন একটি ভ্রান্তি ও মোহে আচ্ছন্ন ছিল যে, সাম্রাজ্যবাদী প্রভুর কাছে তদবির ও দেনদরবার করে বাঙালির স্বাধিকার আদায় করে নেওয়া যাবে। যেভাবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের তোয়াজ করে ও তাদের ষড়যন্ত্রের সহযোগী হয়ে ভারত ভেঙে আদায় করা সম্ভব হয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তানের বাস্তবতাই ছিল এমনই যে, তাকে নিয়ে বেচাকেনা করার সুযোগ সাম্রাজ্যবাদের ছিল না। তাই দেনদরবারে কাজ হয়নি। স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র তুলে নিতে হয়েছিল। একই সঙ্গে প্রতিপক্ষ হিসেবে লড়াই করতে হয়েছিল পাকিস্তান ও আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। সাম্রাজ্যবাদের কাছে পদানত, নতজানু, নির্ভরশীল ও অনুগত হয়ে চলার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সংঘাতে গিয়ে, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে, সেই শক্তিকে পরাভূত করেই বিজয় ছিনিয়ে আনতে হয়েছিল। একাত্তরের সংগ্রাম পরিণত হয়েছিল বাঙালি জাতির সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে। এই জাতীয় মুক্তির অন্তর্নিহিত মর্মবাণীকে অবলম্বন করেই মুক্তিযুদ্ধের 'জাতীয়তাবাদকে' অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতিরূপে সংবিধানে সনি্নবেশিত করা হয়েছিল।
জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সে পথেই শুরু হয়েছিল নবপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যাত্রা। কিন্তু শাসক দল ছিল এই নীতি ধরে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্বল ও দোদুল্যমান চরিত্রের। আর পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে এই নীতি ও পথ সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করে উল্টো পথে যাত্রা শুরু করা হয়েছিল। দেশকে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থের সঙ্গে বেঁধে ফেলে এ দেশকে সাম্রাজ্যবাদনির্ভর একটি রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারার পরিপন্থী সেই ভ্রান্ত পথ ধরেই আজও দেশ অগ্রসর হচ্ছে।
পাকিস্তান ছিল সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারী_ একনায়কত্ববাদী ব্যবস্থায় পরিচালিত একটি রাষ্ট্র। ভাষার অধিকার, সর্বজনীন ভোটাধিকার, নির্বাচিত সরকার দ্বারা দেশ পরিচালনা করার অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মৌলিক নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর গ্যারান্টি_ পাকিস্তানে এসব ছিল নির্বাসিত। সত্তরের নির্বাচনের গণরায়কে কার্যকর হতে যখন বাধা দেওয়া হলো, তখনই গর্জে উঠেছিল বাংলাদেশ। নির্বাচনের গণরায় বাস্তবায়নের প্রয়োজনেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হয়েছিল। পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসন পদ্ধতির অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক সমাজ ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ। মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর অলঙ্ঘনীয় নিশ্চয়তা, আইনের শাসন, নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন ও পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা, পূর্ণ কর্তৃত্ববান নির্বাচিত স্বশাসিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, ভূমি সংস্কার, সব নাগরিকের জন্য অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা-বাসস্থানের নিশ্চয়তা, বৈষম্যের অবসান ইত্যাদি নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রকৃত গণতন্ত্রায়নের পথে সুনির্দিষ্ট নীতি ও পদক্ষেপের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল সংবিধানে। সেসব ব্যবস্থার আলোকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতিরূপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল 'গণতন্ত্র'।
কিন্তু গণতন্ত্রের ভিত্তিমূল সুদৃঢ় করার প্রয়াসে শুরু থেকেই ছিল দুর্বলতা। আর পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতায় যে পরিবর্তন ঘটানো হয়,

