somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টাইম ট্র্যাভেল

০৬ ই জুন, ২০১৮ দুপুর ১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘ইস আমি যদি আমার ভবিষ্যত দেখে ফেলতে পারতাম!’ ‘ইস আমি যদি একবার আগের সময়ে ফিরে যেতে পারতাম, তাহলে অমুক অমুক ভুলগুলোকে আমি সবার আগে সংশোধন করতাম!’ – এ ধরণের আফসোস বাক্য কেউ শোনেনি বা নিজে কখনও করেনি, এমন মানুষ ইতিহাসেও খোঁজে পাওয়া বিরল!
আমরা সবাই জীবনে কখনও না কখনও কল্পনার ডানায় ভর করে অতীতের ভুলগুলোকে অতীতে গিয়ে হাজারবার হাজাররকম কায়দায় মনের সাধ মিটিয়ে সংশোধন করার আনন্দ নিয়েছি। কিংবা ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে একসময় উদভ্রান্তের মত ভেবেছি যে, যদি কোনোভাবে নিজের ভবিষ্যতটা একবার দেখে ফেলতে পারতাম! কিন্তু প্রকৃতির নিয়মগুলো তো আর আপনার আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছায় পরিচালিত হয়না। সে চলে তার নিজের মত করে। তাই আদিকাল থেকে মানুষের অতীত, ভবিষ্যত ভ্রমণ করার মত স্বপ্নবিলাস এখনও স্বপ্নই রয়ে গেছে। মানুষের এই অতীত শোধরানোর আফসোস, অতীতের হারানো স্মৃতিমধুর মুহুর্তগুলো ফিরে পাবার তীব্র ইচ্ছা কিংবা ভবিষ্যৎ দেখার আকাংক্ষা, এই সব আবেগ থেকেই সময় ভ্রমণ বা টাইম ট্র্যাভেলের চিন্তা মাথায় এসেছিল, যা পরবর্তিতে স্থান পায় সাহিত্যে, শিল্পে, সিনেমায়। এসব সিনেমা দেখে টাইম ট্র্যাভেলের ব্যাপারে মানুষ হয়েছে আরও বেশী কৌতূহলী!

কিন্তু বিজ্ঞানীরা প্রথম প্রথম বরাবরই এসব কাল্পনিক বিজ্ঞানকে স্রেফ হাস্যকর কল্পনা বা অপবিজ্ঞান হিসেবেই উড়িয়ে দিতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে টাইম ট্র্যাভেল ব্যাপারটা সিরিয়াসলি বিজ্ঞানীদের আলোচনা মহলে ঢুকে পড়ল। বিশেষ করে যখন কালজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর পৃথিবী কাঁপানো তত্ত্ব আপেক্ষিকতা প্রকাশ করলেন। দেখা গেল, আপেক্ষিক তত্ত্বানুসারে আমরা মহাশূন্যে ভ্রমন করতে গেলে এক অর্থে সময় ভ্রমণেই বের হই। কারণ, পৃথিবী থেকে প্রচন্ডবেগে মহাশূন্যে রওনা দেওয়া রকেটের ঘড়ি আর পৃথিবীর ঘড়ির মধ্যে কিছুটা হলেও সময়ের ব্যবধান তৈরি হয়। পৃথিবীতে অভিকর্ষের প্রভাবে আমাদের ঘড়ি যে গতিতে চলে, মহাশূন্যে উচ্চবেগে গতিশীল রকেটের ভেতরে থাকা ঘড়ি এর থেকে সামান্য স্লো হয়ে যায়। এই ব্যাপারটা পদার্থবিজ্ঞানের হিসেবের ভেতরে আসার পরপরই বিজ্ঞানীরা সময়ের পার্থক্য তৈরি নিয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। যদি স্থান বিশেষে সময়ের পার্থক্য তৈরি হয়, আর সেই দুই ভিন্ন সময়বিশিষ্ট স্থানের মধ্যে যদি শর্টকার্ট সংযোগ তৈরি করা যায় তাহলেই হয়তো সম্ভব হবে টাইম ট্র্যাভেল করা।

টাইম ট্র্যাভেল বা সময় ভ্রমন করার আগে আমাদের আগে জানা উচিত ‘সময়’ বলতে আসলে কি বুঝায়?
সময় ব্যাপারটা কি তার সঠিক সংজ্ঞা আসলে আজও মানুষ জানেনা। সাধারণত আমরা সময় বলতে বুঝি পরিবর্তন। কোনও ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় মানেই সময় বয়ে চলা। যেমন- আপনি এখন একটি চেয়ারে বসে আছেন। এবার আপনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অন্য রুমে চলে গেলেন। এই যে আপনি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় হেঁটে গেলেন, এতে আপনার অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। অবস্থানের যখন পরিবর্তন হয়েছে, তখন ঘড়িতে দেখবেন সময়েরও পরিবর্তন হয়েছে। তারমানে সময় বলতে সাধারণত আমরা বুঝি মহাবিশ্বের ঘটনাসমুহের পরিবর্তনের কারণ। আমাদের সাধারণ জ্ঞান অনুসারে সময়ের তীর একমুখী। অর্থাৎ সময় স্রেফ সামনের দিকে যায়, কিন্তু পেছনের দিকে আসেনা। এর কারণ তাপগতিবিদ্যার সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়। আমরা জানি সমস্ত কাজের পেছনে শক্তি খরচ হয়। আর সমস্ত শক্তির উৎসই হল তাপশক্তি।

তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রানুসারে, তাপ শীতলতম বস্তু হতে কখনোই উচ্চতাপমাত্রা বিশিষ্ট বস্তুর দিকে প্রবাহিত হবেনা। এর বাস্তব উদাহরণ হল আমাদের সূর্য থেকে পৃথিবীতে তাপ আসার ঘটনা।

পৃথিবীর তাপমাত্রা সূর্য থেকে অনেক কম বলেই পৃথিবী সূর্য থেকে তাপ গ্রহণ করে। আর পৃথিবীতে তাপ আসার ফলেই জীবন বজায় থাকে। বজায় থাকে সমস্ত কাজ। তাপ শক্তিকে উদ্ভিদ কাজে লাগিয়ে নিজে বেঁচে থাকে এবং আমাদের অক্সিজেন দেয়। আমরা অক্সিজেন গ্রহণ করে বেঁচে থাকি। সমস্ত প্রাণিই আলোক শক্তির উপর নির্ভরশীল। আলোকশক্তিকে আবার নানান শক্তিতে রূপান্তরিত করে অন্যান্য কার্য সম্পাদন করা হয়। যেমন আমরা পৃথিবীতে উৎপন্ন শস্য, ফলমূল বা মাছ-মাংস ইত্যাদি খেয়ে শরীরে শক্তি সঞ্চয় করি। সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা সারাদিন নানা কাজ সম্পাদন করি। আবার আলোকশক্তি নদী, সমুদ্র ইত্যাদিতে গতিশক্তি হিসেবে রূপান্তরিত হয়ে সেখানে জলের গতি ও জলজ প্রাণীদের জীবন বজায় রাখে। অর্থাৎ পৃথিবীতে আমরা যত কার্য সম্পাদন করি, তার মূল উৎস হচ্ছে আলোকশক্তি, যা সূর্য থেকে আসে। আর আমরা স্রেফ শক্তিকে অন্য শক্তিতে রূপান্তর করি মাত্র।
যেমন- আমরা যখন কথা বলি তখন শব্দ শক্তির উৎপন্ন হয়। এই শব্দ শক্তি আসে কোথা থেকে? আমাদের শরীরে সঞ্চিত খাদ্যশক্তি রূপান্তরিত হয়েই শব্দ শক্তি উৎপন্ন করে। এখন, যেহেতু তাপ কখনোই উলটোপথে যায়না, অর্থাৎ শীতল বস্তু থেকে তাপ কখনোই গরম বস্তুর দিকে প্রবাহিত হয়না, তাই অন্য অর্থে একে বলা যায়, সময় কখনোই উলটোপথে যায়না।

