বইয়ের নামঃ যে সূর্যটা রানুর জন্য উঠেছিল
বইয়ের ধরণঃ গল্প গ্রন্থ / গল্প সংকোলন
লেখকঃ ফয়সাল রকি
লেখকের পরিচয়ঃ কথা সাহিত্যিক, গল্পকার এবং সামহোয়্যারইন ব্লগের সুপরিচিত ব্লগার
প্রকাশকঃ নৈঋতা ক্যাফে
প্রকাশকালঃ অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ফেব্রুয়ারী ২০২০
প্রচ্ছদঃ আনিছুর রহমান
বইয়ের মূল্যঃ ২৫০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৯৬, মোট গল্পঃ ৯টা
রকমারি’র লিংকঃ লিংক
গতবারের ২০২০ একুশে বইমেলায় ‘নৈঋতা ক্যাফে’ ষ্টল থেকে আমি বইটা নিজেই কিনে আনি। ইচ্ছে ছিল ফয়সাল রকি ভাইয়ের কাছ থেকে অটোগ্রাফ সহ বইটা নেবো। কিন্তু উনার সাথে দেখা হয়নি। করোনার কারণে এখন বাসায় থাকা হচ্ছে বেশি। এইসময়টাকে কাজে লাগিয়ে ভাবছি বইমেলায় কেনা বইগুলিকে এক এক করে পড়বো এবং পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখে ফেলবো। এটাই হচ্ছে আমার লেখা প্রথম প্রকাশিত বইয়ের পাঠ-প্রতিক্রিয়া। সুপ্রিয় ফয়সাল ভাইয়ের বই দিয়েই এই কাজ শুরু করলাম। কেন যেন এটা ব্লগে আগে আমি প্রকাশ করিনি!
সর্বমোট নয়টা ছোট গল্প এটাতে জায়গা পেয়েছে।
১। ব্যতিক্রম, পৃষ্ঠা ১১-১৮
২। ফেলে আসা মনোলগ, পৃষ্ঠা ১৯-২২
৩। তিন নাম্বার বেড, পৃষ্ঠা ২৩-৩৩
৪। অপরিচিতা, পৃষ্ঠা ৩৪-৩৯
৫। কানামাছি, পৃষ্ঠা ৪০-৪৮
৬। আষাঢ়ে গল্প, পৃষ্ঠা ৪৯-৫৮
৭। যে সূর্যটা রানুর জন্য উঠেছিল, পৃষ্ঠা ৫৯-৬৯
৮। কথোপকথন, পৃষ্ঠা ৭০-৭৫
৯। অভিশপ্ত, পৃষ্ঠা ৭৬-৯৫
-পুরো বইটা পড়ার পর মনে হলো বইয়ের আকার বইমেলার অন্য বইগুলির তুলনায় বেশ ছোট, যার কারণে পৃষ্ঠা সংখ্যা অযথাই বেড়ে গেছে। যেটা ৫ ফর্মার মধ্যেই নিশ্চিত হয়ে যেত, সেটা বেড়ে যেয়ে ৬ ফর্মা লেগেছে। বইয়ের দামও সাইজ এবং পৃষ্ঠা সংখ্যার সাথে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি মনে হয়েছে।
-সবগুলি গল্পেই প্রচুর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় প্রচলিত বাংলা শব্দ ব্যবহার না করেই ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। পৃষ্ঠা ১২’তে ‘ম্যানেজ’ না বলে ‘যোগাড়’ বললেই সুন্দর হতো। ১৩ পৃষ্ঠায় ‘ডিটেইল নিতে হবে’ না বলে ‘বিস্তারিত জানতে হবে’ লিখলে মানানসই হতো। এখন বাংলায় লিখতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই কথ্যভাষায় প্রচলিত বেশ কিছু ইংরেজি শব্দ চলে আসে। তাতে আমি কোন সমস্যা দেখি না কিন্তু যেইসমস্ত শব্দ বাংলাতেই বেশি ব্যবহৃত সেই ইংরেজি শব্দগুলি এড়িয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। কিছু ইংরেজি শব্দের যথার্থ ব্যবহারও হয়নি। পৃষ্ঠা ১৩’তে ‘কিউব’ না হয়ে হবে ‘কিউবিকল’। আজকাল