somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কামেহামেহা, মানোয়া পাহাড় এবং আলোহা। পর্ব-৪(ক)।

১৩ ই আগস্ট, ২০০৮ ভোর ৪:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গুরুর অন্বেষণ এবং ভগবানের রক্তচক্ষু

বাংলাদেশের লেখাপড়ার সিস্টেম নিয়ে অনেক গুণীজনে অনেক কথাই বলেছেন। সেখানে আমার আর নতুন করে কিছুই বলার নেই। তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দু চারটে জিনিস এখানে সংক্ষেপে বলতে চাই।

প্রথমেই বলে নেই (যদিও এই কথাটাই আগেও অনেকবার ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছি) একটি গরীব দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পড়াশুনার মান আমার কাছে যথেষ্ট উন্নত বলে মনে হয়েছে। তার উপর আমার শিক্ষকেরা যে পরিমাণে কষ্ট করে আমাদেরকে পড়িয়েছেন তার তুলনা মেলা ভার।

আমার সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়। বাংলাদেশের আমার গোটা ছাত্রজীবনে আমি যা যা পড়েছি তার কোনকিছুই আমি নিজে বেছে নেইনি। প্রত্যেক জায়গাতেই সিলেবাসে যে যে কোর্স ছিল তার সবগুলোই পড়তে হয়েছে আমাদের সবার। এটাকে একধরণের স্পুন-ফিডিংও বলা যেতে পারে।

সমস্যা হোল যখন বিদেশে গেলাম। প্রত্যেক সেমেস্টারের আগে মাথা গরম হয়ে যেতো কি কোর্স নেবো সেই চিন্তায়। ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি নেবো, নাকি ফিজিওলজি? বায়োকেমিস্ট্রি নাকি অরগানিক কেমিস্ট্রি? কোনটার শিক্ষক খুব ভাল কিন্তু তার হাতে ভাল গ্রেড পাওয়া রীতিমত ভাগ্যের ব্যাপার। আবার কোনটার বিষয়বস্তু খুব ভাল কিন্তু তার শিক্ষক সাহেব নাকি একদম পড়াতেই পারেন না। এক দুই সেমেস্টার পরে অবশ্য কিছুটা সয়ে আসে। তখন কোর্স নিয়ে অতটা মাথা ঘামাইনে। কঠিন পড়াশুনা করতে হবে সবগুলোতেই, এটাই হচ্ছে ধ্রুব সত্য। বিরাট বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলি ঘনঘন। বড়ই কষ্টের জীবন।

আমেরিকায় এসেছি পি এইচ ডি করতে। শুনেছি ব্রিটেন বা জাপানে নাকি কোন রকম কোর্স-টোর্স নেবার বালাই নেই। প্রথম দিন থেকেই ঢুকে পড়তে হবে কোন একটি ল্যাবে। প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় রিসার্চের কাজ।

আমেরিকায় নিয়ম অন্য। আমাদের লাইনে প্রথম দু বছর শুধু কোর্সওয়ার্ক আর কোর্সওয়ার্ক। পরীক্ষা দিতে দিতে পেটের বাঁধন ছিড়ে যাবার জোগাড়। শুধু থিওরী ক্লাশ নিলেই হবেনা, এর সাথে সাথে নিতে হবে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশ। এর সাথে আছে সেমিনার কোর্স। তার জন্যে লাইব্রেরীতে বসে জার্নাল ঘেঁটে তৈরী করতে হবে প্রেজেন্টশন। তাতেও মাপ নেই, বক্তৃতা দেওয়া শেষ হলে অন্য ছাত্র আর টীচারদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।

কোর্সওয়ার্কের পালা শেষ হবার পর আসবে কম্প্রিহেনসিভ পরীক্ষা। যতই ভাল রেজালট থাকুক না কেন, এটাতে যদি কেউ পাশ না করে তাহলে গাটঠি-বোঁচকা বেঁধে এখানকার পড়াশুনার পাট চুকাতে হবে।

কম্প্রিহেনসিভ পরীক্ষার দুশ্চিন্তায় যখন মুখ শুকিয়ে আসে তখন মুরুব্বীরা বলেন, "আল্লাহ্‌র কাছে শুকুর করো।"
আমি বুঝিনা, "এই কঠিন পরীক্ষার জন্য শুকুর করবো? কি বলেন এইসব?"
তাঁরা হাসেন। "হ্যাঁ শুকুর করবে এই জন্যে যে তুমি ইকোনমিক্স এর ছাত্র না।"
"কেন তাদের আবার কি হলো?"
"ইকোনমিক্স এর ছাত্রদের সাতটা কম্প্রিহেনসিভ পরীক্ষা। এর মধ্যে যে কোন একটাতে ফেল মারলেই খেল খতম, পয়সা হজম।"
"বলেন কি? সাতটা পরীক্ষা?"
মুরুব্বী আবারো মিটিমিটি হাসেন। "আর তুমি কিনা একটা কম্প্রিহেনসিভ পরীক্ষার গল্প শুনাচ্ছো!"

কম্প্রিহেনসিভ পরীক্ষার পর আসবে থিসিস প্রপোজাল ডিফেন্স। সেখানে থিসিস কমিটি দেখবেন যে আমার থিসিস বিষয়ক প্ল্যানটি কেমন। তারপর শুরু হবে আসল গবেষণা। দীর্ঘ পথ। কি কুক্ষণে যে আমেরিকায় এসেছিলাম!

