কাউকে হুট করে উপরে উঠানো এবং ধড়াস করে নিচে ফেলতে আমাদের জুড়ি নেই। এর প্রমাণ আমরা বার বার দিয়ে যাচ্ছি। সর্বশেষ দিলাম বাংলাদেশের সদ্য পদত্যাগকৃত গভর্নর ডঃ আতিউর রহমানের ক্ষেত্রে।
বাঙ্গালীর মত হুজুগে জাতি এমন আছে কিনা আমার জানা নাই। রাখাল থেকে গভর্নর হওয়াতে আতিউর রহমানকে খ্যাতির তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম, সে ভালো কি খারাপ তা আর যাচাই বাচাই করে দেখার প্রয়োজন বোধ করি নাই। এখন আবার হ্যাকিং এর সব দায় তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তাকে দুনিয়ার বদ মানুষের তালিকায় ফেলে দিলাম কোনো তদন্ত রিপোর্ট হাতে পাবার আগেই। কারণ সবাই বলেছিল সে ভালো তাই সমর্থন জানিয়েছি, আজ সবাই বলে সে খারাপ তাই তাকে খারাপ বানিয়ে দিয়েছি। কান চিলে নিয়েছে শুনে আগে চিলের পিছেই দৌড়াই, কিন্তু কান আছে কিনা তা আগে দেখে নেই না।
বাংলাদেশ ব্যাংক হ্যাকিং ইস্যুতে পাল্টাপাল্টি মতবাদে মত্ত সবাই। কেউ আতিউরের পক্ষে কেউ বিপক্ষে, কেউ সরকারের সমর্থনে কেউ সমালোচনায়। কিন্তু এই মুহূর্তে যা করা উচিৎ তাই করতেছিনা। আমাদেরকে জানতে হবে আসলেই কি ঘটেছে তা খুঁজে বের করা। আমাদের অহেতুক আলোচনা সমালোচনার ভিড়ে প্রকৃত অপরাধী সহজেই আড়াল হয়ে যাবে, ঠিক অতীতের মত।
একতরফা ভাবে চিন্তা না করে বিভিন্ন Angle থেকে ঘটনার পর্যালোচনা করা উচিৎ। যেমনঃ
ক) গভর্নর হিসেবে ভালো মন্দের দায়বদ্ধতা আতিয়ার সাহেবকে নিতে হবে এইটাই স্বাভাবিক। তাই বলে তিনিই যে প্রকৃত অপরাধী তা কিন্তু নয়।
খ) ''রাখাল ছেলে গভর্নর'', এই হিসেবে মানুষ তার প্রতি একটু আবেগপ্রবণ থাকবেই। কিন্তু আবেগ দিয়ে তো আর হয়না। রাখাল ছেলে মানুষকে গরু ভেবে চরাতে চাইতেও পারে। গভর্নরের হাতেই ব্যাংক পরিচালনার চাবিকাঠি, সে চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে।
গ) পদত্যাগ করলেই যে সে সৎ, সাহসী বা নীতিবান, তা কিন্তু প্রমাণ করেনা। অপরাধ করে পদত্যাগ করলেই কি অপরাধ মাফ হয়ে যাবে? আগে তাকে প্রমাণ করতে হবে সে অপরাধী না, তারপর তাকে নীতিবান হিসেবে আখ্যায়িত করতে আমাদের সমস্যা থাকবে না।
ঘ) সে যদি অপরাধী নাই হয়ে থাকে তাহলে তদন্ত করায় তার সাহায্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি পদত্যাগের পরেও। বর্তমানে সে সেটা করতেছে কিনা আমরা জানিনা।
ঙ) আবার কেউ তাকে বলির পাঁঠা বানিয়েছে কিনা তাও তদন্তে আনতে হবে। যে অন্য কেউ অপরাধ করল কিংবা প্রকৃত অপরাধীকে পর্দার আড়ালে রাখার জন্য তাকেই Bullseye বানানো হল।
