ব্যক্তিগত কিংবা বিভিন্ন প্রয়োজনে আমাকে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন মসজিদে সালাত আল-জুমুআহ বা জুমুআহর নামাজ পড়তে হয়েছে। সেটা ঢাকা হোক বা ঢাকার বাইরে। এইসব মসজিদের জুমুআহর নামাজ পড়তে গেলেই কিছু বিষয় নিয়ে আমার প্রচণ্ড অস্বস্তি হয়। জানি না আপনাদের হয় না কি?
.
আপনার হয়তো কেউ কেউ খেয়াল করেছেন, কিছু কিছু মসজিদে জুমুআহর নামাজের সময় আসল কাজ রেখে বিভিন্ন দুনিয়াবী কাজকর্ম নিয়েই অতিরিক্ত ব্যস্ততা দেখা যায়।
.
এরমধ্যে সবচেয়ে অস্বস্তি লাগে যখন দেখা যায় মসজিদে টাকা তোলা নিয়ে, দান খয়রাত নিয়ে মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে মসজিদ কমিটির তৎপরতা কোনো শেষ নেই। কে কত টাকা দিয়েছে, কে কত টাকা আরো দিবে, আর কত টাকা কোন কাজে লাগবে, মসজিদের উন্নয়নের জন্য আর কী কী কাজ বাকি আছে, কয়টা এসি লাগাতে হবে, ফ্লোর কোন সাইজের টাইলস দিয়ে ঢেকে দিতে হবে সেই হিসেবের ফিরিস্তি মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া মুসল্লিদের বসে বসে মাইকে উচ্চস্বরে শুনতে হয়।
.
অথচ জুমুআহর নামাজকে ইসলামে সাপ্তাহিক ঈদের দিন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এইদিন ভাবগম্ভীর ধর্মীয় পরিবেশে মসজিদে আসতে বলা হয়েছে এবং মসজিদের ইমাম যিনি খুতবা দিবেন তাকে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে বলা হয়েছে। মানুষের ভুল ত্রুটি সংশোধন করে দেওয়ার জন্য ইসলামিক দিক নির্দেশনা সহ ভাষন দিতে বলা হয়েছে। সমসাময়িক বিভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা ও আলোচনা করতে বলা হয়েছে।
.
অথচ এইসব মসজিদে মসজিদে ধর্মীয় আলোচনার বিষয়গুলোর সময় কমিয়ে দিয়ে টাকা পয়সার বিষয়টাই মুখ্যভাবে মাইকে বলা হয়ে থাকে।
.
মসজিদে মানুষ সাহায্যের জন্য অবশ্যই টাকা পয়সা দিবে। তবে ইসলামে দান খয়রাতের, যাকাত কিংবা সাদাকার বিষয়টাকে গোপনে দিতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে এসব কাজ মানুষ এমনভাবে করবে যেন, তার ডানহাতে টাকা দিলে বামহাত যেন না জানতে পারে। অথচ এইসব মসজিদে মাইকে এমনভাবে যারা টাকা দেয় তাদের নাম বাবার নাম বাসার ঠিকানা সহ প্রচার করা হয় যেন, এই নাম সবার সামনে পড়ে শোনানোর জন্যই টাকাপয়সা দেয়া হয়েছে। এমনকি টাকার পরিমাণ বেড়ে গেলে হুজুরদের তার জন্য দোয়ার সংখ্যা, বরাদ্দকৃত সময় ও কন্ঠের ভলিউম বেড়ে যায়।
.
দানের পরিমাণ বেড়ে গেলে যেভাবে হুজুররা উচ্চ গলায় তাদের প্রশংসা করতে থাকে সেটা বড়ই দৃষ্টিকটু। আমাদের দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কথা চিন্তা করলে খুব কম মানুষের পক্ষেই, মসজিদে বিশাল বিশাল কোনো ডোনেশন দেওয়া সম্ভব। যারা এসব বিশাল অংকের টাকা মসজিদে দিচ্ছে তারা কোথা থেকে টাকা জোগাড় করে নিয়ে আসছে সেটা অবশ্যই ভেবে দেখার বিষয়। হালাল পথে আসছে না, হারাম পথে আসছে? যদি হারাম পথে উপার্জিত এই অর্থ এসে থাকে, তাহলে হুজুররা যেভাবে গলা ফাটিয়ে তাদের জন্য দোয়া করছে, সেটা কোন যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে?
.
