somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আড্ডার প্রস্ন

০৬ ই আগস্ট, ২০০৮ দুপুর ২:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সেপ্টেম্বরের ২৯ তারিখ ২০০১, শনিবার । শীতটা বেশ জাঁকিয়ে নেমেছে। জার্মানীর হামবুর্গ শহরটাই এমন। ভয়াবহ বাতাস আর ঠান্ডা বছরের বেশিরভাগ সময়ই এখানে পাওয়া যায় একদম বিনামুল্যে। বরঞ্চ ঘরের মধ্যে গরম হতে পয়সা লাগে। প্রত্যেক ঘরের হিটিং সিস্টেম চালু রাখা হয় অতি চড়া মুল্যের গ্যাস এর সাহায্যে। একটা কথা চালু আছে “ফ্রি দিলে বাঙ্গালী টেট্রনের জামা পিন্দে” – কথাটা ঠিক নয়। অতি চড়া গ্যাস বিলের পরোয়া না করে বাঙ্গালী ঘর গরম করার বিলাসিতা অবশ্যই করে। অথচ বিলাসী ও অভিজাত বলে যাদের সবাই চেনে সেই জার্মানরা অতি কড়া হিসাবের মধ্যে দিয়ে চলে। তাদের হিসাবের ববরন দিতে গেলে মহাকাব্য রচনা হয়ে যাবে।

শনি-রবি দুদিন ইউনিভার্সিটি বন্দ্ব । নেই কাজ তো খৈ ভাজ। একটা খৈ-ই ভাজতে পারি তা হচ্ছে ‘ঘুম-খৈ’। সুতরাং সেঁটে ঘূমাচ্ছিলাম কিন্তু বাধ সাধলো ঝাঁঝালো ডোরবেলের আওয়াজ। অদৃশ্য মেহমানের উদ্দ্যেশ্যে ভয়াবহ কিছু গালি দিলাম (মনে মনে)। ডরমিটরির বাঙ্গালি ফ্যামিলি কোয়ার্টারে, বিশেষ করে ছুটির দিন সকালে এমনই হয়। কোনও একটা অজুহাতে ব্যাচেলর ছাত্রদের কেউ-না-কেউ এসে হাজির হবে। কয়েকজনকে কান ধরে বের করা যায় কিন্তু সবাইকে নয়। উদ্দ্যেশ্য থাকে একটাই – দারুন একটা বাঙ্গালি নাস্তা, ভয়াবহ জ্বাল দিয়ে তৈরি করা দেশী দুধ-চা আর বিরামহীন আড্ডা।

অনিচ্ছাস্বত্তেও বউএর গুতো খেয়ে উঠলাম দরজা খুলতে। তবে ইচ্ছা করেই বেশ সময় নিয়ে মুখে পানি দিলাম যাতে অনাহুত মেহমান দেরী দেখে চলে যায়। ভেতর থেকে বউ নামক জেনারেটর ভয়ানক গুঞ্জন শুরু করাতে প্রাকৃতিক কার্যক্রমটা আর শুরু করতে পারলাম না। দরজা খুলে দেখি আমার ডিপার্টমেন্টেরই এক ছোট ভাই (বাঙ্গালী) সাথে অপরিচিত দু’জন বাঙ্গালী । পরিচয় পর্বের পর জানা গেল একজন বাঙ্গালী অন্যজন ইন্ডিয়ান মুসলিম ভাই। তারা দুজন অনেক দুরের আরেকটি শহর ডুইসবুর্গ থেকে এসেছেন। যাইহোক, শুরু হল নাস্তার আয়োজন, দুধ-চা আর আড্ডা। প্রথমদিকের আড্ডার বিষয়বস্তু বাংলাদেশ, সমসাময়িক রাজনৈতিক অবস্থা, বিপুল উৎসাহে দেশটার উচ্ছন্নে যাওয়ার চালচিত্র, দেশের মানুষের নিরাপত্তা, চুরি-ডাকাতি, ইত্যাকার সবকিছু। এরমধ্যে কয়েকবার অবশ্য দেশের সম্পর্কে ভাল ভাল কথাও আলোচনা হয়েছে। বেচারা অবাঙ্গাল মাঝে মাঝে একটু হাসি দিচ্ছিল আর বেশিরভাগ সময় ইন্টারনেটে ৯/১১ এর ভয়াবহ ঘটনার পুংখানুপুঙ্খ বিবরন, আলোচনা, বিভিন্ন ডকুমেন্টারি এভিডেন্স, বিশ্বব্যাপি মুসলিমদের সঙ্কট ও তার প্রতিবাদ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য মাথায় গেথে নিচ্ছিল। ভদ্রাতার খাতিরে আমরা মাঝে মাঝে তার সাথেও তাল দিচ্ছিলাম। একাধিক বাঙ্গালী আর একজন অবাঙ্গালী এক জায়গায় হলে এমনই হয় বেশিরভাগ সময়। বাংলা ছেড়ে ইংরেজিতে আড্ডা? খুব ভয়াবহ রকমের বিরক্তি কাজ করতে থাকে।

