আমার দেখা থাইল্যান্ডঃ পর্ব- ৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
চারিদিকে পানি ছিটিয়ে, ঢেউয়ের ভিতর থেকে শাঁ করে আবার উপরে উঠতে থাকলাম। একি অনুভুতি আমার...! আমি যেন আজ সমুদ্রকে জয় করলাম। বীরের মত দু হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়ে মুখ দিয়ে আ.. আ..আ… করে শব্দ করতে করতে উপড়ে উঠে যাচ্ছি। এবার মনে হচ্ছে আমাকে আবারও ফেলে দিয়ে টেনে তুলুক। বারবার ফেলে দিক। হাত ছড়ানো অবস্থাতেই আমাদের প্লাটফর্ম এ চলে আসলাম। কি করে যেন ঠিক যায়গা মত আমাকে নামিয়ে নিয়ে আসলো। নিচ থেকে দুজন আমাকে জাপটে ধরে আমার ব্যালেন্স রক্ষা করলো।
আবার স্পীড বোটে যাত্রা শুরু হলো কোরাল দ্বীপের পথে। এটা ছিল কোরালের পথে মাঝ বিরতী।
ভেজা জামা কাপড় নিয়ে স্প্রীড বোটে বসে আছি। হোটেল থেকে আসার সময় অতিরিক্ত কাপড় নিয়ে আসা হয়নি। সিলভী বুদ্ধি করে একটা টাওয়াল নিয়ে এসেছিল বিধায় মাথাটা মুছতে পেরেছি। তীব্র গতিতে বোট এগিয়ে চলছে। বউকে বসিয়ে রেখে বোটের সামনে চলে আসলাম। এবার দেখতে পারছি নীল সমুদ্রের রুপ কেমন হতে পারে! সুন্দরী নারী তুচ্ছ এই রুপের কাছে। মিনিট দশেক চলার পর সামনে একটি লঞ্চ দেখা যাচ্ছে। আমাদের আরিচা দউলেদিয়া ঘাটে যে লঞ্চ গুলো যাত্রী পারাপার করে এমন সাইজ হবে। আমরা ওদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। এখানেও নিশ্চই কোন ইভেন্টের ব্যবস্থা আছে।
ফেরির উপর থেকে স্প্রিড বোটের ছুটে চলা দেখা।
ওরে বাবা... একি শুনি! একটু আগে ঘুরে আসলাম সমুদ্রের উপরের আকাশ দিয়ে এখন নাকি ঘুরতে হবে সমুদ্রের নীচ দিয়ে! স্বচ্ছ সমুদ্রের তলদেশ দেখার ব্যবস্থা এখানে। সমুদ্রের ডাইভিং করতে জনপতি আপনাকে ২০০০ বাথ গুনতে হবে। এখানকার পানি এত স্বচ্ছ যে পানির উপর দিয়ে অনেক নীচ পর্যন্ত দেখা যায়। এই এলাকার সমুদ্রের গভীরতা কম। ওদের ভাষ্যমতে ৮০ ফিট গভীর হলেও আপনি ৫০ ফিট পর্যন্ত অবলোকন করে আসতে পারবেন। যারা যেতে চায় তাদের জন্য ১০ মিনিটের টিপস দিয়ে দেয়। সবচেয়ে জরুরী টিপস হলো নিচে যেয়ে কোন সমস্যা অনুভব করলে চেইন টান দেওয়া। কিভাবে টান দিবেন ভালো ভাবে দেখে নিবেন। এই এলাকায় হিংস্র প্রানীর আনাগোনা কম। তারপরেও কিছু হাংগর চলে আসে।
চারজন করে এক একটা গ্রুপ তৈরী করা হয়। এই চার জন সমুদ্রের তলদেশে একসাথে ডাইভিং করবে। প্রয়োজনে এক জন অন্যজনের পাশে দাড়াতে পারে। আমার গ্রুপে আমি আর বাকি তিন বিদেশী। আমি নিজে নিজে ডাইভিং কস্টিউম পড়ে নিলাম। নিজেকে দেখতে অদ্ভুত লাগতেছে। ভুঁড়ি উচু ডলফিন মাছের মত। ভুঁড়িটা চেপে ভিতর দিকে রাখার চেষ্টা করতেছি। সিলভী ভুঁড়ি সমেত ছবি তুলতে গেলে ঘুরে দাঁড়ালাম। নিজেকে এখন ডুবুরী ডুবুরী মনে হচ্ছে। আমাদের দেশের দমকল বাহিনীর ডুবুরী না, একেবারে সমুদ্রের ডুবুরী। আমাদের পিছনে একটি করে অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগিয়ে দেওয়া হলো, মুখে লাগিয়ে নিলাম অক্সিজেন মাস্ক সাথে চোখের গগলস। বউ কে বললাম বিদায় দাও, যদি না ফিরে আসি ….,, এমন গুরু গম্ভীর কথার পরেও বউ হাঁসে। সাথে পরামর্শ দিলো – সময় পাইবা ৩০ মিনিট, এর আগেই আবার ফিরে এসোনা। জীবনে আর এই সময় সুযোগ হবে কিনা ঠিক নাই। সুযোগের ১০০% ইউটিলাইজড করো। আমি ভাবলাম তিনি কাঁদো কাঁদো গলায় বলবে বেশিক্ষন থাকার দরকার নেই, এ দেখি উল্টা বলে!
দ্বীপের হাত ছানী
চারজন একসাথে হাত ধরে কাউন্টিং এর তালে পিছন ফিরে বসা অবস্থায় সমুদ্রে ঝাপ দিলাম। কোথায় হাত ধরা আর কোথায় কি! আশে পাশেই কাওকে দেখা যাচ্ছেনা। ঢেউয়ের তালে এক একজন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। উল্টাভাবে পড়ে এক ডিগবাজী খেয়ে আমি সোজা হয়ে গেছি। একা একাই নিচের দিকে তলিয়ে যাচ্ছি। স্বচ্ছ পানি আর মাথার সাথে লাগানো লাইটের আলোয় চারিদিকে আলোকিত। আমার দলের একজন কে দেখতে পেলাম। প্রথম দেখে ভয় পেয়েছি কোন ভয়ঙ্কর প্রানী ভেবে। কাছেই কিন্তু কেন যেন দূরে দূরে মনে হয়। বৃদ্ধা আগুল দেখিয়ে আমাকে সঙ্কেত দিল। আমি নিচে নামার সাথে আমার সঙ্গীর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম। মজার একটা জিনিস বুঝতে পারছি এখানে। আমরা ইচ্ছা করলেই সাঁতার কেটে মাথা উপরে বা নিচে, নিচে থাকা অবস্থায় সামনের দিকে, যেভাবে ইচ্ছা চলাফেরা করতে পারি। দুজন হাত ধরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। বুকে এবং কানে চাপ অনুভব করছি। আমাদের দুজনের মাঝ দিয়ে দৌড় দিল একঝাক টেংরা মাছের সাইজের কিছু মাছ। নিচের দিকে হটাত করে চোখ আটকে গেল! একি খোদা… , পৃথিবীর উপরিভাগ ও পানির নিচেরভাবের ডিজাইন প্রায় একই রকম। নিচে দেখি পাহাড়ের মত সারি। একটা ছোট একটা বড়। স্রোত তেমন অনুভুত হয়না। ইচ্ছামত মুভমেন্ট করা যাচ্ছে। এগিয়ে গেলাম শেওলা ঘেরা পাহাড়ের দিকে। একঝাক জেলি ফিশ আর দেখি শেওলা দিয়ে বসে আছে। কাছে যেয়ে ধরতে গেলাম হাত দিয়ে, সরে যায় আবার যায়না। বোঝার চেষ্টা করে আমি কি ক্ষতি করবো …, জেলি ফিশের নামটাই বলতে পারলাম, কারন এই নামটাই শুধু জানি। বাকি যেসব লাল নীল বিভিন্ন আকারের বিভিন্ন রকমের যে সব মাছ দেখা যায় তার নাম আমার জানা নেই। প্রজাপতির মত মাছ আছে কিছু। সেগুলো সব সময় দেখলাম চারপাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার সাথের সঙ্গী সব তোলা নিয়ে ব্যস্ত। আমি দেখায় ব্যস্ত। তার কাছে ওটারপ্রুফ ক্যামেরা আছে। আরো একটু সামনে এগিয়ে যেতেই সে আমাকে টেনে ধরলো। হাত দিয়ে ইশারা করলো সামনে না যেতে। দেখি সে ক্যামেরা তাক করছে। খুব কদাকার কিছু প্রানী চোখে পড়লো। সারা শরীর ভরা শুড় জাতীয় কিছু। একটু পরেই বুঝলতে পারলাম এই গুলো অক্টোপাস। বাচ্চা