ভেবে দেখুন, মহাবিশ্বের সমস্ত কাজের পেছনে দায়ী তাপশক্তি। আর কাজ সম্পন্ন হওয়া মানেই সময়ের পরিবর্তন হওয়া। যেহেতু তাপ উলটো দিকে যায়না, তারমানে সময়ও উলটো দিকে যায়না। যেমন আপনার হাত থেকে একটি সিরামিকের পাত্র পড়ে যদি ভেঙে যায়, বলা যায় এখানে একটি কাজ সংঘটিত হয়েছে বা ঘটনা ঘটেছে। এখন এই সিরামিকে পাত্র কি কখনও আবার উল্টোপথে যাত্রা করবে? পাত্রটা কি নিজে নিজে আবার জোড়া লেগে আবার আপনার হাতে চলে আসবে? নাহ। তারমানে এখানে একটি কাজ সম্পাদিত হয়েছে এবং সেই কাজের পেছনে গতিশক্তি ব্যয় হয়েছে। কোনও কাজই যেহেতু উলটোপথে যায়না, তাই বলা যায় কাজের উৎস তাপও উলটোপথে যায়না। কারণ, সময় উলটোপথে যায় না। তারমানে সময় বলতে আমরা ধরে নিতে পারি তাপের একমুখীতা।

এই যে সমস্ত মহাবিশ্বে তাপের আদান-প্রদান হচ্ছে, কাজ সংঘটিত হচ্ছে, এতে কিন্তু পুরো মহাবিশ্বটাই একটা পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মহাবিশ্বে যত বেশী কাজ হচ্ছে, তত বেশি আণবিক বিশৃংখলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন- আপনি আপনার গাড়িতে জ্বালানী তেল ঢুকিয়ে গাড়ি চালালেন। গাড়ির তেল কিন্তু পুড়ে বাতাসে বের হয়ে বিশৃংখলার সৃষ্টি করছে। তারমানে যতবেশি কাজ হবে, আণবিক বিশৃংখলা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বিশৃংখলা বৃদ্ধি পাওয়াকেই বলে এনট্রপি। কিংবা এনট্রপির সংজ্ঞাকে এভাবে দেওয়া যায় যে, তাপশক্তির একদিকে প্রবাহিত হয়ে অনবরত কাজ সম্পাদন করা এবং বিশৃংখলার সৃষ্টি করা। কিন্তু একটা সময় আসবে যখন পুরো মহাবিশ্বে তাপের আদান-প্রদান বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, তখন সব বস্তুর তাপমাত্রা সমান সমান হয়ে যাবে। আর যখনই পুরো মহাবিশ্বে তাপমাত্রার সাম্যাবস্থ্যা বিরাজ করবে, তখনই তাপের আদান-প্রদান বন্ধ হয়ে যাবে। আর তাপের আদান-প্রদান বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে মহাবিশ্বের সমস্ত কাজ থেমে যাওয়া, এনট্রপির শূন্যের কোঠায় নেমে আসা। অর্থাৎ পুরো মহাবিশ্ব স্থির হয়ে যাবে। মানে সময় থেমে যাবে! একে বলা হবে মহাবিশ্বের তাপীয় মৃত্যু!

এতক্ষণ যে সময় নিয়ে আলোচনা করলাম, একে বলা হয় তাপীয় সময় বা সময়ের তাপগতীয় তীর। এই তীর সর্বদা সম্মুখ বরাবর থাকে। তাপীয় সময় অনুসারে আমরা দেখলাম যে, সময় কখনও উল্টো দিকে প্রবাহিত হয়না। তাই মানুষের মস্তিষ্কে স্রেফ অতীতের ঘটনাবলী মনে রাখতে পারে। আর যা এখনও ঘটেনি মানে ভবিষ্যতে যা ঘটবে, তা মানুষের স্মৃতিতেই আসেনা। সেজন্যই মানুষের মনে সময়ের যে তীর রয়েছে, তাও সম্মুখ বরাবর। অর্থাৎ তাপীয় সময়ের ফলে উদ্ভূত মনস্তাত্ত্বিক সময়ের তীরও কিন্তু সম্মুখ বরাবর। সেকারণে বলা যায়, মানুষের পক্ষে সময়ের উল্টো দিকে, মানে অতীতে ভ্রমন করা সম্ভব নয়।
কিন্তু ভবিষ্যতের ব্যাপারেও কি একই কথা বলা যায়?
সাধারণত, আমরা যে টাইমমেশিনের কথা জানি সিনেমা দেখে বা গল্প-উপন্যাস পড়ে, ওই ধরণের টাইম মেশিন আসলে এককথায় রীতিমত অসম্ভব কিংবা হাস্যকর। আমরা টাইম ট্র্যাভেল নিয়ে অনেক সিনেমাই দেখেছি। যেমন- এইচ জি ওয়েলসের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘টাইম মেশিন’, স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘ব্যাক টু দ্য ফিউচার’ কিংবা টেরি গিলিয়াম পরিচালিত ‘টুয়েলভ মাঙ্কি’ ইত্যাদি। এই ধরণের টাইম মেশিন দ্বারা টাইম ট্র্যাভেল সম্ভব হলে এমন সব প্রশ্নের সমস্যার জন্ম দেবে, যার সমাধান নিয়ে ভাবতে গেলে আপনার আমার মাথা পুরোটাই গুলিয়ে যাবে!
যে সমস্ত সমস্যা সৃষ্টি হবে সেগুলো মূলত স্ববিরোধী সমস্যা, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় প্যারাডক্স। প্যারাডক্স মানে হল, যেখানে একটা ঘটনা ঘটানো সম্ভব হলে আরেকটা ঘটনা ঘটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। টাইম ট্র্যাভেল নিয়ে কি কি প্যারাডক্স সৃষ্টি হতে পারে, চলুন একবার আলোচনা করা যাক। এরপরে আমরা আলোচনা করব সময় বলতে আসলে কি বুঝায় বা সময়ের তীর নিয়ে। তা নিয়ে। নানা সময়ে সৃষ্টি হওয়া নানা উপন্যাস বা বিজ্ঞানীদের উথাপন করা প্রশ্ন নিয়ে আমরা প্যারাডক্সগুলো আলোচনা করব।