বাংলাদেশের বিভিন্ন মসজিদে বেশিরভাগ সময় দেখা যায় সারাজীবন আকাম কুকাম করে, দুর্নীতি করে, ঘুষ খেয়ে, জনগণের টাকা লোপাট করে, শেষ বয়সে এসে এইসব হারাম টাকা দিয়ে একবার হজ করে বিশাল মুসল্লি সেজে যান, নামের আগে হাজী ট্যাগ লাগান। তারপর সে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ থেকে মসজিদে বড় বড় ডোনেশন দিয়ে এরা মসজিদ কমিটির মেম্বার, সাধারণ সম্পাদক, চেয়ারম্যান, সভাপতি হয়ে যান। আদতে এদের চরিত্র আসলে কোন পর্যায় সেটা কিছুদিন আগে এক মসজিদ কমিটির সভাপতিকে একজন মুয়াজ্জিনকে নামাজ শেষে মসজিদের লাইট নিভাতে মাত্র এক না দুই মিনিট দেরি হয়েছে দেখে বেধড়ক চড় থাপ্পড় কিল ঘুসি মারতে দেখেই বুঝা গেছে। আমি যতটুক শুনেছি বেশিরভাগ মসজিদেই ইমাম মুয়াজ্জিন বা এই সমস্ত লোকজনদেরকে মসজিদ কমিটির লোকজন যথেষ্ট দুর্ব্যবহার করে। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথাবার্তা বলে। জোর করে বিভিন্ন অন্যায় অনৈতিক কাজ করায়। মসজিদে তোলা বিভিন্ন টাকাপয়সা মেরে দেওয়ার কাহিনী তো আছেই। আর এসব দুর্নীতি পরায়ন লোকদের জন্য মসজিদের ইমাম আর হুজুরদের নিতান্তই বাধ্য হয়ে দোয়া করার পদ্ধতি দেখলে সত্যিই মন খারাপ হয়ে যায়। রাজনৈতিক প্রেসার তো আছেই।
.
সৎভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে চলা কোনো ব্যক্তি চোখের সামনে যখন দেখতে পায়, চরম দুর্নীতি পরায়ণ ঘুষখোর একটা ব্যক্তির নামে মসজিদের খতিব বা ইমাম উচ্চস্বরে মাইকে প্রশংসা করছে, তখন তার কি অনুভূতি হতে পারে সেটা একবার কি ভেবে দেখেছেন কেউ? এটা কি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়ার একটা পদ্ধতি না? মানুষকে দুর্নীতিতে উৎসাহিত করার একটা পন্থা না?
.
আর আজকাল মসজিদের উন্নয়নের নামে যেভাবে টাকা-পয়সা তোলা হয় সেটা প্রচন্ড দৃষ্টিকটু। মুসল্লিদের সংখ্যা বেড়ে গেলে মসজিদ একতলা থেকে দোতলা হতে পারে কিংবা তিনতলা চারতালা। কিন্তু মসজিদের ভিতরে এসি লাগাতে হবে, ফ্লোরে চকচকে টাইলস লাগাতে হবে। দামী জিনিস দিয়ে মসজিদে ভিতর ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন করতে হবে, এইসব নতুন নতুন থিওরি কারা আবিষ্কার করছে? কেন আবিষ্কার করেছে?
.
যে মসজিদে নববীতে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজ পড়তেন সেটা ছিল খেজুর গাছের ডাল ও পাতা দিয়ে তৈরি করা। রোম সাম্রাজ্যের সম্রাটের কাছ থেকে এক প্রতিনিধি আসলো মুসলিমদের খলিফার কাছে একটা পত্র দেওয়ার জন্য। মদিনায় এসে যখন মানুষজনকে জিজ্ঞেস করছে খলিফা কোথায়? তখন সবাই মসজিদে নববীতে মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকা হযরত ওমর বিন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে দেখিয়ে দিলেন। সেই পত্রবাহক কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারলেন না যে মুসলমানদের খলিফা এভাবে এত দীনহীনভাবে একটা মসজিদে শুয়ে আছে যে মসজিদটা খেজুর গাছের ডাল পাতা দিয়ে তৈরি করা। যিনি মেঝেতে শুয়ে আছেন এত দিনহীন ভাবে, তার প্রজ্ঞা ও জ্ঞানে অর্ধ পৃথিবী থরথর করে কাঁপতো। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময় মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে যুদ্ধজয়ের বিভিন্ন অর্থ সামগ্রী আসা শুরু করেছিল। কই উনি তো সেই জাকজমকপূর্ণ মসজিদ বসাননি? বরং আমি যতটুকু জানি মসজিদকে দুনিয়াবী জিনিসপত্র দিয়ে আলোকসজ্জিত করা কিংবা সৌন্দর্যমন্ডিত করার ব্যাপারে ইসলামে বারবার নিষেধ করে দেওয়া আছে।
.
যারা মসজিদে দান করার তারা এমনিতেই দান করবেন।মাইকে ঘোষণা করলেও দিবেন, না করলেও দিবেন। দয়া করে জুমুআহর নামাজের আগে এইসব টাকা-পয়সা বিষয়ক আলোচনা এনে, গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বিষয় আলোচনা না করে, এই ধর্মীয় আমেজ নষ্ট করবেন না। নিজেরা টাকা-পয়সার নয়ছয় করতে চান করুন। অন্তত জুমুআহর নামাজ পড়তে যাওয়া মুসুল্লিদের মসজিদকে প্রবেশের পরে ত্যক্ত বিরক্ত করবেন না।
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইলো!
মাহে রামাদান ও ঈদ উল ফিতর এর শুভেচ্ছা
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, এপ্রিল ২০২৩
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৩ সকাল ১১:০১