somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিজ্ঞানের মিথ (পর্ব-১)

১৩ ই মে, ২০১৮ সকাল ১১:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘বিজ্ঞানের মিথ’ কথাটা শুনে যে কেউ একটু চমকে উঠতে পারেন। মানে কি? যে বিজ্ঞান আমাদের সমাজ থেকে, মন-মগজ থেকে গুজব, ভ্রান্ত বিশ্বাস কিংবা কুসংস্কারকে ঝাঁটা দিয়ে বিদায় করে, সেই বিজ্ঞানের ভেতরেই কি তাহলে গুজব কিংবা মিথ আছে? সর্ষের ভেতরেই কি তাহলে ভূত?
ব্যাপারটা ঠিক তা না। বিজ্ঞানের অনেক কাহিনি মানুষের মুখে মুখে সময়ের ব্যবধানে অতিরঞ্জিত হয়েছিল। আংশিক সত্য সেই কাহিনিগুলোর আসল রূপটি জানার জন্যই এই নিবন্ধ। তাই এ নিবন্ধের নামটিও দিলাম বিজ্ঞানের মিথ। চলুন জেনে নেওয়া যাক বিজ্ঞানের কয়টি প্রচলিত বিখ্যাত গুজবের কথা।

নিউটনের আপেল

বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনকে আজকের এই বিজ্ঞানের যুগে কেনা চেনে বলুন? অন্তত তাঁর আবিষ্কৃত গতির তিনটি সূত্র কিংবা মহাকর্ষের সূত্র কিংবা ক্যালকুলাস ঠিকমত না জানলেও তাঁর মাথায় আপেল পতনের নাটকীয় গল্পটির কথা মোটামুটি সবাই জানে। কিন্তু আপেল পতনের ওই বিখ্যাত ঘটনাটি বিজ্ঞানের খুব কমন একটি মিথ। প্রচলিত গল্পটি হল- মহাবিজ্ঞানী নিউটন একদিন কোনও এক আপেল গাছের নীচে আনমনা হয়ে কোনোকিছু নিয়ে ভাবছিলেন। হঠাত ওই সময় তাঁর মাথায় টুপ করে একটা আপেল পড়ল। পতিত আপেলটার দিকে তাকাতেই তাঁর বুদ্ধিমান মগজে প্রশ্ন জেগে উঠল, আপেলটা মাটিতে না পড়ে উপরে গেলনা কেন? ভাবতে ভাবতে মহাবিজ্ঞানীর মাথায় হঠাৎ উত্তরটা বিজলীর মত ঝলক দিয়ে উঠল! তিনি অনুধাবন করলেন আমাদের পৃথিবীটা কোনও এক অদৃশ্য আকর্ষণ বল দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত বস্তুরাজি ও প্রাণীজগতকে বেঁধে রেখেছে। এই অদৃশ্য বলই হচ্ছে মধ্যাকর্ষণ বল এবং এই মধ্যাকর্ষণ বলকে তিনি একটি সূত্রে আবদ্ধ করেন।
কিন্তু প্রকৃত ঘটনাটা অন্যরকম। ১৬৬৪ সালে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় তাঁদেরকে ক্লাসে ন্যাচারাল ফিলোসফি সম্পর্কে পড়ানো হচ্ছিল। তাদের আলোচনায় স্থান পাচ্ছিল কেন কোনও বস্তু ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়। কিন্তু এক বছর পর ইংল্যান্ডে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান কর্মসূচি বন্ধ করে দেওয়া হয়। নিউটনের বয়স ছিল তখন মাত্র ২৩ বছর। নিউটন তখন বাড়িতে ফিরে আসেন। বাড়িতে আসার পর থেকেই ভাবুক নিউটন বস্তুর ভূপৃষ্ঠে পতনের কারণ কি হতে পারে তার একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্ঠা করছিলেন। মূলত সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত মানুষ এরিস্টটলের গাঁজাখুরি তত্ত্বে বিশ্বাস করে আসছিলেন। মধ্যাকর্ষণের কারণ দর্শাতে গিয়ে এরিস্টটল মতবাদ ব্যক্ত করেছিলেন যে, বস্তুর স্বভাবসুলভ ধর্মই হচ্ছে নীচের দিকে পতিত হওয়া। কারণ, ঈশ্বর পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুকেই নাকি সৃষ্টির সময় পৃথিবীর সাথে যুক্ত থাকার আদেশ দিয়ে তৈরি করেছিলেন। আর তাই কোনও বস্তুকে আপনি উপরের দিকে ছুঁড়ে মারলেও সে তার স্বভাব অনুযায়ী তার নিজভূমিতে ফিরে আসে। আর যত পৃথিবীর দিকে সে আগ্রসর হয় ততই পৃথিবীর প্রতি তার আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়, আর সেজন্যই নাকি তার গতিও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়!
যাই হোক, চিন্তিত নিউটন একদিন দেখতে পেলেন যে গাছ থেকে একটি আপেল নীচে পড়ল। সেটা দেখে তিনি নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকলেন যে, আপেলটা তো ডানেও যেতে পারত, বামে কিংবা উপরেও যেতে পারত। কিন্তু সর্বদাই নীচে কেন? অতপর তাঁর মাথায় ধারনাটি খেলে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন যে পৃথিবী ও ওই আপেলটির মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও আকর্ষণ বল কাজ করছে। ওই আকর্ষণ বলের ধারণা নিয়ে তিনি আরও ব্যাপকভাবে চিন্তা করেন এবং অবশেষে মতবাদ দেন যে, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুই একে অপরকে আকর্ষণ করছে। এই আকর্ষণ বলের নাম দেন তিনি মহাকর্ষ বল। ১৬৮৭ সালে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ফিলোসোফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সপিয়া ম্যাথম্যাটিকা’ গ্রন্থে তিনি মহাকর্ষ সূত্র প্রকাশ করেন।