অফিসে সবার বসার জন্য আলাদা আলাদা যে খোপ বানিয়ে দেয়া হয় সেটাকে ‘কিউবিকল’ বলে। পৃষ্ঠা ১৫’তে ‘খাওয়া’ না হয়ে হতো ‘অপ্রকৃতিস্থ’, এখানে ‘খাওয়া’ শব্দ একদম মানায় নি। ‘তিন নাম্বার বেড’ গল্পটাতে প্রচুর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু মোটেও সেটা চোখে লাগেনি। কারণ সেই শব্দগুলির যথার্থ বাংলা প্রতিশব্দ অপ্রচলিত। পৃষ্ঠা ৪৯’এ ‘উইকেন্ডে’ না ব্যবহার না করে ‘সাপ্তাহিক ছুটির দিনে’ ইচ্ছে করলেই ব্যবহার করা যেত। কিছু জায়গায় ‘সায়েন্স’ ব্যবহার করা হয়েছে যেটা ইচ্ছে করলেই ‘বিজ্ঞান’ দিয়ে প্রতিস্থাপণ করা যেত।
-বাংলা বানান নিয়ে বেশ কিছু সমস্যা দেখা গেছে। প্রুফ রিডারের কাজ ভালোমতো হয় নি। অনেক জায়গায়তেই ছোটখাট ভুলগুলি চোখে পড়ে যায়। প্রায় সবজায়গাতেই ‘বলল’ লেখা হয়েছে, আসলে শব্দটা হবে ‘বললো’। কিছু জায়গায় ‘কী/কি’ এই দুইটা সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়নি।
-কথোপকথনের ফরম্যাট নিয়ে সবগল্পেই মিশ্র একটা পদ্ধতি দেখা গেছে যেটা দৃষ্টিকটু। যদিও বেশিরভাগ অংশেই কথোপকথনের শুরু হয়েছে আলাদা লাইনে সামনে হাইফেন (-) দিয়ে, কিন্তু হুট করেই মাঝখানে এবং শেষদিকে লাইনের মাঝেই “” দিয়ে কথোপকথন দেয়া হয়েছে। এটা সর্ম্পূণভাবে প্রুফ রিডারের দোষ। মনোযোগ দিয়ে প্রুফ না করার ফলাফল এটা! পৃষ্ঠা ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭………
লেখক’কে অনুরোধ রইলো যেকোন একটা পদ্ধতি ব্যবহার করা জন্য, না হলে সেটা বইতে লেখার সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়।
-নামকরণও অন্যভাবে করা যেত। এটা একটা গল্প সংকোলন কিন্তু নয়টা গল্পের মধ্যে মাত্র একটা গল্পের নাম দিয়ে এটার নামকরণ করা হয়েছে। বইয়ের নাম দেখে বুঝা যায় না যে, এটা গল্প সংকোলন বা গল্প সমগ্র। তাছাড়া বইতে গল্পগুলি অন্য সিরিয়ালেও দেয়া যতো। বইয়ের শুরুতে এবং একদম শেষে সেরা গল্প দিতে হয়, যেন পাঠক যেই মুগ্ধতা নিয়ে বই পড়া শুরু করবে এবং শেষ করবে একই মুগ্ধতা নিয়ে। পাঠক পাঠ প্রতিক্রিয়া মুগ্ধতায় ভরে থাকবে। বইটা পড়ার জন্য অপরকে বলবে।
গল্পগুলিকে তুলনামূলকভাবে রেটিং জন্য নিন্মোক্ত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে-
* থীম / প্লট - ১
* কথোপকথন - ১
* চরিত্র বিন্যাস - ১
* গল্পে ট্যুইষ্ট / পাঠকের আকর্ষন - ১
* লেখার মুন্সিয়ানা - ১
১। ব্যতিক্রম, পৃষ্ঠা ১১-১৮
থীমঃ একজন (অফিসের ইডি স্যার) অসুস্থ মানুষ’কে রক্তদান করা নিয়ে গল্পটা এগিয়ে গেছে, যিনি (কিবরিয়া ভাই) রক্ত দেবেন তিনি বিশ্বাস করেন যাকে উনি রক্ত দেবেন তিনি মারা যাবেন কারণ আগেও এই ঘটনা অনেকবার ঘটেছে……..
