বইয়ের নামঃ আঁধারের কাহন
লেখার ধরণঃ ভৌতিক এবং থ্রিলার
লেখিকাঃ তামান্না জেনিফার
প্রকাশনীঃ ৫২ (বায়ান্ন)
প্রচ্ছদঃ সাদিতউজজামান
প্রথম প্রকাশঃ মার্চ ২০২১
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৯৬
মলাট মূল্যঃ ২৫২/=
লেখিকা তামান্না জেনিফারের বেশ কিছু গল্প এবং কবিতা পড়া হলেও তার কোন উপন্যাস আগে পড়া হয়নি। জনপ্রিয় এই লেখিকার একটা উপন্যাস পড়ার ইচ্ছে ছিল অনেকদিনের। আঁধারের কাহন তার বহুল পঠিত একটা উপন্যাস। বাংলাদেশে লেখিকাদের ভৌতিক বিষয় এবং থ্রিলার জনরার লেখার প্রতি আগ্রহ অন্যান্য জনরার তুলনায় কিছুটা কম দেখা যায়। সেই হিসেবে উপন্যাসিকা তামান্নাকে এই জনরায় লেখার জন্য বেশ সাহসী বলা যায়। কারণ এই উপন্যাসটি ভৌতিক ঘরনার থ্রিলার টাইপের উপন্যাস। বইয়ের নামকরণ দেখেই লেখাটা কী ধরনের হতে পারে কিছুটা অনুমান করেছিলাম। পুরো উপন্যাস পড়ার পর মনে হলো ঘটনা প্রবাহের সাথে এই নামকরণটা সঠিক হয়েছে।
উপন্যাসের লেখা সাদামাটাভাবে শুরু হলেও লেখা যত সামনের দিকে এগিয়েছে রহস্য এবং পাঠকের আগ্রহ তত বেশি সৃষ্টি হয়েছে। প্রচলিত ধারার বাইরে যেয়ে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করার কারণে লেখাটা বেশ আকর্ষনীয়ও হয়ে উঠেছে। বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষনীয় দিক হচ্ছে, লেখাটা পড়তে শুরু করলে সহজে উঠতে ইচ্ছা করবে না। সামনে কী ঘটবে এবং ঘটনার মোড় কোনদিকে যেতে পারে এই আকর্ষণ পুরো বইটা শেষ না করা পর্যন্তই থেকে যায়।
কাহিনী সংক্ষেপঃ
কাহিনী শুরু হয়েছে যমুনা নদীর তীরের কাজলাদীঘি গ্রামে সন্ধ্যার সময়ে। নদীর ভাঙ্গনের ফলে এই গ্রামের ঘরবাড়ি ক্রমশঃ ভেঙে যাওয়া শুরু হয়েছে। রুহুল মিয়া নামের একজন নিঃস্ব প্রায় ব্যক্তি জীবনে সবকিছু হারিয়ে শূন্য নিষ্প্রাণ হয়ে সন্ধ্যার পরে নদীর তীরে একাকী বসে আছে। তার বাসাটা নদীর তীর থেকে সামান্য দূরে, নদী আর একটু এগোলেই তার বাসাটা ভেঙে ফেলবে। তার স্ত্রী আমেনা বেগম তাকে খুঁজতে নদীর পারে চলে আসে। এখানেই আমেনা বেগমের সাথে দেখা হয় এক অশরীরী আত্মার। স্বামীকে নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তাগ্রস্থ থাকার কারণে আমেনা বেগম বুঝতেই পারেনি যার সাথে তার দেখা হয়েছিল সে মানুষ, নাকি অন্য কিছু।
