চোরকে আমি চোরই বলবো, সাধু বলবো না। ভালোকে ভালো বলা আর খারাপকে খারাপ বলার শিক্ষা আমি আমার বাবার থেকে পেয়েছি। কোনো চাপে বা কোনো ভয়েই আমি এই নীতি-আদর্শ থেকে সরে আসবো না। আমি যদি চোরকে চোর না বলি, তাহলে আমার মতো ১০ জনে অন্তত ৬ জনের সাধু থাকার কোনো মানে নেই। এখনও ১০ জনে ৬ জন সাধু আছে বলেই এই দেশ এখনও টিকে আছে।
.
আমার পরিবার, আমার ধর্ম আমাকে সাদা আর কালোর মধ্যে পার্থক্য করতে শিখিয়েছে। ধর্মীয় এবং পারিবারিকভাবেই আমি পেয়েছি পরমতসহিষ্ণুতা। কেউ যদি আমার গঠনমূলক সমালোচনা করে, আমি তাকে আমার বন্ধু ভাবি। কারণ সে আমার দোষত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে আমাকে আরও পরিশুদ্ধ আরও নিখুঁত মানুষে পরিণত হতে সাহায্য করছে।
.
অপরদিকে যে সারাক্ষণ আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়, আমি তাকে নিয়ে ও তার বিশ্বস্ততা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করি। আমি সবসময় আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে তার দিকে বাড়তি নজর রাখি। আমি জানি, আমার একটু দুর্বলতা বা একটু বিশ্বস্ততার পলক ফেলার মুহূর্তটুকুতেই সে আমার বুকে ছুরি চালিয়ে দিতে পারে।
.
ভিন্নমত এবং নতুন আইডিয়াকে স্বাগত জানানোই প্রকৃত বিচক্ষণ শাসকের কর্তব্য। এজন্যই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, 'যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, ... আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও তার কথা মেনে নেবো'।
.
এই দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন এই সংবিধান আমাদেরকে সেই অধিকার দেয়। কিন্তু এই অধিকারকে অপব্যবহার করা যাবে না। যার যেই সেক্টরে জ্ঞান কম সেই সেক্টরে তার কথা না বলাই ভালো। সবাই সবার জ্ঞান দিতে থাকলে 'অধিক সন্ন্যাসীতে গাঁজন নষ্ট' হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। আবার সবার মত যে আমলে নিতেই হবে, এমনও কোনো কথা নেই।
.
আজকাল দেখা যায় হাতে হাতে স্মার্টফোন আর ঘরে ঘরে ফেসবুকের কারণে মূর্খ ধর্মান্ধ উগ্রবাদে বিশ্বাসী লোকেরাও ফেসবুকে এসে জ্ঞান বিতরণ করছে। তারা ধর্মগ্রন্থের অপব্যাখ্যা দাড় করিয়ে সাধারণ স্বল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিতদের মনে ভুল বার্তা দিচ্ছে। এই যেমন ফেসবুকেই ভেসে বেড়াচ্ছে কিছু ইসলামি স্ক্লারের ওয়াজের ভিডিও, যাতে তাঁরা দাবি করেছেন মুসলিমদের করোনা হবে না, হলে নাকি কোরআন মিথ্যা হয়ে যাবে! আরেকজন বিজ্ঞানী হুজুর কী সব বৈজ্ঞানিক অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মকে হাস্যরসের পাত্র বানাচ্ছেন। তিনি নাকি করোনাভাইরাসের সাথে কথাও বলেছেন কেন এসেছে সে, কতদিন থাকবে এসব নিয়ে। করোনাভাইরাস নাকি তাকে বলেছে সে শূধু ইহুদি-নাসারাদের মারতে এসেছে, চীনে মুসলিমদের ওপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে এসেছে! এখন তাহলে মুসলিমরা কেন আক্রান্ত হচ্ছে? এই প্রশ্নের জবাব তাদের কাছে চাওয়ার আগেই কেউ দেশ ছেড়ে মালয়েশিয়ায় গিয়ে ভক্তদের বিপদে রেখে নিজেকে আগে নিরাপদ করেছেন, আবার কেউ দেশেই কোথাও গা ঢাকা দিয়ে আছেন।
.
মুসলিমদের করোনা হবে না বলে যারা ধর্মপ্রাণ বা ধর্মান্ধ মুসলিম ভাইদেরকে সরকারি নির্দেশ মানতে নিরুৎসাহিত করলেন, তাদের কাউকে কি জনস্বার্থে গ্রেপ্তার করা হয়েছে? যারা কোরআন মিথ্যা হয়ে যাবে বলে পবিত্র ধর্মগ্রন্থকে অপমান করেছেন, তাদেরকে কি আইনের আওতায় আনা হয়েছে? এখনও যদি দেশের প্রতিটা এলাকার কেবল লাইনে একটা বা দুইটা স্পেশাল চ্যানেলে ২৪ ঘন্টা তাদের বয়ান প্রচারিত হতে থাকে, যদি হাজারে-লাখে প্রচলিত শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ধর্মান্ধ কিছু লোক একের পর এক মিথ্যা প্রপাগান্ডা চালাতে পারে, তাহলে জ্ঞানী সমাজ বিদগ্ধ গুণীজন সরকারি চাকুরেরা চোরকে চোর আর দুর্নীতিবাজকে দুর্নীতিবাজ বললে সমস্যা কোথায়? তাঁরা যদি কোনো সিদ্ধান্তকে সঠিক মনে না করে এর চেয়েও ভালো কোনো আইডিয়া দিতে পারে, তা কি যাচাই করে গ্রহণ করা উচিত নয়? বুদ্ধিজীবীদের মুখ বন্ধ করে দিলে দেশের উন্নতি হবে কীভাবে? শিক্ষক বুদ্ধিজীবীরা কথা বল্বেই, কলম চালাবেই। তবে সেটা যেন রাষ্ট্রের পরিপন্থি না হয়ে রাষ্ট্রের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য হয়। এবং, 'সরকার' ও 'রাষ্ট্র' এই দুটি শব্দকে যেন আমরা গুলিয়ে না ফেলি।
.
আমি বিশ্বাস করি, জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা যে সরকারের প্রধান, সেই সরকার পরপর তিনবার সাফল্যের সাথে দেশ চালিয়ে আসার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সরকার, যা সকল ধরণের অপব্যাখ্যা প্রদানকারী, সরকারের কাজে সহযোগিতা না করে বরং সাফল্যের বিরুদ্ধে অপপ্রচারকারী এবং সরকারকে বিপদে ফেলতে সচেষ্টদেরকেই আইনের আওতায় আনবে।
.
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলে গেছেন, 'যত মত, তত পথ'। অন্যের মত আমি গ্রহণ করি বা না করি, সেটা আমার ব্যাপার। কিন্তু মতটাকে আমার কান পর্যন্ত আসতে তো দিতে হবে! কে জানে, হয়তো সেই মতের থেকেও বেরিয়ে আসতে পারে এমন কোনো প্রাণসঞ্চারি মন্ত্র, যা দিয়ে অনেক ক্ষমতাধর অসুরকেও অনায়াসেই বধ করা যায়! যোগ্যতম লোকটিকে সঠিক জায়গায় বসানোটাও অতীব দরকারি।
.
এই মহাদুর্যোগে, গুজব না ছড়িয়ে কিংবা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে আমাদের সবার উচিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাতকে যার যার অবস্থান থেকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখা।
.
জয় বাংলা।
.
(একান্তই ব্যাক্তিগত মত। কোনো বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে নয় বা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক মতামত নয়। বলতে পারেন, একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে এই জ্ঞানদান। )