গল্পের ফাঁকে ফাঁকে বউকে রান্নায় সাহায্য চলল, শতকরা ১০০ ভাগ বুয়া না হলেও ঠিকা বুয়ার মতনই কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসুচী চলে এখানে। রান্না আর গল্পে গল্পে দুপুর হয়ে গেল, এবার খাবার আয়োজন। এক ফাঁকে অবশ্য আমি নামাজ পড়ে নিলাম, সাথে একজন ধার্মিক বাঙ্গালী মুসল্লী মিলল । ডুইসবুর্গের মুসল্লি দুজনের এ ব্যাপারটাই বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখলাম না। খাবার পর বিশেষ আয়েশ করে সিগারেট ধরাবার সময় অবশ্য তাদের দুজনকেই পুর্নদৈর্ঘ্য ছায়াছবির মতন পুর্নদৈর্ঘ্য সঙ্গী হিসাবে পেলাম। তা-ই বা কম কিসে। একসময় আড্ডার একমাত্র বিষয়বস্তু হল ৯/১১, প্রধান টেরোরিষ্ট মোঃ আতা ও তার সঙ্গী আর এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সারা বিশ্বে মুসলমান ভাইদের অপমান, কোথাও কোথাও অত্যাচার, এইসব।

আমাদের ডর্মেটরি তখন এফ,বি,আই ও জার্মান পুলিশের দিনরাত পাহারায়। কুখ্যাত (নাকি বিখ্যাত?) টেরোরিষ্ট মোহাম্মদ আতা আমাদের ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ছাত্র। এছাড়া ডর্মিটরির খুব কাছের একটা অ্যাপার্টমেন্টে তার ক্ষণস্থায়ী একটা আবাস পাওয়া গেছে। পাহারা বেষ্টিত অবস্থায় আমাদের আলোচনা চলল টেরোরিজম আর মুসলিমদের নিয়ে। একসময় অবাঙ্গালী মুসল্লী বেশ উত্তেজিত হয়ে গেল। সার বিশ্বে মুসলিমভাইদের উপর এমন অপমান, সন্দেহ আর অত্যাচার তার খুব একটা পছন্দ হয়নি। তিনি বক্তব্য দিতে লাগলের এইসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, রুখে দাড়াতে হবে। মুসলমান হয়ে মুসলমানের পাশে দাড়াবো না? এতো গুনাহ ! ভয়ানক গুনাহ! আমাদেরকে জিহাদে অংশ নিতে হবে। প্রয়োজনে শহীদ হতে হবে – এমন আরও অনেক কিছু। তার কথা শুনে গেলাম। কেউ কোনও মন্তব্য করল না। যখন তিনি একটু ধাতস্থ হলেন তখন আমি হাত উঠালাম। বললাম আমি কিছু প্রস্ন করতে চাই তাকে। আমার প্রথম প্রস্ন ছিল ইসলামের স্তম্ভ কয়টি, তিনি এধরনের নাবালক প্রস্নের উত্তর দিতে খুব একটা ইচ্ছুক মনে হল না। তবুও হোষ্টের প্রস্ন কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? বললেন, কেন পাঁচটি? আমি জানতে চাইলাম – সেগুলো কি কি। তিনি তাও বললেন। তার উত্তর গুলোর মধ্যে ‘জিহাদ’ ছিলনা কারন এটা ইসলামের কোনও স্তম্ভ নয়। তাকে আমি তখন জিজ্ঞাসা করলাম – নামাজ আদায় করা কি ফরজ নাকি সুন্নত? তিনি একটু চুপ করে রইলেন তারপর উত্তর দিলেন এটা তো আমরা সবাই জানি যে নামাজ ফরজ, এর কোনও মাপ নেই। অর্থাৎ গুনাহ ! জানতে চাইলাম তাহলে তিনি যে জোহর, আসর, মাগরিব (আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে আমি ও দ্বিতীয় বাঙ্গালী এই তিন নামাজ আদায় করেছিলাম) কোনটাই পড়লেন না, এর জন্য কি কোনও গুনাহ আছে? তিনি চুপ। এরপর তাকে বললাম কোরান থেকে একটা আয়াত বের করুন যেখানে পৌচাশিক হত্যাকান্ড ঘটানো জন্য কোনও অনুমোদন আছে কিনা আর জিহাদ কি, কখন জিহাদ হয়, কেন হয়?

আমি আজও জানিনা এটা আমার কোনও ভুল ছিল কিনা তবে আমি এর জন্য কোনও অনুশোচনা অনুভব করি না। কারন আমার প্রস্নগুলোর পরপরই আড্ডার রস নষ্ট হয়ে যায়। ওইদিনই সন্ধ্যা ৭টার ট্রেনে চেপে অবাঙ্গালী ও বাঙ্গালী ভাইদুজন ডুইসবুর্গ ফিরে যান। তার সাথে আমার আর কখনও দেখা হয়নি। দেখা হলে জানতে চাইতাম তিনি কি এখনও অসুস্থ জিহাদের স্বপ্ন দেখেন?
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭


ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে চাঁদগাজীর নাম দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই আপনার দাঁত-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তার মন্তব্য পড়ার আগেই আপনার মস্তিষ্ক সংকেত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×