অতীত ভ্রমন নিয়ে প্রথমেই যে বিখ্যাত সমস্যাটা সবার আগে আসে, সেটা হল গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স। টাইম মেশিন দিয়ে অতীতে গিয়ে যদি আপনি আপনার দাদাকে মেরে ফেলেন আপনার দাদীর সাথে তার বিয়ে হওয়ার আগেই, তাহলে তো আর আপনার বাবার জন্ম আর হচ্ছেনা। আর আপনার বাবার জন্ম না হলে আপনার জন্মও কিন্তু আর হচ্ছে না। এমতাবস্থায় আপনার কি হবে? আপনি কি সাথে সাথে পৃথিবী থেকে শূন্যে মিলিয়ে যাবেন? কিংবা দাদাকে না মেরে আপনার বাবাকেও যদি মেরে ফেলেন আপনাকে জন্ম দেবার আগেই, তাহলেও কিন্তু একই সমস্যার সৃষ্টি হয়। এই সমস্যার সমাধান কি? বিজ্ঞানীরা সাধারণত এই ধরণের প্রশ্নের কয়েকটি তাত্ত্বিক উত্তর দিয়ে থাকেন। যেমন, প্রথমত এই সমস্যার সমাধানটি এরূপ হবে যে, আপনি অতীত ভ্রমণ করতে পারবেন ঠিকই, কিন্তু আপনি অতীত বদলাতে পারবেন না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আপনি টাইম মেশিন দিয়ে অতীতে গিয়ে আপনার দাদাকে মারতে চাইলেও আপনি তা পারবেন না। কোনও না কোনোভাবে আপনার দাদা বেঁচে থাকবে ঠিকই। অথবা আপনি যে অস্ত্র দিয়ে মারতে চাইবেন, সেই অস্ত্র ওই সময় কাজ করবে না। তবে এই উত্তরটা খুব একটা জোরালো নয়।
তারচেয়ে আরও ভালো একটি উত্তর দেওয়া হয় প্যারালাল ইউনিভার্স থিওরির মাধ্যমে। প্যারালাল ইউনিভার্স বা সমান্তরাল মহাবিশ্ব তত্ত্বানুসারে, আমাদের মহাবিশ্বের মত আরও অসংখ্য মহাবিশ্ব আছে। সেখানে অনেকগুলো মহাবিশ্ব হয়তো হুবহু আমাদের মতই ক্লোন কপি। ওখানেও হয়তো আরেকজন আমি কম্পিউটারের সামনে বসে এই লেখাটা খট খট করে কী চেপে লিখে যাচ্ছে। ভাবলে যদিও মাথাটা গুলিয়ে যায়, তবুও এই তত্ত্বটি কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুযায়ী খুবই যৌক্তিক ও জনপ্রিয়।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে এই তত্ত্বের ব্যাখ্যা হল, অসীম শক্তি ও ঘনত্ব বিশিষ্ট একটি বিন্দু থেকে বৃহৎ বিস্ফোরণের মাধ্যমে আমাদের মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বিগ-ব্যাং যে স্রেফ একবারই সংঘটিত হয়েছে, তা না। এরকম বৃহৎ বিস্ফোরণ ক্রমশ ঘটে চলেছে। মহাশূন্যে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন তত্ত্ব অনুযায়ী প্রতিনিয়ত পজিটিভ ও নেগেটিভ শক্তির মিলনে কোয়ান্টাম বুদবুদ তৈরি হচ্ছে। এই বুদবুদ অনেকটা স্যুপ বাবলের মত। দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই শক্তির বুদবুদ থেকে বৃহৎ বিস্ফোরণ হয়। এভাবে অসংখ্য বিগ-ব্যাং প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে, নতুন নতুন মহাবিশ্বের উৎপত্তিও ঘটে চলেছে। এই সব মহাবিশ্বের অনেকগুলো হয়তো হুবহু আমাদের ফিজিক্সের নিয়ম অনুযায়ী তৈরি হচ্ছে, যেখানে হুবহু আমাদের মত সৌরজগৎ ও পৃথিবী তৈরি হচ্ছে। এই হুবহু আমাদের মত আরও মহাবিশ্ব ও পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকার কথা বলা হচ্ছে, এটাই হচ্ছে সমান্তরাল মহাবিশ্ব তত্ত্ব বা প্যারালাল ইউনিভার্স থিওরি।
এখন, গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স সমস্যার একটি যৌক্তিক উত্তর দেওয়া হয় এই প্যারালাল থিওরি দিয়ে। প্যারালাল থিওরি অনুসারে আপনি টাইমমেশিনে চড়ে যে অতীতের পৃথিবীতে যাবেন, ওটা আপনার পৃথিবী নয়। আপনি যাবেন অন্য মহাবিশ্বের হুবহু অন্য পৃথিবীতে। আপনি আপনার দাদাকে মারলেও উনি আসলে আপনার দাদা নন, বরং আপনার দাদার ক্লোন কপি। আপনি ওই দাদাকে মেরে ফেললেও আপনার পৃথিবীর মধ্যে এই ঘটনার কোনও প্রভাব তৈরি হবেনা। স্রেফ যে পৃথিবীতে আপনি আপনার দাদাকে মেরেছেন ওই পৃথিবীর উপর প্রভাব পড়বে এবং ওই পৃথিবীতে আর আপনার কোনও ক্লোন কপির জন্ম হবেনা। অর্থাৎ আপনি স্রেফ অতীতে গিয়ে নতুন একটি টাইমলাইনের জন্ম দিচ্ছেন।
ব্যাপারটা অনেকটু সহজ করে বলা যাক। ধরুন, গতকাল আপনি ফেসবুকে এমন একটি মারাত্মক স্ট্যাটাস দিয়েছেন যে ২৪ ঘন্টার মধ্যে এই স্ট্যাটাস নিয়ে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হল আপনাকে নিয়ে। এখন আপনি ভয় পেয়ে স্ট্যাটাস আপনার টাইমলাইন থেকে ডিলিট মেরে দিলেন। কিন্তু প্রতিক্রিয়া তো আর ডিলিট করতে পারবেন না, যেহেতু সবাই পড়ে ফেলেছে আপনার স্ট্যাটাস। এমতাবস্থায় আপনি ঠিক করলেন টাইম মেশিনে চড়ে আপনি ২৪ ঘন্টা পেছনে চলে যাবেন এবং ওই স্ট্যাটাস লিখা থেকে গতকালকের আপনিকে আপনি নিবৃত্ত করবেন। আপনি টাইম মেশিন দিয়ে পেছনে গেলেন। গিয়ে ওখানে দেখলেন কম্পিউটারের সামনে বসা হুবহু আপনার মতই আরেকজন বসা। তাকে আপনি কোনোভাবে ওই স্ট্যাটাস লিখা থেকে আটকালেন। কিন্তু ভবিষ্যতে এসে দেখবেন আপনার পৃথিবীতে আপনার ফেসবুক আইডিতে আগের স্ট্যাটাসটি ঠিকই রয়ে গেছে এবং সেটা নিয়ে মানুষের মধ্যে খুব বেশি বিতর্ক চলছে। তারমানে দাঁড়ালো আপনি অন্য পৃথিবীতে গিয়ে অন্য একটি ফেসবুক আইডির স্ট্যাটাস পরিবর্তন করে এসেছেন। ওটা আপনার আইডি বা আপনার পৃথিবী ছিলনা। বরং আপনি ওই পৃথিবীর একটি ঘটনার পরিবর্তন করে ওখানে সময়ের স্রোতধারা অন্যদিকে প্রবাহিত করে এসেছেন। এভাবে প্যারালাল ইউনিভার্স তত্ত্ব দিয়ে গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স সমস্যার সমাধান দেওয়া যায়। তবে এই হিসেব অনুযায়ী বলা যায়, আপনি অন্য পৃথিবীর অতীত ভ্রমণ করেছেন, আপনার পৃথিবীর নয়। অর্থাৎ টাইম ট্র্যাভেল আপনি করছেন অন্য পৃথিবীর অতীত ও ভবিষ্যতে। সে হিসেবে এটাকে কি পুরোপুরি টাইম ট্র্যাভেল বলা যায়?

