যুদ্ধ ও জীবন-৭১ (পর্ব-১)
-নূর এমডি চৌধুরী
চারিদিকে মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ । কোন এক কাজে রনাঙ্গন থেকে বাসায় ফিরেছে ক্লান্ত হাসেম গাজী । বড়ই ক্ষুধার্ত ।
ভাতের ক্ষুধার কথাটাই বলি।মনের ক্ষুধা সে কথা নাই বা বলি । বিয়ের বয়স তার ছয় মাস আর যুদ্ধে অবস্থান তিন মাস তের দিন ।
যুদ্ধে যাওয়ার পর এই প্রথম দেখা স্ত্রী হোমাইরার সাথে ।
হাসেম গাজী যুদ্ধের দাবানল চালিয়ে যতটা না রোগাক্রান্ত হোমাইরা যেন তার চেয়েও বেশি । মুখ পানে যেন তাকানোই যাচ্ছেনা ।
আর যাবেই বা কি করে যে চোঁখ সহস্র লাশের প্রত্যেক্ষ সাক্ষী।
বাবার ঝুলন্ত লাশ । মায়ের ছিন্ন ছরা রক্তাক্ত দেহ । আপনজন সকলের এক এক রহস্যময় মৃত্যু ।
বয়স তার খুব বেশি নয় । চৌদ্দ কি পনের হবে । যৌবনের দ্বারপ্রান্তে আসিতে না আসিতেই শুরু হল জীবন সংগ্রাম । মৃত্যুর দাবানল স্বীকার হল এক এক করে আপন জন প্রতিবেশী সকলেই । নিজেকে দফায় দফায় সমর্পিত করতে হল পাক কমান্ডারের হাতে । অস্তিতবে তার কলঙ্কের কত দাগ যে লেপন হল তার হিসেব মেলা ভার । সে এখন অন্তঃসার শুন্য । মাঝে মধ্যে ভেবেছে এই জীবন্টা একেবারেই শেষ করে দেই । কিন্তু হাসেম গাজীর কথা ভেবে একবার শেষ দেখার নিগুঢ় প্রত্যাশায় আজও সে বেঁচে আছে ।
হাসেম গাজী এসেছে । যার প্রতিক্ষায় প্রহর গুনেছে অহর্নিশি যার মুখ দর্শন প্রত্যাশায় নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে । সেই গাজী এসেছে ।
ঘরের দোয়ারে নয় একেবারে মনের দোয়ারে ।
বাড়ির আঙ্গিনায় নয় একান্ত মনের আঙ্গিনায় ।
হোমাইরা যেন স্থবির । ঘোমটা দিয়ে মুখ খানা ঢেকে রেখেছে । মাথাটা একেবেরেই নত । যেন কি অপরাধে সে আজ কাঠগড়ায় দন্ডায়মান ফেরারি আসামি । হাসেম গাজী বারান্দায় থেকে ঊঠানে গিয়ে বসে। পেটের ক্ষুধা যেন বরফে পরিনত হয় । বউ হোমাইরার নত শীর আর নীরবতা তাকে আর বুঝতে বাকি রাখেনা এতোটুকু । হাজারো প্রশ্নের কোন জবাব গাজী পায়নি । বাবা কোথায় মা কোথায় দাদা,দাদি চাচা,চাচী ভাই বোন আত্মীয়সজন। ওরা কোথায়?
প্রশ্ন চলে প্রশ্নের নিয়মে নীরবতা যেন গহীন থেকে গহিনতর হয় । সরলা হোমাইরা স্তব্ধ হয়ে যায় নিমিষেই । কোথায় এতোদিনের সপ্নের মানুষটারে ভালবেসে বোকে জড়াবে তা না করে যেন ঘৃণায় নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে ।
ঘৃণা ! সত্যিই ঘৃণা আর লজ্জায় সরলা লজ্জাবতি আজ নুয়ে পড়েছে । মন্থর পৃথিবীতে সত্যিই নিজেকে বড় অপরাধী মনে করছে । যে মনে বাতাবি ঘ্রাণ এতোটা দিনে লালন করে রেখেছিল সে ঘ্রাণ যেন বড়ই বাশি হয়েছে।
হাসেম গাজী বিড়ি টানে একের পর এক টেনেই যাচ্ছে। মা নেই বাবা নেই কেউ নেই। যার মুখে হাসি ফোটাবে বলে নিজেকে করেছে সমর্পণ। গিয়েছে যুদ্ধে।। ঘরে অবলা স্ত্রী রেখে নিজেকে দাড় করেছে রনাঙ্গনে। আর সে রন বীরের স্ত্রী আজ বিরঙ্গনা।
ওরে ও মুক্তি সেনা জবাব দেনা অশ্রু হাসে
কোথায় মোর মা জননী জন্ম ভুমি সর্বগ্রাসে।
চোখের পানি তো আর পানি নেই,চোখ যেন রক্তের আভা।আগুনের স্ফুলিঙ্গ যেন জমাট বেঁধেছে ।
নীরবতা,নীরবতা নীরবতা। এভাবে আর নীরব থাকিস নারে বউ। নীরব থাকিস না। কি হয়েছে বল। আমাকে বাঁচতে দে বউ আমাকে বাঁচতে দে...কান্নায় কাতর হাসেম গাজী।
অকস্যাৎ জড়িয়ে ধরে স্ত্রী হোমায়রা কে । হোমাইরা নিজেকে আড়াল করতে চায় ।
স্বামী! দোহায় তোমার আমাকে স্পর্শ করোনা । আমাকে ছুঁইয়ো না । আমি কলঙ্কিনি,আমি হতভাগিনি,আমি বিরোঙ্গিনা ।
আমি তোমার সম্পদ রাখতে পারিনি । শুধু একটি বার তোমায় দেখে পরপারে যেতে চেয়েছি বলে বিধাতা সে কথা রেখেছেন । আজ আর আমার কোন আশা নেই কোন সাধ নেই নেই কোন আহল্লাদ নেই কোন চাওয়া পাওয়া । আমাকে তুমি অনুনয় বিনয় করো না স্বামী । আমি তোমার পায়ে পড়ি আমায় যত পার প্রহার কর রক্তাক্ত কর।আমায় গলা টিপে মেরে ফেল।
পৃথিবী যেন নির্বাক।নির্বাক যেন পৃথিবীর মানূষ গুলু। সারা বাংলার আকাশ বাতাসে লাশ আর লাশের গন্ধ । রক্তের নদী বয়ে চলেছে বাংলা জোড়ে ।
হোমায়ারার মত লাখো রমনী তখন নির্যাতিত,নিস্পেশিত,কলংকিত,মৃত ।
সুন্দর পৃথিবীতে কে না বাঁচিতে চায় । কার না সাধ হয় স্বামীর চরন তলে মাথা রাখতে । কত নির্মমতার স্বীকার হলে একটি প্রাণ ঝরে যেতে চায়, ঝরে যায় তা যে প্রাণ ঝরেছে সে প্রাণই জানে ।
সোহাগ গাজী প্রশিক্ষন প্রাপ্ত একজন মুক্তি যোদ্ধা । রন কৌশলের পাশাপাশি কমান্ডার শিখিয়েছে পরিস্থিতি কি করে মোকাবিলা করতে হয় । মন তার আবেগের মুখোমুখি হলেও প্রশিক্ষণ তাঁকে ফিরিয়ে আনে নির্মম কঠিন বাস্তবতা্র দিকে।
চলবে......।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১১:০৭