পেন্সিল মিথ

আমরা ছোটকাল থেকে যে কাঠপেন্সিল ব্যবহার করে আসছি সেটা কি দিয়ে বানানো হয় জানেন কি? হয়ত অনেকে ঝটপট জবাব দিয়ে বসবেন- লীড বা সীসা দিয়ে। কারণ আমরা যে পেন্সিল দিয়ে লেখি বা আঁকি তা লীড পেন্সিল হিসেবেই খ্যাত। কাঠপেন্সিল কি দিয়ে বানানো হয় সেটা নিয়ে আমার প্রায়ই একটা খটকা লাগত। ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি ওটাকে লীড বা সীসার পেন্সিল বলে। ভাবতাম পেন্সিলের কোর, মানে যে অংশটা দিয়ে খাতায় আঁকি সেই মূল অংশটা বোধহয় সীসার তৈরি। হয়ত প্রসেসিং করে সীসাকে কয়লার মত শক্ত বানিয়ে সরু সিলিন্ডার আকৃতি দেওয়া হয়। একসময় জানলাম পেন্সিল তৈরি হয় গ্রাফাইট দিয়ে। কিন্তু প্রায়ই যখন নানা আর্টিকেলে বা বইয়ে লীড পেন্সিল শব্দটা পেতাম, মনের মধ্যে প্রশ্নটা নাড়া দিয়ে উঠত- এটাকে লীড পেন্সিল কেন বলে? ধন্দায় পড়ে গেলাম। নেটে কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাটি করে কনফিউশন দূর হল। লীড পেন্সিল মূলত একটি ভূল নাম। ষোলশ শতকে কোনও এককালে ইংল্যান্ডের একটি স্থানে যখন বিশুদ্ধ গ্রাফাইটের খনি আবিষ্কৃত হয়, তখন তৎকালীন কেমিস্টরা একে সীসার অন্য একটি রূপ ভেবে ভূল করেন। কার্বন যেমন কয়লা গঠন করে, তেমনি ওই একই কার্বন গঠনের ভিন্নতার কারণে হীরাও গঠন করে। কেমিস্টরা প্রাপ্ত গ্রাফাইটকে ভিন্ন গঠনের সীসা ভেবে ভূল করলেন। সেই লীড নামক গ্রাফাইট দিয়ে যখন একসময় আঁকাজোখার কাজও শুরু হয়ে গেল, তখন কোনও একসময় সেটাকে গ্রাফাইট হিসেবে আলাদা করলেও আঁকাআঁকির দন্ডটা লীডের দন্ড হিসেবেই মানুষের কাছে বিবেচিত হয়ে আসতে লাগল। পেন্সিলের এই কাহিনিটি আজও একটা মিথ হিসেবে চালু আছে। মূলতঃ পেন্সিলের দন্ডটি গ্রাফাইট ও মাটি মিশিয়ে তৈরি করা হয়। এটি এমন এক ধরণের পদার্থ যা দিয়ে লিখলে তা শুকায় না এবং রাবার দিয়ে সহজে ঘষে তুলে ফেলা যায়। তাছাড়া এটি পরিবেশবান্ধবও।