গল্প ভালো লেগেছে। গল্পের শেষে বিয়োগান্তক-দৃশ্যটা গল্পে সুন্দর একটা ট্যুইস্ট এনে দিয়েছে। তবে কিবরিয়া ভাইয়ের মৃত্যু না হলেও মন্দ হতো না। সমাজের প্রচলিত কুসংষ্কারের বিরুদ্ধে লেখা হয়ে যেত এটা। পৃষ্ঠা ১৮’তে ‘বাতে’ হবে না, ‘রাতে’ হবে। ‘হার্ট এ্যাটাক করে মারা গেছেন’ না হয়ে ‘হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছেন’ বললে বেশি মানাতো। ছোট গল্প হিসেবে একদম ঝরঝরে হয়েছে। চরিত্রগুলোতে লেখার কোন অতিরঞ্জন নেই, অযথাই কোন চরিত্র তৈরিও করা হয়নি। একটানে পড়ে ফেলার মতো গল্প। সবাই’কে পড়ার জন্য অনুরোধ করার মতো।
* রেটিং ৪.৫ (৫ এর মধ্যে) [প্রকাশক/প্রুফ রিডারের দোষ আমি লেখক’কে দেবো না!
২। ফেলে আসা মনোলগ, পৃষ্ঠা ১৯-২২
থীমঃ বহুবছর পর একটা মেয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে এবং স্বামীকে নিয়ে ঘুরতে এসেছে। হঠাৎ একটা চিত্র প্রদর্শনী দেখা যায় তার ছবি আঁকা। কেন এখানে তার ছবি?......
এই বইয়ের সেরা গল্প। মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। মাত্র চারপৃষ্ঠা লেখা কিন্তু লেখার গভীরতা অনেক বেশি। পড়ার পর হৃদয়ে অনুভবের শিহরণ সৃষ্টি করে। হুট করে টেনে নিয়ে যায় পিছু ফেলে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর সবস্মৃতিতে। চমৎকার ভালোলাগা এই গল্পটার জন্য। গল্পের থীম দুর্দান্ত। সার্থক ছোটগল্পের চমৎকার উদাহরণ। শেষ হয়েও যেন হলো না শেষ! শেষ পৃষ্টায় ‘নিকট ভবিষ্যতে” না লিখে ‘নিকট ভবিষ্যতেও’ এবং একদম শেষলাইনে ‘দূরে’ না হয়ে ‘দূরেই’ হলে আরও বেশি মানাতো।
* রেটিং ৫ (৫ এর মধ্যে)
৩। তিন নাম্বার বেড, পৃষ্ঠা ২৩-৩৩
থীমঃ একজন দাতের ডাক্তারের কাছে দাঁত তুলে গেছে। দাঁত তোলার সময়ে রোগীর অনুভূতি এবং প্রতিক্রিয়া নিয়েই এগিয়ে গেছে এই গল্প………
চমৎকার গল্প। সুন্দর কাহিনী বিন্যাস। গল্পের শেষ অংশে প্যান্টের পকেটে দাতের টুকরো খুঁজে পাওয়া সুন্দর একটা ট্যুইষ্ট এনে দিয়েছে। এই গল্পেও কথোপকথনের ফরম্যাট নিয়ে একই সমস্যা। “” / - নিয়ে এলোমেলো বিন্যাস, যেটা প্রুফ রিডারের কাজে ফাঁকি দেয়ার ফলাফল। দুইবার অ্যানেস্থেশিয়া দেবার পরও চোয়াল স্বাভাবিকভাবে নাড়ানো বেখাপ্পা এবং অবিশ্বাস্য লেগেছে। তবে ড্রিল মেশিন, ছেনি, হাতুড়ি, দিয়ে ঠুকে ঠুকে দিয়ে দাঁত কেটে বের করা দৃশ্য দুর্দান্ত হয়েছে। একদম শেষ প্যারায় একটা লাইন অন্যরকমভাবে লিখলে ভালো হতো। “অ্যানেস্থেশিয়ার দুর্দান্ত প্রভাবে নেহাতই কি একটা দুঃস্বপ্ন দেখলাম?”