টাইম ট্র্যাভেল নিয়ে আরেকতি বিখ্যাত প্যারাডক্স হল- সেক্সুয়াল প্যারাডক্স। এটি বিখ্যাত একটি সায়েন্স ফিকশন গল্প থেকে নেওয়া। এ গল্প অবলম্বনে ইতোমধ্যে ‘প্রিডেস্টিনেশন’ নামক একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। এ সমস্যাটা হল- ধরুণ, একজন বিজ্ঞানী টাইম মেশিন তৈরি করতে করতে বৃদ্ধ হয়ে গেল। টাইম মেশিন তৈরি করার পর সে নিজের শরীরে ট্রান্সসেক্সুয়াল সার্জারি করিয়ে নিজের লিঙ্গ পরিবর্তন করে মেয়েতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। স্রেফ লিঙ্গ পরিবর্তনই নয়, চামড়ায়ও প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে চামড়া পরিবর্তন করে রীতিমত ২০-২৫ বছরের তরুণীতে পরিণত হল। এখন সেই তরুনী টাইম মেশিনে চড়ে তার অতীতে চলে গেল। সেখানে গিয়ে দেখল তার পুরুষ ভার্সন এখনও টাইমমেশিন তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এবার সে তার পুরুষ ভার্সনের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলল। অতঃপর একসময় তাদের বিয়ে হয়ে গেল। তারমানে, এখানে টাইম মেশিনের আবিষ্কারক নিজেই নিজেকে বিয়ে করেছে। এবার তাদের হুবহু ডিএনএ নিয়ে জন্মালো তাদের সন্তান। এবার? দেখা যাচ্ছে, একজন মানুষই তার পরিবারের সব সদস্য। সে নিজেই স্বামী, নিজেই স্ত্রী, নিজেই সন্তান। এর সমাধান কি? এক্ষেত্রেও পূর্বোল্লেখিত প্যারালাল ইউনিভার্স থিওরি দিয়ে এর সমাধান দিতে হবে। অর্থাৎ ওই তরুণী বিজ্ঞানী অতীতে গেলেও সে অন্য পৃথিবীতে গিয়েছে, তার পৃথিবীতে নয়।

তবু অতীত ভ্রমন নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। সেটা হল- একজন মানুষ টাইমমেশিনে করে কী প্যারালাল পৃথিবীর অতীতের যেকোনো সময়ে চলে যেতে পারবে? যদি অতীতের যেকোনো সময়ে যাওয়া যায়, তাহলে একটা সমস্যা রয়েছে। ধরুন, অতীত ভ্রমন করতে গিয়ে কেউ পৃথিবীর জন্মলগ্নে, মানে ৪৫০ কোটি বছর আগের পৃথিবীতে চলে গেল, যখন পুরো পৃথিবীটাই একটি উত্তপ্ত অগ্নিগোলক! যেখানে এখনও প্রাণ সৃষ্টি হওয়া তো দূরের কথা, প্রাণ সৃষ্টি হওয়ার কথাও ভাবা যায়না। যেখানে বায়ুমণ্ডলও তৈরি হয়নি। চারিদিকে উত্তপ্ত, বিষাক্ত পরিবেশ। ওই অবস্থায় টাইম মেশিন নিয়ে অবতরন করা মাত্রই আপনি ও আপনার টাইম মেশিন, দুটোই গলে একেবারে লাভার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। তারমানে অতীতে গেলে আটকে পড়ার বা মারা যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকবে। আপনি ইচ্ছেমত গেলেও ইচ্ছেমত কিন্তু ফিরে আসতে পারবেন না।

এবার আসি ভবিষ্যৎ ভ্রমণের প্যারাডক্স প্রসঙ্গে।

ধরুন আপনি টাইম মেশিনে চেপে ভবিষ্যতে গিয়ে দেখলেন বর্তমানে আপনি যে মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন, তাকে বিয়ে করে আপনি মোটেও সুখী হননি। আপনি ভবিষ্যতে গিয়ে দেখলেন আপনি আপনার স্ত্রীর সাথে তুমুল ঝগড়ায় লিপ্ত। প্রতিদিন আপনি তার সাথে ঝগড়া করছেন, মারামারি করছেন এবং ইতিমধ্যে ডিভোর্সের সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছেন। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে আপনি তাড়াতাড়ি টাইম মেশিনে চড়ে বর্তমানে চলে আসলেন এবং যার সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, তাকে মানা করে দিলেন। বিয়েটা ভেস্তে গেল। এরপরে আপনি আরেকটি মেয়েকে বিয়ে করলেন নরম স্বভাবের। এবং ধরুন, তাকে বিয়ে করে আপনি সুখীও হয়ে গেলেন। কিন্তু প্রশ্ন হল আপনি ভবিষ্যৎ দেখে এসেছিলেন বলেই তো নিজের ভবিষ্যত বদলে দিয়েছেন। তাহলে আপনি যা দেখে এসেছিলেন, সেটাকে কি আর ভবিষ্যত বলা যায়? কারণ যা দেখে এসেছেন, তা তো আপনার জীবনে আসলে আর ঘটেইনি! তো?
আসলে আমরা সময় ভ্রমণ বলতে বুঝি একটা মেশিনে চেপে যখন তখন অতীতে, ভবিষ্যতে যাওয়া যায়, বর্তমানেও ফিরে আসা যায়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা যে সময় ভ্রমণের কথা ভাবছেন বা টাইম মেশিন আবিষ্কারের চিন্তা ভাবনা করছেন, ওই টাইম মেশিন দিয়ে এভাবে যখন তখন অতীত, ভবিষ্যৎ ভ্রমন করা সম্ভব নয়। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বানুসারে, অতীতে যাওয়া সম্ভব না হলেও ভবিষ্যৎ ভ্রমণ করাটা সম্ভব। তবে সেখানেও রয়েছে অনেক ধরা বাধা নিয়ম এবং অভাবনীয় প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা। শুধু আপেক্ষিক তত্ত্বই নয়, সেই সাথে প্রয়োজন রয়েছে আধুনিক কোয়ান্টাম তত্ত্বের। যেখানে আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম তত্ত্বগুলোকে এক করার মত জটিল সমস্যা রয়েছে।
আসলে বিজ্ঞানীরা যে টাইম মেশিনের কথা ভাবছেন, তা তথাকথিত টাইম মেশিনের সাথে মোটেও মিলবে না। এবার আর আলোচনা দীর্ঘ না করে চলুন, দেখে আসি পদার্থবিজ্ঞান আসলে ঠিক কোন ধরণের টাইম মেশিন তৈরি করার কথা ভাবছে। তবে সেই টাইম মেশিন তৈরির ব্যাপারটা বুঝতে হলে আগে কয়েকটি বিষয় আমাদেরকে বুঝতে হবে। সেগুলো হল- ব্ল্যাকহোল, হোয়াইট হোল, ওয়ার্মহোল এবং নেগেটিভ এনার্জি।

