বই যেহেতু ফ্রি চাইছেন তার মানে আপনারা পাঠক। কিন্তু একটা বই প্রকাশ করার সাথে কতগুলো ধারাবাহিক কাজ সম্পর্কিত এটা কি কখনো আন্দাজ করেছেন আপনারা?
বুঝার চেষ্টা করেছেন কখনো?
একজন লেখক দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, ঘন্টার পর ঘন্টা মোবাইলে কিংবা কম্পিউটারে টাইপ করে করে একটা বইয়ের পান্ডুলিপি তৈরি করেন প্রচন্ড পরিশ্রম করে। পান্ডুলিপি লেখা হলে আবার তিনি সেটা নিয়ে বসেন বানান ও ব্যাকরণগত ভুল সংশোধনের জন্য। এছাড়াও আনুষঙ্গিক অন্যান্য সবকিছু ঠিক করতেও আবার তাকে দীর্ঘদিন পরিশ্রম করতে হয়। এত কষ্ট করার পরে যখন পান্ডুলিপিটা লেখা শেষ হয়, তারপর তিনি সেটা প্রকাশকের কাছে বুকে অনেক আশা নিয়ে পাঠান দুরু দুরু বুকে।
একজন প্রকাশকের কাছে শত শত লেখক তার পান্ডুলিপি পাঠান প্রকাশ করার জন্য। সেই শত শত পান্ডুলিপি থেকে একজন প্রকাশককে দিনের পর দিন পরিশ্রম করে, বাছাই করে, সেরা পান্ডুলিপিটা বের করে নিয়ে আসতে হয়। একটা পান্ডুলিপি লেখা যতটা কষ্টকর, একজন প্রকাশকের পক্ষে শত শত পান্ডুলিপি বেছে একটা সেরা পান্ডুলিপি বের করে নিয়ে আসাও প্রায় একই রকমের কষ্টকর কাজ হয়। এই কাজে ভুল করলে তার প্রকাশনীর সুনাম ও আর্থিক ক্ষতি দুইটাই হবে।
একটা বই প্রকাশ করা কোনোভাবেই সমাজসেবামূলক কোনো কাজ নয়। এটা একজন প্রকাশকের বাণিজ্যিক কার্যক্রম। তার রুটি রোজগার এটার উপরে নির্ভর করে। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন এটা থেকেই দিতে হয়। সুতরাং বই প্রকাশের সময় একজন প্রকাশককে অনেকগুলো বিষয় যথেষ্ট সতর্কতার সাথে দেখে রাখতে হয়।
কোনো পান্ডুলিপি পছন্দ হলে এরপর একজন প্রফেশন্যাল প্রুফ রিডারকে দিয়ে সেই পান্ডুলিপি ভালোভাবে সংশোধন করে ছাপানোর উপযুক্ত করতে হয়। প্রুফ রিডারকে এজন্য যথেষ্ট পরিমাণে টাকা পয়সা দিতে হয়। কারণ প্রুফ রিডারের কাজ যদি ভালো না হয় তাহলে বইয়ের সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
এরপর বইটা প্রকাশকের নিজের পকেট থেকে অনেক টাকা খরচ করে ছাপাতে দিতে হয় এবং তারপর সেটা বাইন্ডিং করতে হয়। বাইন্ডিং করার আগে একজন প্রচ্ছদ শিল্পীকে আবার টাকা পয়সা দিয়ে পছন্দসই একটা ভালো মানের প্রচ্ছদ সেটা বানিয়ে নিতে হয়। প্রচ্ছদ ছাপানোর পরে বই বাইন্ডিং করে প্রচ্ছদটা লাগিয়ে বইটা এবার বিক্রির জন্য উপযুক্ত করা হয় প্রকাশনীর পক্ষ থেকে।
প্রকাশকের প্রতিটা কাজই টাকা পয়সার সাথে সম্পর্কিত। এরপর প্রকাশক একটা বইয়ের পিছনে যত টাকা খরচ করেছেন তার লাভ ও লেখককে রয়েলিটি ফি দেয়ার কথা চিন্তা করে সেটার হিসাব করে প্রতিটা বইয়ের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করেন যেন সব পাঠক বইটা কিনতে পারে।
কোনো লেখক যদি নতুন হয়, তাহলে প্রকাশকের টেনশন আরো বেড়ে যায়। নতুন লেখকদের বই প্রথমবার আসলে খুব কমই বিক্রি হয়, এটা চিরন্তন সত্য কথা। ন্যূনতম সংখ্যাও যদি বিক্রি না হয় তাহলে প্রকাশকের মাথায় হাত দেওয়ার মতন অবস্থা হয়। নতুন লেখকরা তখন বেশ আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। কারণ ন্যূনতম সংখ্যার বইও যদি বিক্রি না হয় এবং সেই প্রকাশক যদি এই বইটা বের করে বাণিজ্যিকভাবে লোকসানের মধ্যে পড়েন, তাহলে সেই প্রকাশক আর কখনোই সেই লেখকের বই ছাপাবেন না।
এতগুলো কাজ শেষ হওয়ার পর বইটা বিক্রি করার জন্য বইমেলা কিংবা বুকে স্টলগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তারপর সেই বইগুলো ধাপে ধাপে বিক্রি করার চেষ্টা করা হয়। এই বই বিক্রির সাথে আবারো টাকা খরচ করে বই প্রচার করার কাজও করা হ্য়।
এতকিছু করার পরে যখন সেই লেখক কিংবা প্রকাশকের কাছে বিভিন্ন মানুষজন বিভিন্ন সম্পর্কের অজুহাত দিয়ে হাত পাতে ফ্রি বই নেওয়ার জন্য, তখন একবার ভেবে দেখুন তো সেই প্রকাশক কিংবা লেখকের মনের অবস্থা কী হয় আপনার সেই আবদার শুনে?
প্রকাশক ও লেখক উভয়ই তখন প্রচন্ড টেনশনে আছেন বইয়ের খরচের টাকা উঠানোর জন্য। পরিচিত লোকজনই তো বই কিনবে একজন লেখকের ও প্রকাশকের। অথচ তারা বই তো কিনছেন না, বরং ফ্রি বই নেয়ার আশায় বসে আছেন। এইরকমভাবে ফ্রি বই চেয়ে প্রকাশক ও লেখকের উভয়কে আরও বড় বিপদে ফেলার পায়তারা করছেন।
কোনো লেখক বা প্রকাশকের কাছে ফ্রি বই চাইবার আগে, একবার নিজেকে সেই লেখক কিংবা প্রকাশকের জায়গায় কল্পনা করুন। একবার ভেবে দেখুন, আপনি যদি সেই জায়গায় থাকতেন আর আশেপাশের পরিচিত মানুষজন আপনার কাছে এভাবেই বই না কিনে ফ্রি বই চাইতো তখন আপনার কেমন লাগতো?
কোনো লেখকের বই কেনার সামর্থ্য যদি না থাকে তবে তাকে ভদ্র ভাষায় শুভকামনা জানান, তার বই জনপ্রিয় হোক ও পাঠপ্রিয়তা পাক সেই কামনা করুন।
অন্তত তার কাছে ফ্রি বই চেয়ে সেই লেখক ও তার প্রকাশককে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবেন না।
ধন্যবাদ ও শুভকামনা।
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইল
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০২৩
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সকাল ১০:২২