অক্টোপাসের ফ্রাই করা দেখেছি হোটেলে কিন্তু বড় অক্টোপাস এত কদাকার দেখতে চিন্তার বাইরে। শুনেছি এরা অনেক ভয়ঙ্কর হয়ে থাকে পানির তলে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠলে অক্টোপাস গুলো দৌড় মত দিল, সাথে সাথে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। সামনে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। বইয়ে পড়েছিলাম অক্টোপাস বাঁচার জন্য এক ধরনের রঙ ছেড়ে দেয় পালানোর সময়। এটাই সেই রঙ কিনা জানিনা। নিচের দিকে যাবার জন্য সাঁতার দিলাম। দেখি নিচে নামতে পারছিনা। এক যায়গায় স্থীর হয়ে আছি। পিঠের সাথে চেইনের সাথে টান লাগছে। বুঝতে পারলাম আমরা ৫০ ফিট নিচে চলে এসেছি। এর থেকে বেশি কোথায় চলাফেরা আমরা করতে পারবো না। পিছনে পিছাতে থাকলাম। এর ভিতর বাকি সঙ্গীদের খুঁজে পেয়েছি। এক জন আমাদের ইশারা করে নিয়ে গেল আরো পিছনের দিকে। দেখি পাহাড়ের ভিতর গুহার মত দেখতে একটি যায়গা। মনে হয় আদীম কালের কোন গুহার সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। দেড় থেকে দুই ফিট হবে গুহার মুখ। এই মুখ দিয়ে একটি কিছুক্ষন পর পর একটি মাছের মাথা বের হচ্ছে আবার ঢুকে যাচ্ছে। যখন মাথাটা বের হয় দেড় ফুট ফাকা যায়গাটা পুরোপুরি ভরে যায়। বিশাল আকৃতির কোন মাছ হবে। আমাদের ক্যামেরাম্যান ক্যামেরা তাক করছে। এর ভিতর দেখি গুহা মুখ ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। ঘটনা কি আল্লাহ্ মাবুদ জানে। আমরা সবাই একটু আগে পিছে হলেও একই যায়গায় ধরা যায় কিন্তু গুহা মুখ বা মাছটি দূরে চলে যাচ্ছে। এরপরেই বুঝতে পারলাম বিষয়টা। আমাদেরকে উপর থেকে চেইন টেনে তুলে নেওয়া হচ্ছে। কি আর করার আছে। সময় শেষ হয়েছে। উপরে তুলে না নিলে আমরাই বিপদে পড়বো। কারন অক্সিজেন সিলিন্ডার ছোট মাপের হওয়ায় এক ঘন্টার বেশি টিকে থাকা যাবে না। একজন লঞ্চের ডেক থেকে টেনে আমাকে উপরে তুলল। সারা গা থেকে পানি ঝরে পড়ছে। বাকিরাও উঠার পর আমার ইচ্ছা করছিল জানতে ঐ ক্যামেরা দিয় যে ছবি তুলছিল তার সাথে কথা বলতে। সেকি তুলতে পেরেছিল প্রানীটির ছবি? জিজ্ঞেস করার পর দেখি সে রাগে গজগজ করছে। অস্পষ্ট কিছু ছবি সে তুলতে পেরেছে। সে ছবি তুলতে যাবার আগেই আমাদের উপরে তুলে ফেলা হয়েছিল।
---- চলবে---
৯টি মন্তব্য ২টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...
অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা
আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************
যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=
০১।
চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন
কুড়ি শব্দের গল্প
জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!
সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন