সেই সহজ-সরল লোক গুলোর একজনই হচ্ছেন ময়নাল হক খান। পরিচয়ের মাধ্যমে জানতে পারলাম ময়নাল হক খান অফিসের পরিদর্শক পর্যায়ের একজন কর্মচারী। বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। গ্রামের নামটি মনে পড়ছে না। মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক। গায়ের রং কুচকুচে কালো। মধ্যবয়স্ক হওয়া সত্তেও মাথাভর্তি এখনও কুচকুচে কালো চুল। সেই চুল পরিপাটি করার জন্য সর্বোচ্চ তেল ব্যবহার করা হয়। যাকে বলে তেল চিটচিটে চুল। মেয়েদের মত একপাশে সিতী কেটে চুল আঁচড়ানো। গোলগাল সরলতা মাখানো মুখ। কিন্তু চোখের চাহনি খুব উজ্জ্বল। সরলতাই যেন ময়নাল হক খানের শক্তি। দেখতে ভালো লাগে।
জেলা সমবায় অফিসে যোগদানের পর থেকে ময়নাল হক খানের সাথে অফিসের বিভিন্ন বিষয় ছাড়া তেমন কোন কথা হয়নি। তবে ময়নাল হক খান যখনই সুযোগ পান তখনই শিক্ষকের মতো করে আমাকে বিভিন্ন পরামর্শ দেন। আমিও একনিষ্ঠ ছাত্রের মতো গভীর মনোযোগ নিয়ে তাঁর কথা শুনি। কিভাবে শতভাগ অডিট সম্পন্ন করা যায়। কীভাবে একটি সমবায় সমিতির নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজ করা যায়। ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি আমাকে পরামর্শ দেন। আমিও পরামর্শ অনুযায়ী চেষ্টা করি অফিসের সেবার মান উন্নত করার। এর বাইরে ময়নাল হক খানের সাথে তেমন কোন কথাবার্তা হয় না।
একদিন অফিসের লাঞ্চ টাইমে সরকারি ডাকবাংলাতে এসেছি দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। খেতে বসেছি, এমন সময় দেখি ময়নাল হক খান দৌড়তে-দৌড়তে আসছেন আমার কাছে। রুমে ঢুকে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে-কাঁদতে বললেন, স্যার আমার এখনই ছুটি দরকার। বাড়িতে যেতে হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে? মইনুল হক খান যা বললেন তার মর্মার্থ হলো, তাঁর স্ত্রী সন্তান সম্ভাবা ছিলেন। হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে অসুস্থ অবস্থায় গ্রামের বাড়ির লোকজন উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন। ময়নাল হক খানের সাথে আমি আর কথা বাড়ালাম না। বললাম, আপনি এখনই চলে যান। পরে কথা হবে। সে হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন।
এরপরে বেশ কিছুদিন ময়নাল হক খানের সাথে কথা হয় নাই। আমিও ব্যস্ত ছিলাম। অফিসিয়াল একটি ট্রেনিং এর কাজে কুমিল্লার বার্ডে চলে গিয়েছিলাম সপ্তাহ দুয়েকের জন্য। সপ্তাহ দুয়েক পড়ে মানিকগঞ্জ এ ফিরে আবার দেখা হলো ময়নাল হক খানের সাথে। অফিসে ঢোকার মুহূর্তেই দেখা হলো তাঁর সাথে। দেখলাম কেমন মনমড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বললাম, “কি হয়েছে ময়নাল সাহেব, একা-একা দাঁড়িয়ে আছেন কেন?” বিড়বিড় করে কি যেন বললেন। ঠিক বুঝলাম না। আমি তাকে ডেকে আমার রুমে নিয়ে গেলাম। সামনে বসিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে ময়নাল সাহেব? এবার আমার দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন সরল লোকটি। আমি অবাক হয়ে গেলাম। আবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে, আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি বললেন, ‘আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে, স্যার’। আমার বাচ্চাটা মাড়া গিয়েছে। কত চেষ্টার পড় বার বছর পড় বাচ্চাটি এসেছিল। কিন্তু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই শিশুটি আমাদেরকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেল। ময়নাল হক খানকে আমি কি বলে সান্ত্বনা দিব বুঝতে পারলাম না। চুপ করে থাকলাম। একটু সময় পরে কান্না থামলে ময়নাল হক খান আমার রুম থেকে বিদায় নিলেন। সরল লোকটির কষ্ট দেখে আমিও ব্যথিত হলাম।