নেগেটিভ এনার্জি, ব্ল্যাকহোল, হোয়াইট হোল ও ওয়ার্মহোল

আমরা আমাদের মহাবিশ্বে সবসময় বস্তুর ভর ও শক্তিকে অনুভব করে থাকি। এই পুরো মহাবিশ্ব বস্ত ও শক্তিতে পরিপূর্ণ। আর আইনস্টানের আপেক্ষিকতত্ত্বের বিখ্যাত ভর-শক্তি সমীকরণের সাহায্যে দেখানো যায় যে শক্তি ও ভর হচ্ছে একই ব্যাপার। অর্থ্যাত শক্তিকে বস্তুতে কিংবা বস্তুকে শক্তি হতে রূপান্তরিত করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিগ-ব্যাং (বৃহৎ বিস্ফোরণ)-এর সময় অসীম পরিমাণ শক্তি একটি বিন্দু হতে বৃহৎ বিস্ফোরণের মাধ্যমে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। অতঃপর সেই শক্তি হতেই মৌলিক কণা, তারপর অনু-পরমানু এবং পরবর্তিতে এই অনু-পরমানু দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল বস্ত। এটা হচ্ছে শক্তির বস্তুতে রূপান্তরিত হওয়ার উদাহরণ।
আবার সূর্য থেকে আমরা যে আলোক শক্তি পাই, সেটা হচ্ছে বস্তু হতে শক্তিতে রূপান্তরিত হবার উদাহরণ। সূর্যতে হাইড্রোজেন গ্যাস প্রতিনিয়ত হিলিয়াম গ্যাসে রূপান্তরিত হচ্ছে নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাইড্রোজেন পরমাণু মিলে যখন হিলিয়াম পরমানু তৈরি করে, তখন হাইড্রোজেনের কিছুটা ভর শক্তি আকারে নির্গত হয়। ওই শক্তিই হচ্ছে পৃথিবীতে আসা আলোকশক্তি। আবার ধরুন, মানুষ যেসব খাবার খায় তা কিন্তু বস্তু। সেই বস্তুগত খাবার আমাদের শরীরের ভেতরে গিয়ে শক্তি উৎপন্ন করে শরীর নামক জৈব মেশিনকে চালু রাখে।
যাইহোক। তবে বিগ-ব্যাং এর পরে সব শক্তিই যে বস্তুতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে, এমনটি কিন্তু না। মোটশক্তির অনেকখানিই শক্তি আকারে রয়ে গেছে বা অন্য ধরণের শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যেমন- মহাকর্ষ শক্তি, আলোকশক্তি, নিউক্লিয়াসের ভেতরকার প্রবল আকর্ষণ শক্তি ইত্যাদি।
এখন কেউ যদি মনে করে যে, বিগ-ব্যাং এর আগে তো পরম শূন্যতা ছিল। তাহলে এত শক্তি আসল কোথা হতে? মহাবিশ্বের সকল বস্তুকে পুনরায় যদি শক্তিতে রূপান্তরিত করে একটি কয়েক ইঞ্চির প্যাকেটে পুরে ফেলা যায়, তাহলে তো শেষপর্যন্ত আমরা শক্তিই পেলাম। শূন্যতা তো পেলাম না?
হ্যাঁ, এর উত্তর রয়েছে। মহাবিশ্বে বিরাজমান মোট বস্তু ও শক্তিকে পুনরায় এক প্যাকেট শক্তিতে রূপান্তরিত করে ফেললে স্বাভাবিকভাবেই শূন্যতা আসেনা। কিন্তু আপনি যদি ধরে নেন যে, মহাবিশ্বে যে পরিমাণ শক্তি বিদ্যমান আছে, ঠিক সেই পরিমাণ বিপরীতধর্মী শক্তি মানে নেগেটিভ এনার্জিও বিদ্যমান আছে, তাহলে কিন্তু হিসেব মিলে যাবে। আমরা যে এক প্যাকেট শক্তি পেয়েছি তাকে যদি পজিটিভ ধরেন আর তার বিপরীত অদৃশ্য শক্তিকে যদি নেগেটিভ ধরেন, তাহলে নেগেটিভ আর পজিটিভ মিলে কাটাকুটি হয়ে গিয়ে আপনার হাতে থাকল শূন্য। এখন সঙ্গত প্রশ্ন হল, নেগেটিভ এনার্জি কি শুধুই একটি ধারণা? নাকি এর বাস্তব কোনও ভিত্তি আছে?
এর উত্তরে বলা যায়, বিগ-ব্যাং এর সময় যে পরিমাণ গতিতে শক্তি ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই গতিশক্তি কিন্তু মহাবিশ্বে সুপ্ত থাকার কথা। ইতিমধ্যে বিগ-ব্যাং এ ছড়িয়ে পড়া শক্তি যদি বস্তুতে রূপান্তরিত হয়ে গিয়ে গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি ইত্যাদির উৎপত্তি ঘটায় তাহলে সেই বস্তগুলো কিন্তু মহাকর্ষ বলের দ্বারা একে অপরকে আকর্ষণ করে। কিন্তু আগে যে সুপ্ত গতিশক্তি পেয়েছিলাম, তা কিন্তু নেগেটিভ শক্তি হিসেবে এখনও পুরো মহাবিশ্বকে ছড়িয়ে দিচ্ছে অর্থ্যাত দিন দিন পুরো মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। একদিকে বস্তুসমূহের পরস্পরের প্রতি মহাকর্ষীয় বলের আকর্ষণ, বিপরীতদিকে মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুচ্ছ সমুহের ছড়িয়ে পড়ার মত বিকর্ষণ বল। এই বিকর্ষণ বলকেই বলা যায় নেগেটিভ এনার্জি। অর্থাৎ যৌক্তিক কারণেই নেগেটিভ এনার্জির হিসেবটা এখানে চলে আসছে। অন্যথায়, আমরা বিগ-ব্যাং এর আগের পরম শূন্যতার হিসেব কিন্তু মিলাতে পারছিনা।
এই নেগেটিভ এনার্জির ব্যাপারটা মাথায় রেখে এখন আসুন আমরা আরেকটি ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করি। ব্ল্যাকহোল শব্দটির সাথে আজকাল মোটামোটি কমবেশি সবাইই পরিচিত। প্রশ্ন হল- এই ব্ল্যাকহোল ব্যাপারটা কি?
আমরা জানি মহাশূন্যে নানা রকমের গ্যাসীয় পদার্থ ঘুরে বেড়াচ্ছে। যখন ঘূর্ণায়মান আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাস মিলে পরস্পরের আকর্ষণে একত্রিত হয়ে একটি গ্যাসপিন্ডে পরিণত হয়, তখন সেখানে যদি বেশীরভাগ হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস থাকে, তাহলে ওই গ্যাসপিন্ডে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে।

ফিউশন বিক্রিয়া মানে হল- যদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াস মিলে একটি বড় নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। হাইড্রোজেনের পরমাণুর নিউক্লিয়াস, হিলিয়াম পরমানুর নিউক্লিয়াসের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট। তাই অনেকগুলো হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস মিলে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে রূপান্তরিত হতে থাকে। কিন্তু হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের সবটুকু ভর হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের ভর তৈরি করেনা। কিছুটা ভর বিপুল পরিমাণ আলো আকারে নির্গত হয়ে যায়। আর এভাবেই একটি আলোক উজ্জ্বল নক্ষত্রের সৃষ্টি হয়ে যায়। নক্ষত্রের কেন্দ্র যখন তার প্রবল অভিকর্ষ বলের আকর্ষণ দিয়ে তার বাইরের দিকে থাকা গ্যাসগুলোকে কেন্দ্রের দিকে টানে, তখন প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাইরের পৃষ্ঠে থাকা গ্যাসগুলোও ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিপরীতধর্মী বল তৈরি করে একটি সাম্যাবস্থার তৈরি করে। এভাবেই একটি নক্ষত্র টিকে থেকে অনবরত আলো বিকিরণ করতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ওই নক্ষত্রের বিক্রিয়া শেষ হয়ে গিয়ে সেটি মৃত্যুবরণ না করছে। আমাদের সূর্য তেমনই একটি ছোটোখাটো নক্ষত্র, যেখানে অবিরত ফিউশন বিক্রিয়া ঘটেই চলেছে।