এর ভিতরে তলে তলে বাড়তে থাকে আর একটি দুশ্চিন্তা। কি নিয়ে গবেষণা করবো? এবং কে হবেন আমার গুরু? দেশে যখন ছাত্র ছিলাম তখন মনে মনে কত কি কল্পনা করেছি। বিরাট গবেষক হবো, যুগান্তকারী কোন কিছু আবিষ্কার করবো, নোবেল প্রাইজ পাবো। দেশ ওর দশের মুখ উজ্জ্বল করবো। কিন্তু একজ্যাক্টলি কি নিয়ে কাজ করবো তা কোনদিন চিন্তা করিনি।

তার পরের প্রশ্ন, কার সাথে কাজ করবো? মাঝে মাঝে একটা দুটো প্রফেসরের ল্যাবে হানা দেই। সেখানে কাজ করে এমন দু একজনের সাথে কথা বলি। কারো কথা শুনেই মনে উৎসাহ পাইনা।

এর মধ্যে কতিপয় মুরুব্বী উপদেশ দিলেন যে তাড়াতাড়ি যে কোন একটা ল্যাবে ঢুকে কিছু একটা কাজ শুরু করে দিতে। আমি অবাক হলাম।
"যাকে জানিনা শুনিনা, তার সাথে কাজ করবো কিভাবে? আর তার উপর আমার গবেষণার বিষয়টাওতো ঠিক করিনি এখনো।"
"আরে শোন-প্রফেসরকে জানবার জন্যেইতো তার ল্যাবে কাজ করবে। সামনেই সামার আসছে। সামারে কোন গ্রাজুয়েট লেভেল কোর্স অফার করা হয়না। কি করবে তাহলে? হালে মানোয়ায় শুয়ে শুয়ে ঘুমাবে নাক ডেকে? তার চেয়ে বরং যে কোন একটা ল্যাবে ঢুকে পড়ো সামারের জন্যে। ভাল না লাগলে পরের সেমেস্টারে অন্য ল্যাবে চলে যেও।"

বুদ্ধি মন্দ না। কিন্তু আবারও সেই আগের সমস্যা? কোন ল্যাবই তো ভাল লাগে না।

একদিন আমাদের ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরীতে বসে বসে জার্নাল পড়ছি। এমন সময় ঢুকলেন ডঃ হামফ্রিস বলে আমাদের একজন প্রফেসর। তিনি মলিকুলার বায়োলজি নিয়ে কাজ করেন।

"কি হে-কি খবর তোমার?"
"এই চলছে কোন রকম। সামনে একটা সেমিনার আছে। তার জন্যে মাল-মশলা রেডী করছি।"
"সামার তো চলে এলো প্রায়। তুমি কি থাকবে এখানে নাকি দেশে যাবে?"
"এখানেই থাকবো, কিন্তু কি করবো তাই খুজে পাচ্ছিনা। নেবার মতো কোর্সতো কিছু নেই সামারে।"
"সামারে কোর্স নেবে কেন? সামারে কাজ করবে কারো সাথে। এটাই তো সবচেয়ে ভাল সময়।"
এ কথায় আমার মুখ ভার হয়ে আসে।
"সেটাই তো সমস্যা। কার ল্যাবে কাজ করবো এটাই তো বুঝে উঠতে পারছিনা।"

ডঃ হামফ্রিস এবারে হাসেন। "আমি জানি তুমি কি বলতে চাচ্ছো। তুমি একটা কাজ করতে পারো।"
"বলো। আমি যেকোন সাজেশনই শুনতে প্রস্তুত।"
"সম্প্রতি এখানকার ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারে একজন নতুন গবেষক এসেছেন। জন বার্ট্রাম। উনি বেশ ইন্টারেস্টিং কাজ করেন। তুমি তার সাথে যেয়ে কথা বলে দেখতে পারো। আমার কেন জানি মনে হয় তুমি কাজকে পছন্দ করবে।"
"ক্যান্সার সেন্টার? সেটা আবার কোথায়। আমিতো ক্যাম্পাসে কোথাও এ জাতীয় কোন জিনিস দেখিনি।"
"হনলুলুর ক্যান্সার সেন্টারটি ক্যাম্পাসের বাইরে। প্রায় তিন মাইল দূরে। ড্রাইভ করে যেতে পাঁচ-সাত মিনিট লাগবে তোমার।"
আমি আমতা-আমতা করি। "আমি গাড়ী ড্রাইভ করতে পারিনে। আর তাছাড়া আমার কোন গাড়ীও নেই।"
"তাতে সমস্যা নেই। বাসে করেও তুমি ওখানে যেতে পারবে। সময় একটু বেশী লাগবে এই যা।"
"সে নাহয় হোল। কিন্তু উনি তো আমাদের ডিপার্টমেন্টের বাইরের লোক। আমার তো ধারণা ছিল যে কেবল বিভাগের শিক্ষকদের ল্যাবেই শুধু ছাত্ররা কাজ করতে পারে।"
"সেটা ঠিক কথা। তবে জন বার্ট্রাম আমাদের বিভাগের সাথে কিছুটা যুক্ত আছেন। তবে তার ওখানে কাজ করতে গেলে তোমাকে আমাদের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে আগে পারমিশন নিতে হবে।"
"আমাদের বিভাগের চেয়ারম্যান?"
"ইয়েস। দি গ্রেট ডঃ ভগবান। তবে মনে হয়না সে কোন আপত্তি করবে।"

এক শুভদিনে আমি ম্যাপ-ট্যাপ দেখে বুকে ফুঁ দিয়ে বাসে উঠলাম। গন্তব্য তিন মাইল দূরে অবস্থিত ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টার। জন বার্ট্রাম এর সাথে দেখা করবো বলে।

(বাকী অংশ পরের পর্বে)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ১০:০২
১১টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×