বেশ কিছুদিন কেটে গিয়েছে। ময়নাল হক খানের সাথে কথা হয়নি। একদিন অফিসে তেমন কাজের চাপ নেই। বিকাল চারটার মতো বাজে। আমি একা-একা আমার রুমে বসে আছি। বাইরে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অফিস রুমের জানালার পর্দা সড়িয়ে বাইরে তাকালে দেখা যায়, অফিসের সাথে লাগোয়া একটু ফাঁকা জায়গা। তারপর নীচু বাউন্ডারি ওয়াল। বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে দেবেন্দ্র কলেজের দিকে চলে গিয়েছে পিচ ঢালাই সরু রাস্তা। ঝুম বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে কলেজের বেশ কয়েকজন ছেলে-মেয়ে নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার জন্য দৌড় দিয়েছে। রাস্তার ওপারেই বিশাল একটি পুকুর। রাস্তার পাশের পুকুরের পাড়ের অংশটুকু সিমেন্টের ওয়াল দিয়ে ঘেরা। রাস্তাটি যাতে না ভাঙ্গে।
পুকুরটি বিশাল। টলটলে স্বচ্ছ ও গভীর পানি। তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়। আমি অফিসের জানালা দিয়ে পুকুরের পানিতে বৃষ্টির ফোটা পড়ার দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। এমন সময় দরজা নক করে রুমে ঢুকলেন ময়নাল হক খান। আমি বললাম, বসেন ময়নাল সাহেব। আমার কথায় সাড়া দিয়ে ময়নাল সাহেব আমার সামনা-সামনি একটি চেয়ারে বসলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন? ময়নাল হক খান বললেন, আমি মোটামুটি আছি স্যার। কিন্তু আমার ওয়াইফ মানসিকভাবে খুব ভেঙ্গে পড়েছেন। কোনোভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছেন না। কোনোভাবেই সন্তান হারানোর বেদনা ভুলতে পারছেন না।
আমি তাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, কয় ছেলে-মেয়ে আপনার? ময়নাল হক খান একনাগাড়ে বলে চললেন। বার বছর আগেএক ছেলে সন্তান হয়েছিল। তারপর অনেক চেষ্টা করেও আর কোন সন্তান হয়নি। যে ছেলেটি আছে সেই ছেলেটিও প্রতিবন্ধী। বার বছর বয়স কিন্তু তাঁর আচরণ পাঁচ বছরের শিশুর মতো। খাওয়ানো-দাওয়ানো থেকে শুরু করে সব কিছুই তাকে আমাদের করে দিতে হয়। সাধ্যমতো অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু কোন উন্নতি হয়নি। বাড়ির কাছের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছিলাম। কিন্তু লেখাপড়ায় তেমন উন্নতি করেনি। তাছাড়া প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের গ্রহণ করার মতো মন-মানসিকতা এখনও আমাদের দেশে তৈরি হয়নি। তাই এখন আর স্কুলে পাঠাই না। বাড়িতেই থাকে।
মানসিক অগ্রগতি না হলেও শরীর-স্বাস্থ্যে বেশ বড় হয়ে গেছে স্যার। ওকে নিয়ে সব সময় একটা কষ্টের মধ্যে থাকি। তাই অনেকদিন যাবৎ আমরা আর একটি বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। অনেক চেষ্টা তদবির করার পর আমার স্ত্রী পুনরায় সন্তান সম্ভবা হয়েছিলেন। একটি পুত্র সন্তানের জন্মও দিলেন। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য আমাদের। ছেলেটি জন্ম নিল ঠিকই কিন্তু আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আমি নির্বাক হয়ে ময়নাল হক খানের কথা শুনছিলাম। কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। কথা বলতে-বলতে দেখলাম আজও ময়নাল হক খানের চোখ ছলছল হয়ে উঠেছে। কথা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বুঝলাম সেই দীর্ঘশ্বাসের প্রতিটি পরমাণুতে বেদনা জমে আছে। তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ময়নাল হক খান বললেন, স্যার আজকে যাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাবেন? ময়নাল হক খান বললেন, বাড়িতে যাবো। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি বাড়ি থেকে প্রতিদিন অফিস করেন। ময়নাল হক খান বললেন, জি স্যার। অফিসের কাছাকাছি একটি ছাত্র মেসে সিট ভাড়া নেওয়া আছে। জরুরি কাজ থাকলে সেই মেসে থেকে যাই। তা নাহলে গ্রামের বাড়ি থেকেই অফিস করি। আমি আবার প্রশ্ন করলাম আমাদের অফিস থেকে আপনার বাড়ি কত দূর? যেতে কতক্ষণ লাগে? ময়নাল হক খান আমার প্রশ্ন পেয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, স্যার, আমার বাড়ি একদম প্রত্যন্ত গ্রামে। সাটুরিয়া উপজেলার মধ্যেই পড়েছে। আমাদের অফিস থেকে সবমিলিয়ে ৩৩-৩৪ কিলোমিটার হবে। বাড়ি থেকে অফিসে আসতে আমার প্রায়ই দুই-আড়াই ঘণ্টা লেগে যায়। আবহাওয়া খারাপ থাকলে কোন কোন দিন আরও বেশি সময় লাগে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীভাবে আসা-যাওয়া করেন?’ আমার এই প্রশ্নে ময়নাল হক খান নড়েচড়ে বসলেন। মূল প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বেশ আগ্রহ নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের বিস্তারিত বলতে শুরু করলেন। স্যার, আমার বাবা একজন কৃষক ছিলেন। যাকে বলে জাত কৃষক। আমার বাবা পৈত্রিক সূত্রে বেশ ভালো পরিমাণ কৃষি জমি পেয়েছিলেন। সেই জমি চাষাবাদ করেই সংসার চালিয়েছেন। আমরা চার বোন তিন ভাই। আমার বাবা এই কৃষি কাজের উপার্জিত আয় দিয়েই আমাদেরকে বড় করেছেন। বোনদের বিয়ে দিয়েছেন। সাত ভাই-বোনের মধ্যে আমিই একমাত্র ডিগ্রি পাস করতে পেড়েছি। অন্যান্য ভাই-বোনেরা তেমন লেখাপড়া করেনি। কারণ আমাদের বাড়ির কাছাকাছি কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল না। আর একমাত্র কলেজ ছিল উপজেলা শহরে।
ময়নাল হক খান আপন মনে বলতে থাকলেন। আমি মুগ্ধ শ্রোতা হিসেবে তাঁর কথা শুনছিলাম। আমাদের বাড়ি থেকে প্রাইমারি স্কুল ছিল প্রায় চার কিলোমিটার দূরে। বাড়ি থেকে হেটে-হেটে স্কুল করেছি। রোদে ভিজেছি। বৃষ্টিতে পুড়েছি। খাবারের কষ্ট করেছি। কিন্তু আমি লেখাপড়া ছাড়িনি। বাইসাইকেল চালিয়ে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরের কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেছি। ডিগ্রি পাস করে সমবায় অধিদপ্তরে সহকারী পরিদর্শক পদে চাকুরির জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কেমনে কেমনে চাকরিটা হয়ে গেল। প্রথম পোস্টিং হয়েছিল সুনামগঞ্জে। হাওড় এলাকায়। বাড়ি থেকে যেতে যেতেই দুইদিন লেগে যেত। একবছর পড়ে অনেক চেষ্টা তদবির করে মানিকগঞ্জে চলে এসেছি। তারপর থেকে মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলাতেই চাকরি করেছি। দূরে কোথাও যাই নাই। এখনও বাড়ি থেকেই অফিস করি। সেই ফজরের আযানের সময় উঠি। অত সকাল বেলাতেও আমার স্ত্রী আমার জন্য গরম ভাত রান্না করে দেন। গরম ভাত খেয়ে সাড়ে ছয়টা-সাতটার মধ্যে বাইসাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে আসি সাটুরিয়া বাজারে। সাটুরিয়া বাজারে পরিচিত এক দোকানের সামনে সাইকেলটা রেখে এক কাপ চা খেয়ে বাসে উঠে আসি মানিকগঞ্জ শহরের বাসস্ট্যান্ডে। বাসস্ট্যান্ড থেকে হেঁটে অথবা রিকশায় আসি অফিসে। যাওয়ার সময় একইভাবে বাড়িতে যাই।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, এরই মধ্যে বৃষ্টি থেমে গেছে। শেষ বিকেলের লালাভ এক টুকরো মিষ্টি রোদ পুকুরের জলে পড়ে কেমন চিকচিক করছে। নিজের অজান্তে আমার বুক ফুড়েও একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল। আমরা মানুষেরা কত দুর্বল!
অফিস থেকে বের হওয়ার জন্য আমি উঠে দাঁড়ালাম। ময়নাল হক খানকে জিজ্ঞেস করলাম,‘আজ বাড়িতে যাবেন না।’ ময়নাল সাহেব বললেন,‘জি স্যার, যেতে হবে’। কেমন মনমড়া হয়ে আমার রুম থেকে তিনি বেড়িয়ে গেলেন। আমিও ময়নাল হক খানের কথা চিন্তা করতে-করতে অফিস থেকে বের হলাম।
এরপর কত ঘটনা ঘটে গেছে। আমি একটা স্কলারশিপ নিয়ে লেখাপড়া করার জন্য এক বছরের জন্য প্রেষণে চলে গেলাম ইন্ডিয়ার হায়দ্রাবাদে। এক বছর পড় দেশে ফিরে আবার যোগদান করলাম মানিকগঞ্জ জেলা সমবায় অফিসে। যোগদান করে দেখি ময়নাল হক খান নেই। অফিসের লোকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, ময়নাল হক খানকে বদলি করা হয়েছে মাদারীপুর জেলা সমবায় অফিসে। তাঁর সরলতাকে দুর্বলভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট উপস্থাপন করে তারই সমপর্যায়ের দুষ্টু কয়েকজন কলিগ তাকে বদলি করিয়েছেন।
দেশে ফিরেছি জেনে একদিন মোবাইল ফোনে কল দিলেন ময়নাল হক খান। মোবাইল ফোনে কথা বলে যেটা বুঝলাম. আমি দেশে ছিলাম না, এই সময়ে জেলা অফিসে অনেক উল্টা-পাল্টা ঘটনা ঘটে গেছে। তাকে বিপদে ফেলে বদলি করা হয়েছে। ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমি আশ্বস্ত করলাম ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বলে আবার তাকে মানিকগঞ্জে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবো। আমার কথায় ময়নাল হক খান খুব খুশি হলেন।
এরই মধ্যে তিন বছর পূর্ণ হওয়ায় আমাকেও নতুন জেলা সমবায় অফিসের দায়িত্ব দিয়ে বদলি করা হলো সিরাজগঞ্জে। আমি চলে গেলাম সিরাজগঞ্জে। ময়নাল হক খান মোবাইল ফোনে প্রায়ই আমার খোঁজ খবর নেয়। আমি উপরের এক স্যারকে অনুরোধ করেছিলাম ময়নাল হক খানের বদলির বিষয়ে। স্যার, আমার অনুরোধ রেখেছেন। ময়নাল হক খানকে আবারও মানিকগঞ্জ জেলা সমবায় অফিসে বদলি করেছেন। সে এখন ভালো আছে।
ময়নাল হক খানের সাথে আগের মতো তেমন আর কথা হয় না। তবে প্রতি বছর দুই ঈদে সে নিয়ম করে আমাকে ফোন দেয়। ময়নাল হক খানের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে প্রতি ঈদেই সে আমাকে মোবাইল ফোনে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। এখন পর্যন্ত এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এভাবেই চলছিল।
এরপর অনেক সময় পাড় হয়ে গেছে। আমাকে পুনরায় সিরাজগঞ্জ থেকে বদলি করে একসাথে গাজীপুর ও টাঙ্গাইল জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ব্যস্ততা বেড়েছে। ময়নাল হক খানের সাথে অনেকদিন দেখা হয় না। তবে যথারীতি সে আমাকে ঈদের সময় ফোন করে। খোঁজখবর রাখে। একদিন বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো ময়নাল হক খানের সাথে। আমি সুযোগ দেওয়াতে সে আবারও তাঁর বর্তমান সময়ের কথার ঢালি খুলে বসলেন। তাঁর কথায় যেটা বুঝলাম সেটা হলো, এরই মধ্যে তাঁর প্রতিবন্ধী ছেলেটি শরীর স্বাস্থ্যে বেশ বড় হয়ে গিয়েছে। ছেলের অত্যাচারও দিনকে দিন বাড়ছিল। গ্রামের লোকজন তাকে বুদ্ধি দিল ছেলেকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য। ময়নাল হক খান গ্রামের লোকজনের কথায় গতবছর পাশের গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারের মেয়ের সাথে ছেলেকে বিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথম প্রথম মনে হচ্ছিল ভালোই হয়েছে। কিন্তু বছর খানেক যেতে না যেতেই সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। যে মেয়ের সাথে ছেলেকে বিয়ে দিয়েছিলেন, সেই মেয়েটি কাউকে কিছু না বলে একদিন তাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। কথা গুলো বলতে বলতে ময়নাল হক খানের গলা ভারী হয়ে উঠল। আমি হতবাক হয়ে গেলাম তাঁর কথা শুনে। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না! ময়নাল হক খানের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল।
এরপর বছর পাঁচেক কেটে গেছে। যথারীতি প্রতি ঈদে নিয়ম করে ময়নাল হক খানের ফোন পেয়েছি। কথা হয়েছে। শেষবারের কথা থেকে জানতে পেরেছি, ময়নাল হক খান চাকুরি শেষ করে অবসরে গিয়েছেন। এখন সার্বক্ষণিক বাড়িতেই থাকেন। কথার শেষে আমার কাছে দোয়া চেয়েছেন, আমিও তাঁর কাছে দোয়া চেয়েছি। তবে শেষ দিনের কথা থেকে বুঝতে পাড়লাম সংসার জীবনের জটিলতা, অপ্রাপ্তি, সহজ-সরল লোকটিকে ক্রমশই দুর্বল করে ফেলছে।
আমিও আমার সংসার জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। বদলি হয়ে ঢাকা জেলা সমবায় অফিসে এসেছি। ময়নাল হক খানকে একরকম ভুলেই গিয়েছি। সে যে গত ঈদে ফোন দেয়নি, সেটাও খেয়াল করিনি। আমিও তাকে ফোন দেইনি। বছর দুয়েক পরে কোন এক ঈদে হঠাৎ করে ব্যক্তিগত কোন এক ঘটনার কারণে ময়নাল হক খানের কথা খুব মনে পড়ে গেল। আমি ফোন উঠিয়ে ময়নাল হক খানের নম্বরে ডায়াল করলাম। নম্বরটি বন্ধ পেলাম। দুই-তিনবার চেষ্টা করলাম। মোবাইল সুইচ অফ পেলাম। হঠাৎ করে ময়নাল হক খানের জন্য খুব মন অস্থির হয়ে উঠল। আমি মানিকগঞ্জ জেলা সমবায় অফিসের ময়নাল হক খানের পরিচিত এক কলিগকে ফোন দিলাম। সে ফোন ধরল। আমি সরাসরি ময়নাল হক খানের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তাঁর কথা শুনে বুঝলাম। গত বছর ময়নাল হক খান হঠাৎ করে মারা গেছেন। শুনে খুব খারাপ লাগলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে কলিগের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে ফোন রেখে দিলাম।
বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। অনেক বছর আগের সেই বৃষ্টির দিনের কথা মনে পড়ে গেল। মানিকগঞ্জ অফিসে বসে ময়নাল হক খানের সাথে আলাপচাড়িতার সেই সুখ দুঃখের কথা মনে পড়ে গেল । নিজের অজান্তেই ময়নাল হক খানের পুরোটা জীবন ভেসে উঠল আমার কল্পনার চোখে। একজন সহজ-সরল লোকের জীবন উপাখ্যান যেন এক নিমিষেই দেখে ফেললাম। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। নিজের অজান্তেই একটি দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। তারপর মনে হলো এই পৃথিবীতে আমরা আসলে সবাইতো একেক জন একেক জনের মতো করে ময়নাল হক খানের চরিত্রে অভিনয় করছি।