নক্ষত্র কিন্তু এমনিতে আমাদের পৃথিবীর তুলনায় বিরাট বড়। আমাদের সূর্যের মত একটি ছোটোখাটো নক্ষত্রই কিন্তু আমাদের পৃথিবীর থেকে প্রায় ১৩ লক্ষ গুণ বড়! অর্থ্যাত ১৩ লক্ষটি পৃথিবীকে একত্রিত করলে সেটির আকার হবে আমাদের সূর্যের সমান! এখন খুব বড়মাপের কোনও নক্ষত্রের কথা ধরুন। হিসেব করে দেখা গেছে যে, যে সমস্ত নক্ষত্রের ভর সূর্যের থেকে কমপক্ষে ১.৫ গুণ বড়, সেই সমস্ত নক্ষত্রের ফুয়েল যখন ফুরিয়ে যায়, সেগুলো তখন বিরাট একটি উজ্জ্বল বিস্ফোরণের পর একসময় চুপসে যায়। অর্থাৎ খুব বড় আকারের নক্ষত্রগুলো তাদের শেষবয়সে বিরাট বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রের দিকে চুপসে যায়। বিরাট ওই বিস্ফোরণকে বলা হয় সুপারনোভা। এখন প্রশ্ন হল- সুপারনোভার পরে কি ঘটে?
সুপারনোভার সময় ওই বিরাট নক্ষত্রের বাইরের দিকটা বিস্ফোরনের ফলে উড়ে যায়। এতদিন কেন্দ্রের দিকের টান আর বাইরের বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন বিপরীত টানের কারণে নক্ষত্রটির মধ্যে একটি ভারসাম্য ছিল। কিন্তু বাইরের দিকের বিক্রিয়া শেষ হয়ে যাওয়ার ফলে যখন বিস্ফোরণ ঘটে, তখন বাইরের দিক উড়ে গিয়ে ছিটকে যায়, থাকে শুধু কেন্দ্রের দিকটা। ওই কেন্দ্রের দিকটি তখন নিজের প্রবল অভিকর্ষের চাপে নিজেই সংকুচিত হত থাকে অকল্পনীয়ভাবে। একসময় সেটি এতটাই চুপসে যায় যে, এটি একটি বৃত্তাকার কেন্দ্রে পরিণত হয়, যার অভিকর্ষ বল হয় অসীম। এই অসীম অভিকর্ষের কারণে এর আশেপাশের স্থান বাঁকা হয়ে যায়। অকল্পনীয় অভিকর্ষ বলের অধিকারী ওই মৃত নক্ষত্রকে তখন বলা হয় ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর।

ব্ল্যাকহোলের অভিকর্ষ বল এত বেশি থাকে যে এর আশপাশ দিয়ে যা কিছুই অতিক্রম করার চেষ্টা করুক না কেন, এটি সাথে সাথে ওই বস্তুকে টেনে তার ভেতরের গর্তে নিয়ে ফেলে দেবে। আর একবার ওই গর্তে পড়লে আর নিস্তার নেই। প্রবল অভিকর্ষের চাপে সেই বস্তু চুপসে গিয়ে একবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে! ব্ল্যাকহোল থেকে উঠে আসার কোনও উপায় নেই। এমনকি আলোও ব্ল্যাকহোল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না! তাই ব্ল্যাকহোলের রঙ কি সেটা দেখার উপায় নেই। কারণ, এটি দেখতে হলে আপনি যে আলো এর উপর ফেলবেন, তা পুনরায় প্রতিফলিত হয়ে আসবে না। ফলে একে দেখারও কোনো উপায় নেই। সেজন্যই এর নামকরণ করা হয়েছে ব্ল্যাকহোল। এরমানে এই নয় যে এটি দেখতে সত্যিই সত্যিই কালো। যা কিছু দেখা যায়না, তাই তো কালো, তাই না?
ব্ল্যাকহোলের অভিকর্ষ বল এতবেশী যে, আমাদের পৃথিবীর মত গ্রহই নয়, আস্ত বড় বড় নক্ষত্রও সেটি গিলে ফেলবে অনায়াসে যদি তা হাতের কাছে পায়! প্রশ্ন হল- গর্তে পড়ার পর বস্তুগুলো যায় কোথায়? ব্ল্যাকহোলের গর্তের যে কেন্দ্র তা এককথায় অসীম। বস্তুগুলো ওখানে পড়লে চুপসে যেতে যেতে কি একেবারে অদৃশ্য হয়ে যায়, নাকি ওই ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্র অন্য কোনও মহাবিশ্বে গিয়ে অন্মোচিত হয়, তা এখনও একটি অমীমাংসিত রহস্যই রয়ে গেছে। কারণ, কোনও নভোচারী বা মহাকাশযান, যেকেউ যেকোনো বস্তু, কেউই ব্ল্যাকহোলের ভেতরে একবার ঢুকে পড়লে বেরিয়ে এসে যে আমাদেরকে তার ভ্রমনকাহিনি শুনাবে এমন উপায় নেই! একবার ঢুকলেই কেল্লা ফতে! বেরিয়ে আসার আর কোনও রাস্তা নেই।
এখন ধরুন, ব্ল্যাকহোলের অন্য একটি প্রান্ত রয়েছে, যেখান দিয়ে ব্ল্যাকহোলে পতিত সমস্ত বস্তু ওই প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে আসছে। তারমানে যে মহাবিশ্বে ব্ল্যাকহোলের অন্যপ্রান্ত রয়েছে, সেই প্রান্ত বা সেই মুখ দিয়ে ক্রমাগত আলো, শক্তি বা নানান পতিত বস্তু প্রবল বেগে বেরিয়ে আসছে। এই অর্থে, ওই মুখ হচ্ছে ব্ল্যাকহোলের বিপরীত হোল। কারণ, ব্ল্যাকহোল সবকিছুকে টেনে ভেতরে গিলে নেয়। ওপর প্রান্তের যে মুখ, তা প্রচন্ড বেগে বস্তু বা শক্তিকে নির্গত করে চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়। তারমানে অন্যপ্রান্তে থাকা ওই বিপরীত গর্তকে বলা যাবে হোয়াইট হোল।

তারমানে ব্ল্যাকহোল এবং হোয়াইট হোলের মধ্যে সংযোগ দিলে আমরা যে সিস্টেমটি পাচ্ছি, তাহল দুটো সম্পূর্ণ আলাদা মহাবিশ্বের মধ্যে সংযোগ তৈরি হওয়া। হতে পারে এই আলাদা দুটো মহাবিশ্বই একই ধরণের প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলা একইরকম দুটো মহাবিশ্ব, কিংবা হতে পারে অপরপ্রান্তের মহাবিশ্বটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী মহাবিশ্ব, যেখানে অন্য ধরণের প্রাকৃতিক নিয়ম কিংবা অন্যরকম সময় প্রবাহিত হতে হচ্ছে। এই আরও মহাবিশ্বের অস্তিত্ব থাকাটাও পদার্থবিজ্ঞানের একটি আলোচিত তত্ত্ব। এই তত্ত্বানুসারে, আমাদের মহাবিশ্বের মত আরও অসংখ্য মহাবিশ্ব রয়েছে। সেই মহাবিশ্বের কোনও কোনটি হয়ত হুবহু আমাদের মতই, যেগুলোকে বলা হবে সমান্তরাল মহাবিশ্ব বা প্যারালাল ইউনিভার্স। আর এই আরও অসংখ্য মহাবিশ্ব থাকার তত্ত্বটিকে বলা হয় ‘বহুবিশ্ব তত্ত্ব’ বা মাল্টিভার্স থিওরি।
প্রশ্ন হল- ব্ল্যাকহোলের অপরপ্রান্তে কি সত্যিই অন্য আরেক প্রান্ত থাকবে, যেখানে অন্য আরেক মহাবিশ্ব বা স্থান রয়েছে? থাকার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, ব্ল্যাকহোলে যে সমস্ত বস্তু গিয়ে পড়ে চুপসে যায়, সেগুলো যায় কোথায়? অদৃশ্য হবার তো কোনও উপায় নেই। কারণ, তাতে শক্তির সংরক্ষণ সূত্র লঙ্ঘিত হয়। শক্তি তো অবিনশ্বর। কোনও বস্তু অদৃশ্য হওয়া মানে তো বস্তু নামক ওই পুরো শক্তিই অদৃশ্য হওয়া। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান তো তা সমর্থন দিচ্ছে না। তাহলে? এর সম্ভাব্য উত্তর একটাই। বস্তু কিংবা শক্তি ব্ল্যাকহোলে পতিত হবার পর যত ক্ষুদ্রই হোক, ছিন্নভিন্ন হোক, কিন্তু অদৃশ্য হতে পারবে না। বরং ব্ল্যাকহোলের অন্য কোনও মুখ দিয়ে সেগুলো হয়ত শক্তি আকারে, কিংবা বস্তু আকারে অবিরাম বেরিয়ে যাচ্ছে।
এখন, এই যে ব্ল্যাকহোলের একপ্রান্ত দিয়ে ঢুকে হোয়াইট হোলের আরেকপ্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে আসার সিস্টেমের কথা (অথবা সম্ভাবনার কথা) এতক্ষণে আমরা জানলাম, এই সিস্টেমকেই বলা হয় ওয়ার্মহোল।

