somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আচ্ছা, আমি কি অনেক বড় পাপ করে ফেললাম?

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৮:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফরিদপুরের নামকরা এক হোটেলের নিচের একটা সেলুনে ছোটবেলায় বাবার সাথে যেতাম চুল কাটাতে। চুল কাটানোকে বরাবরই আমার খুব বিরক্তিকর কাজ বলে মনে হয় যদিও। সেলুনটা আমার কাকার বন্ধুর, আমাদের বাড়ির পাশেই বাড়ি। আমি গেলেই কাকা অথবা তার বোনের জামাই অনেক সময় নিয়ে যত্ন করে আমার চুল কাটতো। কাকা আছেন, কিন্তু তার বোনের জামাই বেঁচে নেই। সেই বিধবা পিসি এসেছিলেন বাসায়। পা ফুলে ঢোল হয়ে আছে তার, নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে। সেই পা নিয়েই খুব কষ্টে হেঁটে হেঁটে এসেছেন।
.
আমার মা ডিএইচএমএস ডাক্তার, মানে হোমিও ডাক্তার। এলাকায় বেশ নামজশ আছে, তবে খুব সামান্য পয়সায় ওষুধ দেয় বলে কেউ কেউ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। ১৮ বছর ফরিদপুর শ্রীঅঙ্গন দাতব্য চিকিৎসালয়ে মাত্র ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা মাসিক বেতনে সেবা দিয়েছেন। রোগীপ্রতি ৫টাকা ভিজিট ছিলো, যে পারতো না সে দিতো না। ওষুধ সরবরাহ করতো বাজারের মারোয়ারিরা। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর এলাকার প্রভাবশালীরা মন্ত্রী লোক পরিচয় দিয়ে সেখান থেকে আমার মাকে নানাভাবে অপমান করে সরিয়ে অন্য কাউকে বসানোর চেষ্টা করেছে। ঢাকায় থাকতে মা আমার কাছে এসব বলতো না, কিন্তু ফরিদপুর ফিরে দেখে প্রতিবাদ করেও ফল না পেয়ে নিজে থেকেই মাকে বসতে মানা করেছি।
.
তো, সেই দাতব্য চিকিৎসালয়ের সুবাদে মা দুঃস্থ জনগণের কাছে সেই ৫টাকা ১০টাকার ডাক্তারই রয়ে গেছে৷ এখন খুব সীমিত পরিসরে বাসাতেই টুকটাক রোগী দেখে, শিক্ষকতার পাশাপাশি। মা নিজেও অসুস্থ। অনেক সময় দেখি পাশের বিহারী কলোনির থেকে মহিলারা আসে ওষুধ নিতে। নেওয়া শেষে মা যখন খুব কষ্টে ৩০ টাকা চায়, তারা তখন কোছের ভেতর থেকে ১০টাকা বের করে বলে বাকি টাকা পরে দেবো। বাকির নাম তো ফাঁকি, কেউ কেউ দেয়, যারা দেয় না মাও ভুলে যায়। সামর্থবান কেউ কেউ এসেও বলে, 'ছেলের জন্যে চিপস কিনতে আইছিলাম দুকানে, তাই ১০টাকা আছে। কাকি পরে দিবানে..'
.
আমার মায়ের ওপর আমার তখন রাগ হয়। সে মুখ ফুটে বলতেও পারে না যে এই ওষুধ তো আর ফ্রিতে কেউ দেয় না, বাসার ওষুধ আমাকে বাজার থেকে কিনে আনতে হয়। আসা-যাওয়াতেই তো ১০ টাকা অটোভাড়া অথবা ৪০ টাকা রিক্সাভাড়া চলে যায়! অন্য ডাক্তাররা যখন ১০০-২০০ টাকা ভিজিটের কমে রোগীই দেখেন না, এমবিবিএস ডাক্তারের ভিজিট যেখানে কমপক্ষে ৫০০ টাকা, সেখানে তিনি ওষুধ দিচ্ছেন ১০ টাকায়, যা খেয়ে ওসুখ নিশ্চয়ই ভালো হয়, নাহলে আবার আসে কেন?
.
বাবাকেও একই কাজ করতে দেখেছি। আমার দাদু প্রয়াত কালীপদ গুহ ছিলেন বড় ব্রিজের ঢালের নামকরা শুকু ডাক্তারের কম্পাউন্ডার। তবে এটা তাঁর মূল পেশা ছিলো না। জমিদারি সামলানো আর অন্য কাজের পাশাপাশি এটা করতেন সেই স্বাধীনতাপূর্বকালে। সেখান থেকে তিনিও কিছু বিদ্যা দিয়ে যান বাবাকে। বাবা চাকরি ওকালতি লেখালেখির পাশাপাশি বিকেলে এলাকার কেউ এলে ফ্রিতেই তাকে ওষুধ দিতো। এমনকি ফরিদপুর শহরের অনেক বড় বংশের মহিলারা বাবার বুদ্ধি নিয়ে ছেলেসন্তানের মা হয়েছেন। কিন্তু আমাদের দুঃসময়ে তাদের কেউ পাশে এসে দাঁড়ায়নি। তাই এখন মন চাইলেও মাথা সায় দেয় না সমাজকর্মে।
.
সেই পিসিও মাঝে মাঝেই ওষুধ নিয়ে টাকা না দিয়ে চলে যান। আজকেও ১০টাকা নিয়ে এসেছেন। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন তুমি টাকা চাও না? মা বললো, ওর স্বামী তোকে খুব ভালোবাসতো। তোর বাবা থাকতে তুই চুল কাটাতে গেলেই কাটানো শেষে তোর জন্য খাবার কিছু নিয়ে আসতো। আমি বললাম, সে হয়তো বাবা তার কোনো বড় উপকার করেছিলেন তাই। মা বলে, ওর দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু ছেলেটা চুল কাটিয়ে ভালো পয়সা পেলেও মাকে দেখে না। খুব কষ্টে সে একটা এনজিওতে চাকরি করে খায়। ওর মতো আমিও তো একটা সময় খুব কষ্টে কাটিয়েছি, তাই আসলে আর না করতে পারি না। কষ্টের দিনেই ফিরাই নাই, আর এখন তো তুই চাকরি করিস! পাশের আরেক মহিলা ডাক্তারের কাছে যেতে বললেও যায় না, কারণ ঐ ওষুধে নাকি কাজ হয় না এবং ডাকাতি দাম রাখে।
.
এই কথা শোনার পর আমার কী করা উচিত আমি বুঝতে পারছি না। মাকে বললাম, ১০ টাকা দিয়ে তো অটোতে আসা-যাওয়ার খরচ হবে, বাকিটা? মা বললো, থাক বাবা, এনে দিস। এই বলে মা তাকে ওষুধ খাইয়ে দিলেন একটু, বাকিটা কাল এনে দিতে হবে। আমাদের কথা মনে হয় তিনি শুনে ফেলেছেন দূর থেকে। তাই যাবার আগে আর কত দিতে হবে জেনে নিয়ে মাকে বলে গেলেন, বাকি ৪০ টাকা ওষুধ নেওয়ার সময় দিয়ে যাবেন।
.
সেই থেকে আমার মনটা খারাপ হয়ে আছে।
আচ্ছা, আমি কি অনেক বড় পাপ করে ফেললাম?
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×