* রেটিং ৪.৫ (৫ এর মধ্যে)
৪। অপরিচিতা, পৃষ্ঠা ৩৪-৩৯
থীমঃ চরিত্রহীন স্বামীর পরকিয়া প্রেমিকা’কে দেখতে লাবনী সুদূর গাজিপুর থেকে মতিঝিল এসেছে। তারপর একটা ক্যাফের দোতলার ডানপাশের কর্নারে বসা পরকিয়া প্রেমিকা মীরা’র সাথে লাবনীর কিছু কথোপকথন নিয়েই এগিয়ে গেছে এই গল্প…….
চমৎকার গল্প। সুন্দর কাহিনী বিন্যাস। কারও ঘর কেউ ভাঙ্গলে যে একদিন নিজের ঘরও ভেঙ্গে যায় নিয়তিও খেলায় সেটা ফুটে উঠেছে। গল্পের শেষ অংশে “লাবণী কে?” এই প্রশ্ন সবপাঠকের কাছে রেখে গেলেন লেখক! তবে লাবনীর আবেগের উপস্থাপনায় কিছুটা ঘাটতি আছে। লাবনী’কে আরও সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা যেত। সাঈদের হালকা একটা প্রতিক্রিয়া দেখানে জমতো ভালো। যেমন, সামান্য কাঁপাস্বরে জিজ্ঞেস করলো, “লাবণী কে?” কথোপকথনের ফরম্যাট নিয়ে সমস্যা এখানে নেই।
এই গল্পটা এই বইয়ের শেষ গল্প হিসেবে দিলে অনেক ভালো হতো! কেন সেটা শেষ গল্পের প্রতিক্রিয়ায় লেখা থাকবে।
* রেটিং ৫ (৫ এর মধ্যে)
৫। কানামাছি, পৃষ্ঠা ৪০-৪৮
থীমঃ খালাতো বোন টুম্পার সাথে প্রেম করা শান্ত কুরবানি ঈদে (আমি ইদ শব্দ পছন্দ করিনা) সবার সাথে বেড়াতে নানাবাড়ি এসেছে। সেখানে প্রেমিকা’কে খুশি করতে এক আজব আবদার পালন করার চেষ্টা করে যায় শান্ত.....
খুব সাধারণ থীম। কিছু অংশ পড়ার সময় মনে হয়েছে টেনে অযথাই বড় করা হয়েছে। তেমন কোন নাটকীয়তাও নেই।
শেষ লাইনেও কথোপকথনে ফরম্যাটে পরিবর্তন হলেও যথারীতি প্রুফ রিডার ঘুমিয়ে ছিল!
* রেটিং ২.৫ (৫ এর মধ্যে)
৬। আষাঢ়ে গল্প, পৃষ্ঠা ৪৯-৫৮
থীমঃ সাপ্তাহিক ছুটিতে বৌকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেরাতে যেয়ে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো রফিকের। পরিচিত একটা বাচ্চা মেয়ে সাপের কামড়ে মারা গেলে কাহিনী কাহিনী আরও জট পাঁকে......
পুরোপুরি ছন্নছাড়া একটা গল্প। মনোযোগ দিয়ে পড়লে একসাথে বিভিন্ন সময়কালের ঘটনা নিয়ে লেখা দেখা যায়। নিষাদ এখানে একেবারেই অপ্রয়োজনীয় চরিত্র হলেও গল্পের বেশকিছু অংশ এই মেয়েকে নিয়ে লেখা। মিরাজুল ইসলাম স্যারের সাথে রাতের বেলা পুকুর পাড়ে দেখা হবার দৃশ্য আসলেই কি প্রয়োজন ছিল? সম্ভবত লেখক মিরাজুল ইসলাম স্যার’কে নিয়ে অন্যকোন প্লট চিন্তা করেছিলেন যেটা পরের লেখাগুলির সাথে কোন মিল নেই। নিষাদ যেহেতু ডাক্তার, আশেপাশেই আছে এখন, প্রথমে বাচ্চাটাকে নিষাদের কাছে চিকিৎসার জন্য দেখালে এবং তারপরে মারা গেল ওঝা এসে বাঁচানোও দৃশ্য দেখালে লেখাটা সুন্দরভাবে ফুটে উঠতো। এই গল্পে মূলত দুইটা সমস্যা। এক, এতে কোন থ্রীল নেই। দুই, লেখাগুলির মাঝে কিছু লিংক অদৃশ্য। এর ফলে এই গল্পটা থ্রীলার, ভৌতিক বা সায়েন্স ফিকশন কোন ক্যাটাগরিতেই পরে না। অতিপ্রাকৃতিক কিংবা ভৌতিক গল্প লিখলে সেটা পুরোপুরি সেই আবহ দিয়ে লেখা উচিৎ।