ওয়ার্মহোল মানে হল- স্থানের ভেতর দিয়ে যাওয়া এমন একটি টানেল বা সুড়ঙ্গ, যার একমুখ দিয়ে প্রবেশ করলে আরেকমুখ দিয়ে বেরোলে আরেক পৃথিবীতে বা আরেক সময়ে প্রবেশ করা যাবে। আসলে ওয়ার্মহোল মানে হল স্থান-কাল পাড়ি দেবার একটি শর্টকার্ট রাস্তা। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বলা যাক। আইনস্টাইনর আপেক্ষিক তত্ত্বানুসারে, স্থান ও কাল একসাথে মিলে মিশে আছে। এগুলোকে আলাদা করার কোনও উপায় নেই। আর তাই যেখানে স্থান বেশী বাঁকা, সেখানে অভিকর্ষ বেশি এবং যেখানে অভিকর্ষ বেশী সেখানে সময় অপেক্ষাকৃত ধীর। যেমন- আপনি যদি মহাশূন্যে মহাকাশযানে চড়ে কয়েক হাজারমাইল দূরত্ব সরলরেখা বরাবর অতিক্রম করেন, তাহলে যেসময় লাগবে, বিরাট কোনও গ্রহ-নক্ষত্রের পাশে বাঁকা স্থান দিয়ে ওই একই পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করতে কিন্তু তারচেয়ে অধিক সময় লাগবে। তারমানে দুই স্থানের ঘড়ির মধ্যে তফাত সৃষ্টি হবে। কারণ, অভিকর্ষ যেখানে যত বেশি থাকে, ঘড়িও সেখানে তত ধীরে চলে। একইভাবে ব্ল্যাকহোলের ভেতর কিন্তু অসীম মহাকর্ষ বল থাকার কারণে সেখানে ঘড়ি রীতিমত থেমে যায়! তাই ব্ল্যাকহোলের ভেতর দিয়ে গেলে আপনি আলোর বেগে (কিংবা আলোর চেয়ে অধিক বেগে!) যাত্রা করতে পারবেন, যেখানে আপনার ঘড়ি রীতিমতো স্থির হয়ে যাবে। তারমানে দাঁড়ালো স্থানভেদে সময় কিন্তু এক না। আপেক্ষিক তত্ত্বানুসারে সময় স্থানের উপর নির্ভরশীল। পরম স্থান ও পরম সময় বলতে কিছু নেই। মহাবিশ্বের দুই স্থানে থাকা দুটো ঘড়ি একই সময় দেবেনা। দুই মহাবিশ্ব মানে দু’রকম সময়। এখন দুটো মহাবিশ্বের মধ্যে সংযোগ দেওয়ার অর্থ হল, দুই রকমের সময়ের মধ্যে সংযোগ দেওয়া। তাই ওয়ার্মহোলের একপ্রান্ত দিয়ে ঢুকে আপনি অন্য প্রান্তে বেরিয়ে দেখবেন আপনি অন্য সময়ে চলে এসেছেন। এই যে আইডিয়াটা, এই আইডিয়াকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে টাইমমেশিন তৈরি করার আধুনিক পরিকল্পনা!

টাইম ট্র্যাভেল
কিন্তু এখন প্রশ্ন হল- কিভাবে আমরা ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে আসা-যাওয়া করব? ব্ল্যাকহোলে একবার পড়লে তো আর নিস্তার নেই, কিংবা কি ঘটবে বা কোথায় গিয়ে পড়ব, তা বেরিয়ে এসে বলারও কোনও উপায় থাকবে না। তাহলে উপায়?
আমরা এতক্ষণ যে ওয়ার্মহোলের কথা বলছিলাম, ওটা তো প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ওয়ার্মহোল। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ওয়ার্মহোল খুবই বিপজ্জনক। এবং বাস্তবে এর ভেতর দিয়ে চলাচল করাটা সম্ভবও না। কিংবা এর ভেতর দিয়ে যাবার কারও কোনও শখ নেই (বিশেষ করে আমার)। কিন্তু যদি আমরা কৃত্রিমভাবে ওয়ার্মহোল তৈরি করে ফেলতে পারি, তাহলে?

হ্যাঁ। বিজ্ঞানীরা এখন কৃত্রিমভাবেই ওয়ার্মহোল তৈরির কথা ভাবছেন। আর এই কৃত্রিম ওয়ার্মহোল তৈরি করতে গেলেই আমাদেরকে ভাবতে হবে নেগেটিভ এনার্জির কথা। কেন?
কারণ, আমাদের এমন একটা টানেল তৈরি করতে হবে, যার এক মুখ দিয়ে একটি স্থান থেকে ঢোকা যাবে, আবার ওপর মুখ দিয়ে অন্য স্থানে বেরিয়ে আসা যাবে। এই অন্য স্থানে সংযোগ দিতে গেলে নেগেটিভ এনার্জি লাগবে। ব্ল্যাকহোলে যেমন একমুখে অভিকর্ষ বল (মানে পজিটিভ এনার্জি) রয়েছে, আবার ওপর মুখে রয়েছে এন্টি-ব্ল্যাকহোল বা হোয়াইট হোল, যেখানে রয়েছে বস্তুকে ছড়িয়ে দেবার মত বিকর্ষণ শক্তি (নেগেটিভ এনার্জি)। তাই দুটো ওয়ার্মহোলের একমুখে থাকবে পজিটিভ এনার্জি বা অভিকর্ষ বল ও ওপর দিকে থাকবে নেগেটিভ এনার্জি। এরকম একটি মেশিন তৈরি করতে পারলেই শুধুমাত্র দুই স্থানের মধ্যে বা দু’রকম সময়ের মধ্যে সংযোগ তৈরি করা যাবে।
ধরুন, নেগেটিভ এনার্জি আমরা ল্যাবরেটরিতে কোনোভাবে সত্যি সত্যিই তৈরি করতে সক্ষম হলাম। এবং দুটো ধাতব দরজাকে কাছাকাছি রেখে নেগেটিভ এনার্জির মাধ্যমে কৃত্রিম একটি ওয়ার্মহোলও তৈরি করে ফেললাম। এখন, প্রশ্ন হল- এই ওয়ার্মহোলের দুটো মুখই তো একই সময়ে আমাদের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে একমুখে ঢুকে আরেকমুখ দিয়ে বেরোলে তো আমরা আমাদের পৃথিবীর একই স্থানে একই সময়ে থাকছি। তাহলে এটা টাইমমেশিন হল কিভাবে?
হ্যাঁ, এখানে আরেকবার আপেক্ষিক তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে আমাদের আরেকটি প্রযুক্তি তৈরি করতে হবে। সেটা হল, এমন একটা রকেট, যা আলোর বেগে বা আলোর কাছাকাছি বেগে যাত্রা করতে পারবে। কারণ, আলোর বেগে বা কাছাকাছি বেগে মহাকাশ ভ্রমণ করলে রকেটের ঘড়ি পৃথিবীর ঘড়ির চেয়ে অনেক অনেক বেশি স্লো হয়ে যায়। আলোর গতিতে কেউ যদি মাত্র সাত-আট বছর মহাকাশ ভ্রমণ করে পৃথিবীতে আসে, তাহলে সে দেখবে পৃথিবীতে ইতিমধ্যে কয়েকশো বছর পেরিয়ে গেছে। এই কয়েকশ বছরে পুরো সভ্যতা পালটে গেছে, সেই সাথে তার সময়ে সকল আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কেউই আর জীবিত নেই। অর্থাৎ তার বয়স যেখানে মাত্র সাথ থেকে আট বছর বেড়েছে, সেখানে পৃথিবীর বয়স বেড়ে গেছে কয়েকশ বছর। এই অর্থে সেই মহাকাশচারী ভবিষ্যতের পৃথিবীতে চলে এসেছে!