এই গ্রামের প্রাক্তন জমিদার বিজয়ানন্দ রায় খুশিতে বাসায় বিরাট আয়োজন শুরু করেছেন। তার একমাত্র ছেলে অশোক অনেকদিন পর আমেরিকা থেকে দুই কন্যাকে নিয়ে পিতৃভূমিতে ফিরছেন। আশেপাশের দশ গ্রাম নয় বরং পুরো জেলার মধ্যে এই রায় পরিবার সবচেয়ে ধনী, টাকাপয়সা, জমিজমা প্রভাব-প্রতিপত্তি কোন কিছুই এদের অভাব নেই। বহুদিন ধরে বংশ পরস্পরায় এরা এই অঞ্চলে জমিদারি করে আসছে। কিন্তু টাকাপয়সা বিস্তর থাকলেও এই জমিদার পরিবারের উপর আছে ভয়ঙ্কর কিছু অভিশাপ। এই পরিবারে কোন ছেলে সন্তান সহজে জন্ম নেয় না। বিজয়ানন্দের তিন মেয়ে এক ছেলে। ছোট মেয়ে মারা গেলেও বাকি দুইমেয়ে মাধবীলতা ও পূরবীলতাকে খুব অল্পবয়সেই বৈধব্য মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। বিজয়ানন্দের দুই বোনেরও একই দশা। বংশ পরস্পরায় এদের মেয়েরা সংসার করতে পারে না। পরিবারের মেয়েদের অন্য কোথাও বিয়ে দিলেও অভিশাপে তাদের বিয়ের দিনই স্বামীরা মারা যায় এবং মেয়েদের সংসার শুরু করার আগেই বাবার বাড়িতে বিধবা হয়ে ফিরে আসতে হতো। এই রায় পরিবারের অতীত ইতিহাস নিয়েই উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। উত্তরাধিকার দেয়ার জন্য ছেলে সন্তান হওয়া খুব কঠিন এই বংশে। কেন ছেলে সন্তান জন্মায় না এবং কী সেই মারাত্মক অভিশাপ, সেটা ঘিরেই এই উপন্যাসটা ধীরে ধীরে সামনের দিকে রহস্যের জট নিয়ে এগিয়ে গেছে।
মাধবীলতা ভরা পূর্ণিমা রাতে অদ্ভুত এক কারণে বদ্ধ পাগল হয়ে যায়। অসূরের শক্তি ভর করে তার দেহে। কোন বাঁধনই তাকে আটকে রাখতে পারে না। হূট করেই মাধবীলতা এক পূর্ণিমা রাতে খুব স্বাভাবিক আচরণ করে। অশরীরি এক আত্মা তার কাছে আসে, যে দেখতে হুবহু মাধবীলতার মতো দেখতে। কে এই অশরীরী আত্মা? কেন সে মাধবীলতার কাছে আসে?
অশোকের স্ত্রী শিখা উচ্চ শিক্ষিতা। কোন কুসংস্কারই সে বিশ্বাস করে না। রায় পরিবারে বেড়াতে আসার পর বেশ কিছু অস্বাভাবিক দৃশ্য দেখলেও কিছুতেই সেইগুলি সে বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু সহসাই গভীর এক রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে বাসার গোপন একটা ঘরে স্বামী এবং শ্বশুরকে এক ভয়ংকর ঘটনায় জড়িত দেখতে পেলে তার প্রথাগত সব বিশ্বাস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। সেই অশরীরী আত্মা তাকে সাবধান করতে আসে। শিখা এবং তার কন্যাদ্বয়ের জীবনে এক কঠিন বিপদ নেমে আসবে খুব শীঘ্রই। কী সেই বিপদ?
এই উপন্যাসের শেষের দিকে ভয়ংকর পিশাচ সাধনার কাহিনীও উঠে এসেছে। ছেলে সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য রায় পরিবারের নিষ্ঠুর এক প্রথার কাহিনী চলে এসেছে।
শেষ পর্যন্ত রায় পরিবারে কী ঘটলো? শিখা এবং তার কন্যারা সেই ভয়ংকর বিপদ থেকে মুক্তি পেলো?
সেটা জানার জন্যই পাঠক‘কে পড়তে হবে এই উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত!