তারপরে কয়েক দফায় চলেছে সরাসরি কিংবা বেসামরিক লেবাসে সামরিক বাহিনীর শাসন-কর্তৃত্ব। বছরের পর বছর ধরে লালিত হয়েছে স্বৈরাচারের অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ভিত্তি। নব্বইতে রক্ত দিয়ে সামরিক স্বৈরশাসন উচ্ছেদ করে নির্বাচিত বেসামরিক সরকার ও পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের ধারা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেও গণতন্ত্র নিরঙ্কুশ করা সম্ভব হয়নি। স্বৈরাচারের অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ভিত্তির মূল উপাদানগুলো এখনও বহাল রাখা হয়েছে। চলছে লুটপাটের অর্থনীতি, লুটের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে সংঘাত, অপরাধমূলক কুৎসিত সব অপরাজনীতির খেলা, রাজনীতিতে নমিনেশন বাণিজ্য-টাকার খেলা-ক্যাডার লালন ইত্যাদির রোগাক্রান্ত দাপট এবং সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের আধিপত্য। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা এখনও দূর হয়নি। সর্বত্র চলছে নৈরাজ্য। 'অস্থিতিশীলতা'ই এখনও হয়ে রয়েছে জাতীয় জীবনের সবচেয়ে স্থিতিশীল বৈশিষ্ট্য।
পাকিস্তানি আমল থেকেই দেশবাসীকে সংগ্রাম করতে হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উদ্ভট পাকিস্তানি মতাদর্শের বিরুদ্ধে। বাঙালি জাতির নিজস্ব জাতীয় আত্মপরিচয়ের উপলব্ধি ও জাতিগত জাগরণের মধ্য দিয়ে এই উপলব্ধি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ধর্ম আলাদা আলাদা হলেও জাতি হিসেবে পরিচয় সকলেরই এক_ তা হলো বাঙালি। বাঙালির জাতি-রাষ্ট্রে তাই ধর্ম পরিচয়ের ভিত্তিতে নাগরিক অধিকারকে বিভাজিত করার কোনো সুযোগ থাকতে পারে না। এই নীতিরই স্বাভাবিক আরেকটি প্রত্যয় হলো_ এ দেশের আদর্শবাসীরাসহ সব জাতি-নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিক সমান মর্যাদাসম্পন্ন। হিন্দু-মুসলমান, আমির-ফকির, বাঙালি-আদিবাসী নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সামনে সব নাগরিকই সমান অধিকার ও মর্যাদাসম্পন্ন। 'ধর্ম যার যার, কিন্তু রাষ্ট্র সবার'_ এই নীতি নিয়ে বহুকাল ধরে সংগ্রাম হয়েছে। এটাই রাষ্ট্রনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা বলে পরিচিত। পাকিস্তানের মতো ধর্মভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি ধরে দেশ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। পাকিস্তানি আদর্শে রচিত দ্বিখণ্ডিত এক 'বাংলাস্থান'রূপী নব্য পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য শহীদরা বুকের রক্ত ঢালেনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয় ছিল স্পষ্ট। স্বাধীন বাংলাদেশ চলবে অসাম্প্রদায়িক ধারায়। সেই অনুসারে সংবিধানে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয় 'ধর্মনিরপেক্ষতা'কে।
কিন্তু সে পথে দেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করা হয়নি। পঁচাত্তরের পর সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, পাকিস্তানি ভাবাদর্শ প্রভৃতিকে রাষ্ট্রীয় নীতি ও কাজকর্মে প্রবেশ করানো হয়েছে। শুধু সাম্প্রদায়িক অপশক্তিই নয়, উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদী কালো শক্তিকেও ভিত রচনার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতাকে ভিত্তি করে বিপজ্জনক অন্ধকারের কালো শক্তির থাবার বিস্তারই কেবল ঘটেনি, সাম্প্রদায়িক মনোভাব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রসারিত হয়েছে। এই বিপদের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনায় আজও পূর্ণ সাফল্য পাওয়া যায়নি।
পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল সাম্রাজ্যবাদ, একচেটিয়া পুঁজি ও সামন্তবাদের নিয়ন্ত্রিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় পরিচালিত। পূর্ব বাংলায় ধ্রুপদী সামন্তবাদের অস্তিত্ব সে সময়কালে ততটা না থাকলেও, সামন্তবাদের অবশেষ হিসেবে নানা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। সাধারণ মানুষ জাতিগত শোষণের পাশাপাশি শ্রেণীগত শোষণে নিষ্পেষিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধ তাই জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার জনসংগ্রামের পাশাপাশি হয়ে উঠেছিল বাংলার শোষিত মানুষের লড়াই। মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষের অংশগ্রহণই ছিল প্রশ্নাতীতভাবে প্রধান। শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে সাম্যের সমাজ নির্মাণের সংগ্রাম এ দেশে পরিচালিত হচ্ছিল বহু বছর ধরে। সমাজতন্ত্র হয়ে উঠেছিল জনপ্রিয় স্লোগান। পাকিস্তানের পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে সমাজতন্ত্রের ধারায় স্বাধীন দেশকে গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে পরিচালিত হয়েছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সংবিধানে তাই অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল 'সমাজতন্ত্র'।
সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করার পাশাপাশি, দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কোন ধরনের নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে, তারও বিস্তারিত নির্দেশনা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের 'রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি' প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, 'মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত, ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।' মালিকানা সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বণ্টন প্রণালিসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ এবং এই উদ্দেশ্যে মালিকানা-ব্যবস্থা নিম্নরূপ হইবে : ক. রাষ্ট্রীয় মালিকানা অর্থাৎ অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান প্রধান ক্ষেত্র লইয়া সুষ্ঠু ও গতিশীল রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারি খাত সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের মালিকানা; খ. সমবায়ী মালিকানা অর্থাৎ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে সমবায়সমূহের সদস্যদের পক্ষে সমবায়সমূহের মালিকানা এবং গ. ব্যক্তিগত মালিকানা অর্থাৎ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে ব্যক্তির মালিকানা।' লক্ষণীয় যে, সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাকে প্রাধান্য দিয়ে সমবায়ী ও ব্যক্তিমালিকানাকে আইনের দ্বারা সীমাবদ্ধকৃত অবশিষ্টাংশ (ৎবংরফঁধষ) হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তার পরপরই বলা হয়েছে যে, 'রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে_ কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি প্রদান করা।' কর্মসংস্থান ও কর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'কর্ম হইতেছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয় এবং 'প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী'_ এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেককে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।'
পঁচাত্তরের পর এসব নীতি পরিত্যাগ করে অবাধ মুক্তবাজার নীতির ভিত্তিতে সাম্রাজ্যবাদনির্ভর লুটেরা পুঁজিবাদের পথ গ্রহণ করা হয়েছে। এখনও সেই ধারাতেই অর্থনীতি চলছে।
'৭২-এর সংবিধান বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফসল। আর মুক্তিযুদ্ধ ছিল দীর্ঘ দু'যুগের সংগ্রামের ফসল। বাঙালি জাতির দীর্ঘ সংগ্রামের সমগ্র চেতনা ও ধারার নির্যাস হলো '৭২-এর সংবিধান। এ সংবিধান কোনো রাজনৈতিক লেনদেন, গোপন শলাপরামর্শ অথবা সুযোগ-সুবিধার বিবেচনা থেকে প্রণীত হয়নি। এই সংবিধান গণমানুষের সংগ্রামের অমোঘ শক্তি এবং ইতিহাসের গতিপথের মিলিত রূপ। '৭২-এর সংবিধান বাংলার মানুষের ঐক্যের প্রতীক। বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সামগ্রিকতাকে ধারণ করেই এই সংবিধান রচিত হয়েছে। এটার একটি অখণ্ড রাজনৈতিক চরিত্র রয়েছে। আর এই সংবিধানের মর্মবাণী নিহিত রয়েছে চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, তথা_ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে। এই চার নীতিকে কোনোভাবেই খণ্ডিত করে আংশিকভাবে গ্রহণ করার সুযোগ নেই।
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×