চ) একটা ব্যাংকে গভর্নরই সব না। Managerial, Tactical & Operational লেভেলে অনেক কর্মকর্তারা কাজ করে যাদের হাতে Money Transaction এর দায়িত্ব থাকে। গভর্নরের অলক্ষ্যে অন্য কেউ কাজটা করে থাকলে এতে গভর্নরের কিছুই করার নাই।
ছ) অন্য কারো চাপে পড়েও গভর্নর হ্যাকিং এ সহায়তা করতে পারেন। ব্যাংক এর কর্মকর্তারা ছাড়া বাহিরের প্রভাবশালী কারো হাত আছে কিনা তা তদন্ত করা উচিৎ কর্তৃপক্ষের। এখন বাহিরের কেউ যদি ক্ষমতাসীন দের কেউ হয় তাহলে তদন্তের ফলাফল নেগেটিভ আসার সম্ভাবনাই বেশী। কারণ ক্ষমতাসীনদেরও ক্ষমতা আছে ঘটনা ধামাচাপা দেবার।
জ) আবার এমনো হতে পারে হ্যাকিং টা কাররই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল না। হতে পারে সিস্টেমের দুর্বলতার কারণে, হতে পারে কর্মকর্তাদের উদাসীনতা বা অদক্ষতার জন্য অথবা কোনো ভুলের জন্য।
ঝ) হ্যাকিং হবার খবর অনেকদিন চাপা রেখে গভর্নর অবশ্যই অপেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। অল্প পরিমাণ টাকা হলে ঠিক ছিল, কিন্তু এখানে পরিমাণটা অনেক বেশীই। উনি হয়ত চেয়েছিলেন ঘটনা ধামাচাপা দিতে অথবা নিজেরাই সমস্যার সমাধান করতে, অগত্যা না পেরেই প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছেন।
ঞ) তারপরেও উনি হ্যাকিং এর কথা প্রকাশ করেছেন বা করতে বাধ্য হয়েছেন। অন্য কোন গভর্নর হলে হয়ত প্রকাশ করতেনই না। সাধারণ মানুষ তো আর ব্যাংকের কত টাকা আসল আর গেলো তার হিসাব রাখেনা, আর রাখাও সম্ভব না। ধামাচাপা থাকলে সাধারণ মানুষ হয়ত কখনো জানতই না যে এতগুলা টাকা চুরি হয়ে গেল।
ট) গভর্নর সাহেব পদত্যাগ করে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। পদত্যাগের মাধ্যমে যথেষ্ট রুচিবোধের ও দায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু উনার এই পদত্যাগ ও আবেগী কথাই প্রমাণ করবেনা যে উনি অপরাধে যুক্ত ছিলেন না। উনার পদত্যাগকে যেমন সন্মান দিতে হবে তেমনি উনাকে প্রশ্নের মুখোমুখিও করতে হবে। কেননা উনি নিজেও অপরাধের সাথে যুক্ত থাকলেও থাকতে পারেন।
আমরা আমজনতাদের একটা সমস্যা যে তারা সব দিক বিবেচনা না করেই গড়পড়তা একপেশে চিন্তা করি। হয় এই পক্ষ না হয় তো ওই পক্ষ। বিচার শক্তিকে কাজে লাগাই না। বিভিন্ন দিক থেকে চিন্তা করিনা যে কোন কাজের Consequence কি হতে পারে।
> তদন্ত কতটুক হবে, আর হলেও সাধারণ মানুষ কতটুকুই বা তার জানবে তার নিশ্চয়তা নাই। হয়ত কিছুদিন এইটা নিয়ে সরগরম থাকবে জাতি, কিছুদিন পরে অন্য সব ঘটনার মত এইটাও পর্দার আড়ালে চলে যাবে। যা আর কখনই চা এর কাপে, ব্লগে কিংবা ফেইসবুকের আলোচিত বিষয় থাকবে না। তখন হয়ত ব্যস্ত থাকব অন্য কোনো রাখাল ছেলেকে নিয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৪:১২