এবার তাহলে ধরুন, আলোর গতির প্রায় ৯৯.৯৯ শতাংশ গতিসম্পন্ন কোনও ছোটখাটো রকেট আমরা আবিষ্কার করে ফেললাম। এখন এই রকেটের ভেতরে আপনি কৃত্রিমভাবে তৈরি করা ওয়ার্মহোলের একদরজা রাখলেন পৃথিবীতে আর ওপর মুখ মানে ওপর দরজা নিয়ে রাখলেন ওই রকেটে। এবার সেই রকেট যদি আলোর কাছাকাছি বেগ নিয়ে রওনা হয়ে কয়েকবছর মহাকাশ ভ্রমন করে এসে আবার পৃথিবীতে আসে, তাহলে রকেটে থাকা মহাকাশচারী এসে দেখবে পৃথিবীতে কয়েকশ বছর পেরিয়ে গেছে, অর্থাৎ সে ভবিষ্যতের পৃথিবীতে চলে এসেছে। এখন যদি সে রকেটে থাকা ওয়ার্মহোলের দরজা দিয়ে আবার প্রবেশ করে তাহলে সে আবার আগের সময়ের আগের পৃথিবীতে চলে আসতে পারবে, যেখানে আগের মানুষগুলো এখনও জীবিত রয়েছে। আবার সে যদি ওই দরজা দিয়ে আবারও প্রবেশ করে, তাহলে অন্যপ্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে সে আবারও ভবিষ্যতের পৃথিবীতে চলে আসবে। এই হল, টাইম মেশিন তৈরির মূল চিন্তাধারা।
তবে এতটুকু আলোচনা করার পর আমরা সহজেই বুঝতে পারছি যে, এই টাইম মেশিনের সাথে চলচ্চিত্র বা কল্পকাহিনিতে বর্ণিত তথাকথিত টাইমমেশিনের কোনও মিলই নেই। সিনেমার টাইমমেশিন দিয়ে যখন খুশি অতীত বা ভবিষ্যতের যেকোনো সময়ের যেকোনো স্থানে গিয়ে উপস্থিত হওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে যে টাইমমেশিন তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে, সেটা দিয়ে ভবিষ্যতে যাওয়া যাবে, আবার সেই ভবিষ্যৎ থেকে সে তার আগের পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবে, কিন্তু টাইমমেশিন তৈরির আগের সময়ে সে যেতে পারবেনা। অর্থ্যাত এখানে সময়ের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেদিন টাইম মেশিন আবিষ্কৃত হবে ওই সময় থেকেই মানুষের সময় ভ্রমণ বা টাইম ট্র্যাভেল শুরু হবে। এর থেকে আর পেছনের সময়ে যাওয়া যাবেনা।

তবে বাস্তবে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে টাইম মেশিন তৈরি করার ক্ষেত্রেও রয়েছে প্রযুক্তিগত অকল্পনীয় সীমাবদ্ধতা। প্রথমতঃ নেগেটিভ এনার্জি কিভাবে তৈরি করা যায়? এর উত্তর হল- ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে বিজ্ঞানীরা অতিক্ষুদ্র জগত মানে কোয়ান্টাম ওয়ার্ল্ডে ইতিমধ্যে বিপরীতধর্মী কণাদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটিয়ে অতি অল্প পরিমাণ নেগেটিভ এনার্জি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হল ওই আমাদের প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ নেগেটিভ এনার্জি, যা দিয়ে আমরা আস্ত একটা ওয়ার্মহোল তৈরি করে ফেলতে পারব। ওই পরিমাণ নেগেটিভ এনার্জি কবে পৃথিবীতে তৈরি হবে, কিংবা আদৌ কোনোদিন তৈরি করা সম্ভব হবে কিনা, তা এখনও নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছেনা।
দ্বিতীয় সমস্যা হল, এমন একটি রকেট তৈরি করা যা দিয়ে মহাশূন্যে আলোর কাছাকাছি বেগে যাত্রা করা সম্ভব হবে। কিন্তু এমন ফুয়েল কোথায় পাওয়া যাবে বা কিভাবে সৃষ্টি করা যাবে, যা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ভরের রকেটকে আলোর কাছাকাছি বেগে নিক্ষেপ করতে সক্ষম হবে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের জানা নেই। কিংবা বলা যেতে পারে এ ধরণের প্রযুক্তি পৃথিবীতে তৈরি হবার আগ পর্যন্ত আমাদের পক্ষে উল্লেখিত টাইম মেশিন তৈরি করা সম্ভব হবেনা। এমনকি আদৌ আমরা এ ধরণের প্রযুক্তি তৈরি করতে সক্ষম হব কিনা কিংবা সত্যি সত্যিই টাইম মেশিন তৈরি করতে পারব কিনা, তা আমাদের জানা নেই। বিজ্ঞানের এই অবিশ্বাস্য প্রযুক্তির জন্য ভবিষ্যতের পানে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমাদের আর বোধহয় করার কিছুই নেই।

[লেখাটি আমার ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিস্ময়’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া। ২০১৮ সালের বইমেলায় নাগরী প্রকাশনী থেকে বইটি বের হয়েছিল। -লেখক]



সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৮ দুপুর ২:০৭
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নারী একা কেন হবে চরিত্রহীন।পুরুষ তুমি কেন নিবি না এই বোজার ঋন।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১২:৫৪



আমাদের সমাজে সারাজীবন ধরে মেয়েদেরকেই কেনও ভালো মেয়ে হিসাবে প্রমান করতে হবে! মেয়ে বোলে কি ? নাকি মেয়েরা এই সমাজে অন্য কোন গ্রহ থেকে ভাড়া এসেছে । সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=সকল বিষাদ পিছনে রেখে হাঁটো পথ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৮



©কাজী ফাতেমা ছবি

বিতৃষ্ণায় যদি মন ছেয়ে যায় তোমার কখনো
অথবা রোদ্দুর পুড়া সময়ের আক্রমণে তুমি নাজেহাল
বিষাদ মনে পুষো কখনো অথবা,
বাস্তবতার পেরেশানী মাথায় নিয়ে কখনো পথ চলো,
কিংবা বিরহ ব্যথায় কাতর তুমি, চুপসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×