গল্প/উপন্যাস/কবিতা ইত্যাদির লেখার নামকরণ লেখকের নিজস্ব চিন্তার ফসল হিসেবে আমি ধরে নেই। এবং এটা নিয়ে আমি কিছু বলি না। কিন্তু এই গল্পটার নামকরন পছন্দ হয়নি। পড়া শুরুর আগেই কোন লেখার নাম দেখে পাঠকের মনে আবছা একটা আইডিয়া তৈরি হয়ে যায়, যা পড়ার সাথে সাথেই এগিয়ে যায়। এই গল্পের নাম প্রথমেই লেখাটাকে মারাত্মক হালকা করে দিয়েছে।
* রেটিং ২.০ (৫ এর মধ্যে) (* বই প্রকাশে সময় এই গল্পটা বাদ দিলেই ভালো হতো)
৭। যে সূর্যটা রানুর জন্য উঠেছিল, পৃষ্ঠা ৫৯-৬৯
থীমঃ ঢাকা কলেজে পড়া মাজেদ তার চাচাতো বোন রানু’র উত্তরাতে নতুন ভাড়া নেয়া বাসায় বেড়াতে আসলে ঘটনার সূত্রপাত হয়। অবহেলার কারণে এই বাসায় একটা ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটলে বাসার দাড়োয়ান রানু’কে হাসপাতালে নিয়ে যান……….
চমৎকার গল্প, সুন্দর কাহিনীর বিস্তৃতি, আকর্ষনীয় থীম, কথোপকথনও প্রাঞ্জল। গল্প হিসেবে অবশ্যই পছন্দ করার মতো। ঢাকা শহরে মানুষের ব্যস্ততাময় জীবনে এইধরণের ঘটনাগুলি ঘটা খুবই স্বাভাবিক। তবে পড়ার সময় পাঠকরা কিছু কিছু জায়গায় হোঁচট খাবে ঘটনার সময়কাল নিয়ে তাল মিলাতে না পেরে। এক্ষেত্রে লেখক যদি আলাদা প্যারা করে লিখতেন তাহলেই এই সমস্যা হতো না। তবে এই গল্পের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হচ্ছে একদম শেষে অংশে লেখক হুট করে লেখার টোন পরিবর্তন করে সরাসরি পাঠকের সাথে কথোপকথনে জড়িয়ে গেছেন। রানুকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে এই পর্যন্তই যথেষ্ঠ ছিল। কারণ এতটুকু পড়লেই পাঠক ভাবতে বাধ্য হবে এবং লেখার করুন রসটুকু বুঝে নেবে। একজন গল্পকারের উচিৎ পাঠক’কে যতদুর সম্ভব লেখার সাথে সম্পৃক্ত করে রাখা। শেষ অংশের কথোপকথনে এখানে অপ্রয়োজনীয় এবং লেখার মান কমিয়ে দিয়েছে। কথোপকথনে ফরম্যাট পরিবর্তন নিয়ে এখানেও হালকা সমস্যা আছে।
* রেটিং ৪.৫ (৫ এর মধ্যে) (* শেষ অংশ বাদ দিলে আমি অবশ্যই ৫ দিতাম)
৮। কথোপকথন, পৃষ্ঠা ৭০-৭৫
থীমঃ সংগীতা নিজের বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার পর তার বর্তমান প্রেমিক রফিকের সাথে দেখা করতে এসেছে। বিয়ে এবং দুইজনের মাঝে সর্ম্পক নিয়ে বিভিন্ন কথোপকথন ঘিরেই এগিয়ে চলেছে এই লেখা......
