বিদ্যানন্দের কর্ণাধার কিশোর দাসের সাথে আমার যদি পরিচয় থাকতো, তবে আমি তাঁকে ব্যাক্তিগতভাবে পরামর্শ দিতাম যত দ্রুত সম্ভব ফাউন্ডেশনের সবকিছু কোনো মসজিদ, মাদ্রাসা বা জাকাত ফাউন্ডেশনকে দিয়ে পারলে রাতের প্লেনেই স্ত্রীর কাছে ফিরে যেতে। এতে তিনি রাতারাতি হিরো হয়ে যেতেন, তাঁর ও তাঁর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ওঠা সকল অভিযোগ আর কুৎসা মুহূর্তেই হারিয়ে যেতো। আমি তাঁকে প্রশ্ন করতাম, আপনি উচ্চশিক্ষিত প্রবাসে সেটেলড মানুষ, কেন শুধু শুধু অন্ধের দেশে আয়না বিক্রি করতে এসেছেন?
তবু যদি তিনি তাঁর সুন্দরী বিদেশী স্ত্রীকে রেখে মানবতার সেবার ইচ্ছায় থেকে যেতেই চান এই মরার দেশে, ফাউন্ডেশনের থেকে কিছুই নেয়ার ইচ্ছা নাই তা প্রমাণ করতে নিঃসন্তান থেকে ফাউন্ডেশনটি যদি তিনি চালিয়ে যেতেই চান, তবে তখন আমার ব্যাক্তিগত পরামর্শ থাকতো বিদ্যানন্দের নামটা 'মদিনানন্দ' কিম্বা 'খেদমত-ই-ইসলাম ফাউন্ডেশন' রাখতে, নিজে মুসলিম হয়ে যেতে এবং ক্ষমতাবানদেরকে খুশি করে চলতে। সবচেয়ে ভালো হয় উগান্ডার নির্বাচনী ফান্ডে কিছু ঢেলেঢুলে দিলে। আমার বিশ্বাস তখন দেশজুড়ে বরং ধন্যধন্য রব উঠতো।
কথায় আছে, দান করতে হয় এমনভাবে যেন এক হাতে দান করলে অন্য হাত না জানে। এটা পবিত্র ধর্মগ্রন্থেই আছে। তো, বিদ্যানন্দ যদি সমাজের পীড়িত, বঞ্চিত, ধর্ষিতা, অসহায়, নির্যাতিতদের সাহায্য করে, এক টাকায় আহার তুলে দিয়ে যদি সেই উপকারভোগীর পরিচয় গোপন রেখে ছদ্মনাম 'মজিদ' রাখে, তাতে দোষের কী আছে আমি বুঝি না। আমি এটাও বুঝি না, একই গরুর ছবি দিয়ে দুই ঈদে দুঃস্থদের জন্য সাহায্য চাওয়া যাবে না কেন! বুঝি না এটাও ভুল করে ছবির কোলাজে অন্য কারো ডিজাইনের ছবি ঢুকে গেলে এবং এই ভুলের জন্য প্রকাশ্যে পোস্ট দিয়ে ক্ষমা চাইলে কেন ক্ষমা না করে এ নিয়ে ট্রল করতে হবে!
যে কাজ করে, তারই ভুল হয়। কাজ না করে অন্যের টাকা মেরে খায় যারা, তাদের এত সিলি মিস্টেক হয় না। তারা বিশেষজ্ঞ চোরের দল, ভণ্ড, প্রতারকদের বেতন দিয়ে পুষেই চুরিবিদ্যায় নামে। বিদ্যানন্দ শুধু কাজ করে না, সে এক মহাযজ্ঞের নাম। আমি কাছ থেকে দেখিনি, কিন্তু যা শুনি ও দেখি, তা আমাকে মুগ্ধ করে। এত বড় মহা কর্মযজ্ঞের সাথে যারা জড়িত তাদের বেশিরিভাগই শুনেছি স্বেচ্ছাসেবী। অর্থাৎ তারা এই কাজের জন্য কোনো টাকা নেন না, শুধুই মানবতার সেবায় কাজ করেন। তো তাদের কাজে ভুল হবে, এটাই স্বাভাবিক।
প্রত্যেকবার গরুর চালান এলে নতুন নতুন গরুকে আলতা-স্নো-পাউডার মেখে তো আর তারা পোস্ট করবে না, তাই না? দান গ্রহণকারীর নাম, ছবি, পরিচয় প্রকাশ করে যদি তারা ফেসবুকে পোস্ট দেয়, তাহলে কি সেটা ঠিক কাজ হবে? তাই এসব ক্ষেত্রে বিশ্বাস করেই দিতে হয়। রাস্তায় অন্ধ সেজে বা অদৃশ্য মাদ্রাসার নামে কতজনই তো কত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে! সবাই তো আল্লাহ বা ভগবানের নামেই দেয়! এমনকি কিশোরগঞ্জের সেই বিখ্যাত পাগলা মসজিদের দানবাক্স খুললেই যে টাকার খনি পাওয়া যায়, তা কে বা কারা দেয়, সেই টাকা কোথায় কাদের পিছে বজায় হয়, জঙ্গিবাদে সেই অর্থের যোগান যাচ্ছে কিনা, তা নিয়ে কি কেউ কোনোদিন প্রশ্ন তুলেছে? আমি শুনিনি। তাহলে বিদ্যানন্দের অনিচ্ছাকৃত ভুল ও অপেশাদারি ছবি এডিটিং নিয়ে কিম্বা বারবার দান গ্রহণকারীর একটাই নাম মজিদ রাখা আজ নিয়ে এত হইচই কেন? তাও আবার ঈদের মাত্র সপ্তাহখানেক আগে?