চরিত্র চিত্রায়নঃ
মূল চরিত্রগুলি সুন্দরভাবে ফুটে উঠলেও উপন্যাসিকা চরিত্রগুলো নিয়ে আরো চমৎকার কিছু দৃশ্যের অবতারণা করতে পারতেন। বিশেষ করে মাধবীলতা ও অশরীরী চরিত্রের অধিকারিনীর চিত্রায়ন ইচ্ছে করলে আরো বিস্তারিতভাবে লিখতে পারতেন। বিশেষ করে, তাদের প্রথম দেখা হবার কাহিনী উপন্যাসে আসলে মনে হয় লেখাটা আরো ভালো হতো। পৃষ্ঠার স্বল্পতা নাকি প্লট অন্যদিকে নিয়ে যাবার কারনে বিস্তারিত লেখা হয়নি সেটা বুঝা যায়নি।
মূল চরিত্রগুলোর মধ্যে আমেনা বেগমের চরিত্রটি বেশ সুন্দর করে ফুটে উঠেছে। শিখা ব্যানার্জীর চরিত্র নিয়ে আরো কিছুটা কাজ করা যেতে পারতো। কারণ উপন্যাসের শেষের দিকে এই শিখা চরিত্রটি উপন্যাসের মূল চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দৃঢ়চেতা শিখা চরিত্রটিকে আরো আগে পাঠকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে লেখাটা আরো উপভোগ্য হয়ে উঠতো।
সমালোচনাঃ
পাঠক হিসেবে আমি আরো কিছু বিশেষ দৃশ্যের গভীর অপেক্ষায় ছিলাম, বিশেষ করে মাধবীলতার সাথে নয়বছর বয়সে অশরীরী আত্মা চন্দ্রাবতীর প্রথম মুখোমুখি দৃশ্য পড়ার জন্য। রানি অম্বিকাকে নিয়ে পিশাচ সাধনার আরো কিছু দৃশ্য এনে তার পৈশাচিক ক্ষমতা কতদূর বিস্তৃত দেখালে সেটা দারুন হতো। পুরাতন রায় বাড়িতে পাপের প্রথা ধংস হয়ে যাবার দৃশ্যের একদম শেষের অংশ কিছুটা তাড়াহুড়া করে লেখা হয়েছে মনে হয়েছে।
পরিশেষঃ
একটা প্রকাশিত বই’কে তুলনামূলকভাবে রেটিং জন্য নিন্মোক্ত পদ্ধতি আমি সবক্ষেত্রে ব্যবহার করি-
* থীম / প্লট - ১
* কথোপকথন - ১
* চরিত্র বিন্যাস - ১
* ট্যুইষ্ট / পাঠকের আকর্ষন - ১
* লেখার মুন্সিয়ানা - ১
একজন মনোযোগী পাঠক হিসেবে দৃষ্টিতে 'আঁধারের কাহন' এর জন্য মার্কিং হবেঃ
* থীম / প্লট - ১
* কথোপকথন - ১
* চরিত্র বিন্যাস - ০.৭০
* ট্যুইষ্ট / পাঠকের আকর্ষন – ০.৭০
* লেখার মুন্সিয়ানা – ০.৭০
* ট্যুইষ্ট / পাঠকের আকর্ষন এবং লেখার মুন্সিয়ানায় কম মার্কিংয়ের কারণ হচ্ছে উপন্যাসের চলমান ঘটনা প্রবাহ আরো কিছু দৃশ্যের দাবী রাখে বলেই আমি বিশ্বাস করি।
বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে আলাদা কিছু কথা লিখতে চাই। ‘আঁধারের কাহন’ এর প্রচ্ছদ তার মূল ঘটনার সাথে খুব সুন্দরভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে। অনেক সময়ে তাড়াহুড়া কিংবা প্রচ্ছদ শিল্পী লেখার মূল থীম না ধরতে পারার জন্য ভিন্ন রকম প্রচ্ছদ আকেন। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রচ্ছদ ভালো হয়েছে। সম্ভবত প্রচ্ছদে ভরা পূর্নিমাতে মাধবীলতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে এটা বুঝানো হয়েছে।
প্রচুর বই পড়া হলেও আমি খুব কমই পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখি। ‘আঁধারের কাহন’ এমন একটা উপন্যাস যা একবার পড়লে আবার পড়তে ইচ্ছে করে। আমি নির্দ্বিধায় যারা ভৌতিক ঘরনার বই পড়তে চান তাদের’কে এটা পড়তে অনুরোধ করবো। এই বইয়ে পাঠক’কে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখার লেখিকার আপ্রাণ প্রচেষ্টা আমার কাছে দুর্দান্ত লেগেছে। পুরো উপন্যাস আচমকা শুরু হয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়েছে তার নিজস্ব গতিধারায়। পড়তে শুরু করলে পাঠকের মনে বার বার প্রশ্ন উঠে আসে, কী হচ্ছে তাহলে? শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছিল? উপন্যাসিকা হিসেবে সেটাই উনার বিরাট সাফল্য।
উৎসর্গঃ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কথা সাহিত্যিক, উপন্যাসিকা তামান্না জেনিফার’কে। উনার আরেকটা বই পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইলো।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, ফেব্রুয়ারী ২০২২
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০২৩ সকাল ১০:৩৭