বড় অদ্ভুত এক শহরের সাথে পরিচিত হলাম কাল। রাতেই বোধহয় শহরটা নগ্ন হয়ে ধরা পড়ে চোখের সামনে।
কাল রাতে বাসা থেকে বেরিয়ে যাই রাগ করে। মাথায় তখন খালি একটাই চিন্তা। আর বাসায় ফিরবো না। পকেটে ১৫৫ টাকা। আসকার দীঘির পাড় দিয়ে বের হয়ে কাজির দেউরি। ১০০ টাকার নোটটা মানিব্যাগ থেকে বের করে নিচের পকেটে গুজে নিই। যদি কোনভাবে মানিব্যাগ খোয়া যায় এই ভয়ে। মাথায় ঘুরছে কীভাবে এই শহর ছেড়ে দূরে চলে যাব। আপাতত ভাবছি কক্সবাজার আর ঢাকার কথা। কোন ছোটোখাটো দোকানে কাজ নিব। তারপর যা হওয়ার হবে। কক্সবাজার গেলে তো আর কথাই নেই। বহু আকাঙ্খিত রাতের সমুদ্রের বিশালতাকে আরো কাছে পাবো। ভাবতে ভাবতে রয়েল হাটের সামনে চলে আসি। মালবোরো টানতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু ধোয়ার পেছনে এত টাকা খরচ করা উচিত হবে না। গোল্ডলিফই সই। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে স্টেডিয়াম ঘুরে এলাম। হাতের সিগারেট শেষ।
মনে পড়লো ১১টার দিকে ঢাকার ট্রেন ছাড়ে। কোনমতে যদি উঠা যায়.. এনায়েত বাজার, নিউ মার্কেট ঘুরে চলে এলাম স্টেশনে। ঢাকার ট্রেন প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে। কিন্তু প্ল্যাটফরমে ঢুকার পথে টিকেট চেক করছে। আমি আর ওদিকে এগুলাম না। ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসলাম। এদিক ওদিক তাকালাম। সবাই যার যার মত বসে আছে, ছুটছে। ১১ টার ট্রেন ছাড়তে আর ১৫ মিনিট বাকি। স্টেশনে মানুষের ঢল নামলো। কুলিরা ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। ১১ টার ট্রেন চট্টগ্রাম ছেড়ে গেল। আমার আর ঢাকা যাওয়া হলো না। এর মধ্যে আরেকটা ট্রেন এসে প্ল্যাটফরমে দাঁড়ালো। সবাই নেমে পড়লো। গার্ডরা আর টিকেট চেক করছে না। প্ল্যাটফরম ধরে হাঁটা দিলাম। সাদা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেনের জানলার ভেতর দিয়ে তাকালাম। কেউ নেই। ট্রেনের পাশ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। প্ল্যাটফরমে তখন গৃহহীন মানুষেরা শোয়ার বন্দোবস্ত করছে। মিনারেল ওয়াটার বিক্রেতারা প্লাটফরমে বসে দিনের হিসাব মিলাচ্ছে। দুই একজন মনের সুখে গান ধরেছে। এত সুখ এরা কই পায়? এতক্ষণে খেয়াল করলাম আমার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। একটা চশমা আর থ্রি কোয়ার্টার পরা ছেলে এত রাতে কি করছে কারো কৌতূহল জাগলো না। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন রাস্তায় একটা গর্ত খুঁড়লে সেটা দেখার জন্ন্যে ভিড় জমে যায়। ট্রেন কত লম্বা? কয়টা বগি? ছোটবেলায় ট্রেন দেখলে ট্রেনে বগি কয়টা গুনার চেষ্টা করতাম। গুনার আগেই ট্রেন চলে যেত। এখন তো দেখি ট্রেন শেষ হতেই চায় না। একটা ওভারব্রিজের কাছে আসলাম। ওভারব্রিজের নিচে প্লাটফরমের দু পাশে দুটা ট্রেন। হুমায়ুন আহমেদের পুতুলের মত ট্রেনের ছাদে লাফিয়ে পড়ে দৌড়াতে ছুরু করলে কেমন হয় ব্যাপারটা? কিন্তু ওভারব্রিজের রেলিং অনেক উঁচু। ওভারব্রিজেও দেখলাম অনেক মানুষ শুয়ে আছে। ওভারব্রিজ দিয়ে পুরানো স্টেশনে নামলাম। হটাৎ মনে হল এখানে গাঁজা পাওয়া যায় কোথায় জানি শুনেছিলাম। ইচ্ছে হল গাঁজা খাব। এখন আমি মুক্ত। কেউ কিছু বলার অধিকার রাখে না। জীবন তো একটাই! ষ্টেশনের পাশে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। পলিথিন দিয়ে তৈরি ঝুপড়িমতো ঘর। একটার পাশে দেখলাম খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা শুকনো বেঁটে করে একজন হাতের তালুতে কি জানি ঘসছে। বুঝলাম গাঁজা খাবার জন্য রেডি করছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় পাব। সে জানাল স্টেশনের শেষ মাথায় গেলে পাব। ১০/২০ টাকা নিবে। শেষের ঝুপড়ির কাছে গিয়ে দেখলাম একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার বয়সী হবে হয়তো। জিজ্ঞেস করলাম গাঁজা আছে কিনা। সে জানালো আছে। আমি তাকে মানিব্যাগ থেকে ৫০ টাকার নোটটা বের করে দিলাম। সে আমাকে একটা ছোট কাগজের পোঁটলামত জিনিস দিল। আমি ৩০ টাকা ফেরত চাইলে সে বলে ওটায় নাকি ৫০ টাকার। আমি ২০ টাকারটা দিতে বললাম। সে আরো ছোট একটা পোটলা দিল। এর মধ্যে দেখি আরো ৪-৫ জন জমা হয়েছে। সবাই গাঁজা কিনতে এসেছে। একজন বলল ১০ টাকার টা দিতে। আমি তারপর ২০ টাকার পোঁটলা ফেরত দিয়ে ১০ টাকার ২টা পোঁটলা নিয়ে আসলাম। একটা টং থেকে ৩টা শেখ হোয়াইট আর ১টা ম্যাচ আর ১টা ব্লেড কিনলাম গাঁজা কাটার জন্য। পকেটে আর ২৩ টাকা। আমি তারপর ঐ লোকটার কাছে গিয়ে বললাম গাঁজা বানিয়ে দিতে। বিনিময়ে আমি তাকে এক পোঁটলা গাঁজা আর দুইটা শেখ হোয়াইট দিব। সে আমাকে বসতে বলল। আমি বসলাম রেলিং এর পাশে। তাকে ব্লেড আর সব জিনিস বের করে দিলাম। সে বলল,"ব্লেড কীজন্য?" আমি বললাম,"গাঁজাপাতা কাটার জন্য।" সে জানাল ব্লেড লাগবে না। সে একটা পোটলা খুলে হাতের তালুতে ঘস্তে লাগলো। একটু পর বলল,"দেখছ? গুঁড়া হই গেছে।" তারপর সে একটা শেখ হোয়াইট সিগারেটের ভেতর থেকে তামাক বের করে গাজার সাথে মিশাল। তারপর কায়দা করে ঢুকাতে লাগলো সিগারেটের ভেতরে। ঢোকানো শেষ করে মুখ মুচড়ে আমার হাতে দিল। আমি ধরিয়ে টান দিলাম। গা গুলিয়ে উঠল। সিগারেটের মত তিতা না। কিন্তু গন্ধটা উৎকট। সে এর মধ্যে আরেকটা বানানো শুরু করেছে। আমাকে জিজ্ঞেস করল বড়লোকের ছেলে কেন গাঁজা খাচ্ছি। আমি বললাম এমনি। সে আমাকে বলল গাঁজা খেয়ে জীবন নষ্ট করার দরকার নেই। এর চেয়ে কোন খাবার খেলে ভাল হত। আমি তাকে জানালাম আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। একটা ভুল ঠিকানা দিলাম। এর মধ্যে দেখি পাশের ঝুপড়ির কাছে একটা মহিলা এসে দাঁড়িয়েছে। সে ভেতরের আরেক মহিলাকে ডেকে জানালো কাস্টমার পাওয়া গেছে। ভেতরের মহিলা ঘুম ঘুম চোখে জানাল তাঁর নাকি শরীর খারাপ। যেতে পারবে না। আমি বুঝলাম এরা নিশিকন্যা টাকার বিনিময়ে ভালবাসা(!) বেচাকেনা করে। এরকম একজন আমার কাছে এসে ম্যাচ চাইল। আমি তাকে ম্যাচ দিলাম। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল আর কিছু লাগবে নাকি। আমি বললাম, "না।" টানতে থাকলাম গাঁজা। সুখটান। কিন্তু কিসের কি? স্টোনড হওয়া দূরে থাক কাদাপানিও হতে পারলাম না। লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম কিছু হয় না কেন। সে আমাকে লম্বা টান দিতে বলল। দিলাম। কিন্তু তাও কিছু হল না। সে আরেকটা বানানো শেষ করে আমার হাতে দিল। বলল আরেকজনের জিনিস নাকি সে খায় না। তারপর শেখ হোয়াইট ধরিয়ে টানতে লাগলো। আমাকে বলল টানা শেষ করে বাসায় চলে যেতে। আমি বললাম আমি স্টেশনে রাত কাটাব। সে তারপর নিজের কথা বলতে শুরু করল। সে রিকশা চালায়। আমার মত অনেকেই নাকি আসে। তারা ১০-২০ টাকা দেয়। আমি আরেকটা ধরিয়ে টানা শুরু করেছি এর মধ্যে। সে একটা লোককে ডাকল। আমাকে বলল চলে যেতে। আমি চলে এলাম স্টেশনে থাকা আর সুবিধার মনে হল না। আমার কিছু হল না কেন বুঝলাম না। তবে পুরা গলা শুকিয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে মরুভূমি। একটা দোকানে গিয়ে ২ গ্লাস পানি খেলাম। তারপরও তৃষ্ণা মরে না। হাঁটা দিলাম। ভাবতে লাগলাম কক্সবাজার কীভাবে যাব। তারপর মনে হল রাতটা কাটিয়ে নিই। সকালে দেখা যাবে। সিআরবির দিকে যাব ঠিক করলাম। রাত মাত্র ১২টা বেজেছে। এর মধ্যেই এত কিছু! ভাবতে লাগলাম নেশার জিনিস এত সস্তা? এভাবে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়? রাস্তা পার হতে গিয়ে নিউ মার্কেটের আগে আমাকে আরেকটু হলে বাস চাপা দিয়েছিল। রাতের বেলা এরা গাড়ি রকেটের মত টানে।
(চলবে..)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১২:২৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