লেখার শেষ অংশে দেয়া ট্যুইস্ট লেখাটাকে দুর্দান্ত করে তুলেছে। পাঠক’কে ভাবতে বাধ্য করেছ কী হতে পারে শেষ পর্যন্ত! একদম শেষে নরমাল মিরিন্ডা হবে না, হবে ঠান্ডা মিরিন্ডা। কারণ ঠান্ডা মিরিন্ডাই হোটেলের বয়’কে দিয়ে যেতে বলা হয়েছিল। এখানে বেশ কিছু ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করলেও কথ্যভাষায় এইশব্দগুলি নিয়মিত ব্যবহার করা হয় দেখে খারাপ লাগেনি। তাছাড়া গল্পকার তো আগেই পাঠক’কে ইংগিত দিয়েছেন লেখাটা কথোপকথন নিয়ে হবে। এটাই নামকরণের সার্থকতা। তবে লেখার শেষ অংশে লেখক ইচ্ছে করলেই ট্যুইস্ট’টা আরও যুতসইভাবে দিতে পারতেন। গল্প’টাও আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠতো।
* রেটিং ৪.৭৫ (৫ এর মধ্যে)
৯। অভিশপ্ত, পৃষ্ঠা ৭৬- ৯৫
থীমঃ মায়া সভ্যতার নিয়ে জড়িত টিকাল শহরের একটা সরাইখানায় বাংলাদেশী দুইজন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক সালমা, জামাল এবং সাইজন নামক একটা দেবতার কাহিনী। তার সাথে যুক্ত হয়েছে নোরা নামের একজন পতিতা এবং বুড়ি নামের একটা নারী চরিত্র……..
গল্পকার আসলে এখানে কী থীমের উপর লিখেছে সেটা বুঝা বড় মুস্কিল! একগাদা চরিত্র নিয়ে আসা হয়েছে যাদের আসলে মূলগল্পে কোন ভূমিকাই নেই। অযথাই নোরা নামের একটা মেয়ে’কে দোতলা থেকে কথা বলতে দেখা যায়। এর মাঝে আবার ফ্রয়েডীয় সাইকোলজিকেও নিয়ে আসা হয়েছে। জামালের অত্যাধিক হেঁয়ালি পূর্ণ আচরণ, কিছুক্ষণ পর পর ঘড়ি নিয়ে কথা বলা লেখাটাকে একেবারেই সাদামাটা করে ফেলেছে। একই স্বপ্ন কেন সবাই দেখে আবার এর সাথে অভিশপ্ত বাক্যের উচ্চারণ করার মাঝে লিংক স্পষ্ট নয়। গল্পে অপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু এসেছে কিন্তু দরকারী কিছু জিনিস বাদ পরে গেছে। কথোপকথনের অতিরিক্ততা পাঠকের মনে বিরক্তও এনে দিতে পারে। পড়া শুরু করলে পাঠক কিছুক্ষণ পরেই লেখার খেই হারিয়ে ফেলে হোঁচট খেতে থাকবে।
প্রুফ রিডারের কাজের মান নিয়ে যে সন্দেহ ছিল সেটা এই গল্প এসে পরিপূর্ণ হয়েছে। বই প্রকাশের সময় এই গল্প কোনভাবেই দেয়া ঠিক হয় নি। বইয়ের একদম শেষে এটা দিয়ে মারাত্মক সর্বনাশ করেছে। দুর্দান্ত বেশকিছু গল্প পড়ে আসার পর পাঠক যখন এই গল্পটা পড়ে বইটা শেষ করবে তখন তার অনুভূতি কী হবে সেটা সহজেই অনুমেয়!
* রেটিং ২.০ (৫ এর মধ্যে) (* বই প্রকাশের সময় এই গল্পটা বাদ দিলে সবচেয়ে ভালো হতো)
পাঠকদের জন্যঃ
এই বইয়ের লেখক ‘ফয়সাল রকি’ সামহ্যোয়ারইন ব্লগের একজন সুপ্রতিষ্ঠিত গল্পকার। গল্পের এই বইতে বেশ কিছু অসাধারণ গল্প আছে যা সহজেই আপনাকে মুগ্ধ করবে। ছোট গল্প লেখা এবং সেটা পাঠক’কে মুগ্ধ করা দারুন কঠিন ব্যাপার। ফয়সাল ভাই দারুন ভাবেই সেটা এই বইয়ের কিছু গল্পে সেটা করে দেখিয়েছেন। অভিনন্দন রইলো গল্পকার’কে।
একুশে বইমেলা ২০২০ প্রকাশিত এই বইটা সবাই’কে পড়ার জন্য আমন্ত্রণ দিচ্ছি।
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, ফেব্রুয়ারী ২০২১
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১:৪০