গ্যালিলিওর পরীক্ষা

একটি ভারী বস্তু ও একটি হালকা বস্তুকে উপর থেকে একসাথে নীচে ফেললে কোনটি আগে মাটিতে পড়বে- এমন প্রশ্নের জবাবে আদিকাল থেকেই মানুষের ধারণা ছিল যে, ভারী বস্তুটিই আগে মাটিতে পড়বে (বর্তমানেও অনেকে হয়ত এটাই বিশ্বাস করেন)। আর এর মূলকারণ হচ্ছে আমরা যা বলি কিংবা বিশ্বাস করি, তার বেশীরভাগই আমরা পরীক্ষা বা সত্যতা যাচাই করে দেখিনা। পরীক্ষাহীন চিন্তানির্ভর যুক্তিতে এরিস্তটলীয় মতবাদে আদিকালে সবাই এমনটাই বিশ্বাস করতেন। কিন্তু সবাই তো আর গোঁড়ামি শুনে বসে থাকেনা। যুগে যুগে মেধাবীদের জন্ম হয়। তারা প্রশ্ন করে, উত্তর খুঁজে এবং পুরাতন ভ্রান্ত বিশ্বাস কিংবা অবৈজ্ঞানিক যুক্তিকে পরিহার করে নতুন নতুন যৌক্তিক উত্তর প্রদান করে পাল্টে দিয়ে যান মানবসভ্যতাকে। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলির পড়ন্তবস্তুর সূত্রাবলী প্রদান। ১৫৬৪ সালে ইতালীতে জন্মগ্রহণকারী বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি ছিলেন একজন গণিতবিদ, পদার্থবিদ, দার্শনিক ও আকাশ পর্যবেক্ষক। ভারী বস্তু আগে পড়বে এমন বিশ্বাস নিয়ে বসে থাকেন নি গ্যালিলিও। প্রচলিত গল্প অনুযায়ী, গ্যালিলিও পিসা শহরের ১৮০ ফুট উঁচু একটি হেলানো টাওয়ার থেকে অনেকগুলো ছোটবড়, হালকা,ভারী বস্তু একসাথে মাটিতে ফেলে দেন এবং লক্ষ করেন যে এরা প্রায় একইসাথে মাটিতে পড়ে। যাও সামান্য সময়ের ব্যবধান থাকে, তা মূলত বায়ুর বাধার কারণে। গ্যালিলিওর তত্ত্বানুযায়ী, বায়ুর বাধা উপেক্ষা করলে সকল পড়ন্ত বস্তু একসাথে একই সময়ে মাটিতে পড়বে। আর এই পড়ন্ত বস্তু নিয়েই তিনি পরে তিনটি সূত্র প্রদান করেন, যা গ্যালিলিওর পড়ন্ত সূত্রাবলী হিসেবে খ্যাত। কিন্তু পরে জানা যায় যে, গ্যালিলিওর হেলানো টাওয়ারের পরীক্ষার কথা গ্যালিলিও নিজে কোথাও সরাসরি উল্লেখ করেন নি। বরং তাঁর এক ছাত্র, যার নাম ছিল ভিনসেন্ট ভিভিয়ান, সেই গ্যালিলিওর এই পরীক্ষার কথা দাবি করেন। তবে এটা সত্যি যে, বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি একটি ঢালু রাস্তার উপর অনেকগুলো ছোট,বড় গোলাকার বস্তু গড়িয়ে দিয়ে এমন একটি পরীক্ষা করছিলেন। কোনও টাওয়ার থেকে কিংবা উঁচু দালান থেকে এই পরীক্ষাটি তিনি করেছিলেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। (চলবে)

সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৮ সকাল ১১:০৯
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×