কারণ একটাই হতে পারে। আর তা হচ্ছে, বিদ্যানন্দ একটি হিন্দুপ্রধান প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানটি জাকাত ও ফিতরা নিয়ে যারা ব্যবসা করে, তাদের ধান্দায় হাত দিয়েছে। পাশাপাশি অতিলোভী কিছু প্রভাবশালীও হয়তো পারসেন্টেজ চাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, এটা এমন এক দেশ,যেখানে একজন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও এতিমের টাকা মেরে খাওয়ার অভিযোগ ওঠে। যে যেভাবে পারে, সেভাবেই অন্যকে ঠকিয়ে খায় এই সমাজে। প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই নাকি দুর্নীতিগ্রস্ত, এমন খবর পত্রিকার পাতায় দেখতে পাই। দুর্নীতিতে বারবার চ্যাম্পিয়ন দেশটি এখন উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষ এই যুদ্ধের বাজারেও খেয়েপড়ে বেঁচে আছে, দানশীল মানুষ একটা দান করার বিশ্বস্ত জায়গা পেয়েছে, তা অনেকেরই সহ্য হচ্ছে না।
ফাউন্ডেশনের প্রতি মানুষের বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টায় কিশোর দাসের নিঃসন্তান থাকা তাই হাস্যকর সিদ্ধান্তই অনেকের কাছে। ভালো কাজ করলেও শুধু হিন্দু বলে তাঁর যেহেতু বেহেশত নসিব হবে না, তাঁর প্রতিষ্ঠানে দান করলে সেই দানের বিনিময়ে ধর্মীয় স্কলারদের ভাষ্যমতে যেহেতু সওয়াব প্রাপ্তি হবে না, আর তা দিয়ে নিজে বেহেশতে যাওয়া যেহেতু যাবে না, কাজেই বিদ্যানন্দকে দান না করে সামান্য ভুলটুকুও ধরে তাকে গালি দিয়ে ট্রল করে ভেতর থেকে মনোবল ভেঙে পঙ্গু করে দাও! এটাই ওদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। বিদ্যানন্দ শেষ হয়ে গেলেই বিজনেসে আর কোনো পথের কাঁটা থাকবে না!
কিশোর দাসরা এমনিতেই বিদেশ চলে যায় না। প্রতি বছর হাজার হাজার উচ্চশিক্ষিত মেধাবী কিশোর দাসেরা এমনিতেই পিএইচডি করার নামে চিরতরে কানাডা-অস্ট্রেলিয়া-আমেরিকায় চলে যায় না। লিটন দাস যেমন খারাপ খেললে তা নিয়ে ট্রল বেশী হয়, সেই পারসেন্টেজে ছাড় দেওয়া হয় দোকানে, তেমনি ভালো খেললে সেই আনন্দেও কেউ দেখলাম না আজ পর্যন্ত খুশীতে লিটনের ঐ রানের পারসেন্টেজে ছাড় দিতে বা বিনামূল্যে গরিবকে খাওয়াতে। কারণ, একটি শ্রেণি মনে করে এই দেশে দাসেরা তাদের দাস, তাদের আশ্রিত। তারা ভুলে যায়, কিছুকাল পূর্বেই একটা সময় ওদের পূর্বপুরুষরাও দাসই ছিলো! ওরা বোঝে না, ধর্ম দিয়ে মানুষকে বিচার করা উচিত নয়, তা করতে হয় ব্যক্তির কর্ম দিয়ে।
কিশোর দাস এখন যাই করেন, আশা করি, অতি স্বত্বর অভিযোগগুলোর বিষয়ে কথা বলতে লাইভে আসবেন। ওদের সঙ্গে আপোষ নয়, নিজের কাজে অবিচল থাকবেন। কিছুতেই অপরিচিত অবিশ্বস্ত কাউকে দলে নেবেন না, কারণ আজ ভুল পোস্টের কারণে ট্রল হচ্ছেন, কাল ভেতরের কোনো বহিরাগত এজেন্ট এক টাকার আহারে বিষ মিশিয়ে তাঁকে ফাঁসির কাষ্ঠেও ঝুলাতে পারেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ১০:২৮