গুরুর অন্বেষণ এবং ভগবানের রক্তচক্ষু
সেদিনটির কথা আজো মনে আছে আমার।
দিনটি ছিল রোদেলা, সকাল দশটার যুবক সূর্য্যের আলোতে ঝলমল করছিল চারিদিক। সেটা এমন নতুন কিছু নয়, কেননা হনলুলুতে বছরের বেশীর ভাগ দিনই এইরকম। বাস ড্রাইভারকে আগেই বলে রেখেছিলাম। সে আমাকে একটি রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিয়ে হাত উঁচিয়ে দেখিয়ে দিল কোথায় আমাকে যেতে হবে।
রাস্তা পার হয়ে আমি ওপারে যাই। বিলডিংটির সামনে ছোটখাটো একটি সাইনবোর্ড লাগানো। ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টার অফ হাওয়াই। পাঁচ-ছয় তলা হবে উচ্চতায়। দেখতেও খুব বেশী বড় না।
ভিতরে ঢুকে দেখা মেলে এক রিসেপশনিস্ট এর। সেই বললো, আমাকে তিন তলায় চলে যেতে। ডঃ বার্ট্রামের অফিসটি সেখানেই।
আগে থেকে ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল। বোধহয় সে কারণেই তিনি অফিসে ছিলেন। অফিসটি খুব বেশী বড় না, প্রায় পুরোটাই বই-পত্র দিয়ে ভরতি। খান দুয়েক চেয়ার আর একটা টেবিল ছাড়া আর সবখানেই কাগজপত্র দিয়ে ছড়ানো।
আমি সবচেয়ে অবাক হলাম তাঁকে দেখে। আমি ভেবেছিলাম যে তার বয়েস অনেক হবে। কিন্তু দেখে মনে হোল পয়তাল্লিশের বেশী না। ভদ্রলোক ব্রিটিশ, কিন্তু তার কথায় খুব বেশী ব্রিটিশ অ্যাকসেন্ট নেই। পরে জেনেছি যে হনলুলুতে মুভ করার আগে উনি অনেক বছর নিউ ইয়র্কে ছিলেন। বোধহয় সেখানেই আস্তে আস্তে ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টের সমাধি হয়েছে।
আমাদের মধ্যে বেশ খোলামেলা আলোচনা হোল। উনি কাজ করেন অ্যান্টি-ক্যান্সার জিনিসপত্র নিয়ে। বর্তমানে তার ফোকাস, ভিটামিন এ।
কথা শেষের পরে উনি আমাকে তার ল্যাব দেখাতে নিয়ে গেলেন। ল্যাবটি দেখেই আমি সেটির প্রেমে পড়ে গেলাম। বেশ বড়সড় ঘরটি, সেখানে অনেকগুলো সারিসারি বেঞ্চে কাজ করছে কয়েকজনে। পুরো ল্যাবটাই একদম ঝকঝকে নতুন। দেয়ালের রং হাল্কা কমলা। যন্ত্রপাতিগুলোও চকচক করছে যেন।
সমস্যা একটাই, গোটা ল্যাবে কোন জানালা নেই। তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসেনা। বরং ভালই আমার জন্যে। জানালা থাকলে হয়তোবা গালে হাত দিয়ে বাইরের জগতকে দেখেই সময় কাটিয়ে দেবো। গবেষণার গ ও হবেনা।
মূল ল্যাবের পাশে আরো একটি ঘরে ঢুকলাম আমরা। পুরো ঘরটিতে হালকা বেগুনী রং এর আলো জ্বলছে। কেমন একটা স্বপ্ন স্বপ্ন ভাব। আলো-আঁধারীর এই ঘরটিতে ঢুকেই আমার চোখে কেমন যেন ঘোর লাগে। ভরপেট খেয়ে এই ঘরটিতে ঢুকলে দু মিনিটের মধ্যেই যে কারোর চোখে ঘুম নামতে বাধ্য।
ডঃ বার্ট্রাম খুট করে দেয়ালের একটা সুইচ টেপেন। মুহুর্তের মধ্যে নিভে যায় মৃদু বেগুনী আলোটি। উজ্জ্বল আলোয় ভেসে যায় ঘরটি। আমার স্বপ্নটিও দুম করে উধাও হয়।
"এই ঘরটিতে আমরা প্রাণীকোষের আবাদ করি। এইযে এ পাশের সারিসারি আলমারীর মতো জিনিসগুলো দেখছো, এদের নাম ইনকিউবেটর। এদের ভিতরে বাড়ছে প্রাণীকোষেরা। এখানে তাপমাত্রা, কার্বন-ডাই-অক্সাইড আর জলীয়বাস্পের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত যাতে করে কোষেরা ভালভাবে বাড়তে পারে।"
আমার দারুণ লাগে। বাহ-কি সুন্দর ব্যবস্থা!
"আর আমরা যে নীল আলোটি দেখেছিলাম প্রথমে, সেটি ছিল আলট্রা-ভায়োলেট রশ্মি। এই রশ্মি বাতাসে ভেসে থাকা ব্যাক্টেরিয়াদেরকে মেরে ফেলার জন্য যাতে করে ওরা আমাদের আবাদ করা প্রাণীকোষদের কোন ক্ষতি না করতে পারে। যাই হোক-তুমি কি কোষদেরকে দেখতে চাও?"
উত্তেজনায় আমার ভিতরটা কেঁপে ওঠে। মাথা নাড়ি সাথে সাথে। "নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।"
ঘরের দরজার কাছেই একটি ছোট্ট সিংক। ডঃ বার্ট্রাম সেখানে গিয়ে ভাল করে হাত ধোয়া শুরু করেন, তারপর আমার দিকে লিকুইড সাবানের বোতলটি ঠেলে দিলেন।
‘ভাল করে হাত ধোও এই সাবানটি দিয়ে। অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল সোপ এটি। আমাদের হাতের চামড়াতে নানান রকমের জার্ম থাকে। সেগুলোকে ঠেকানোর ক্ষমতা আমাদের থাকলেও ওই কোষেদের নেই। তাইই যতদূর সম্ভব জার্ম-ফ্রি হয়ে তারপর ওই আলমারী খুলি আমরা।’
হাত ধোয়ার পালা শেষ হলে ড্রয়ার খুলে একজোড়া আনকোরা প্লাস্টিকের গ্লাভস বের করে দিলেন তিনি। "এগুলো পরো। সাবানে যদি সব ব্যাকটেরিয়া না মরে, তার জন্যে এই ব্যবস্থা।"
গ্লাভসজোড়া হাতে একটু বড় হোল। যাদের অভিজ্ঞতা আছে তারা জানেন যে ঢিলেঢালা গ্লাভস হাতে পরতে কি রকম অস্বস্থি লাগে। কিন্তু কি আর করা? যাকগে আমিতো আর কোন কিছুতে হাত দিচ্ছিনা।
এরপর আর একটা ড্রয়ার থেকে বেরোলো মুখে লাগানোর মাস্ক। মেয়েদের প্রসাধনের মাস্ক নয়, এই মাস্ক হচ্ছে গিয়ে মুখে লাগানোর মুখোশ। এ কি ঝামেলায় পড়লাম রে বাবা!
ডঃ বার্ট্রাম আবার ব্যাখ্যা করেন। " প্রাণীকোষদের নিয়ে কাজ করার এই এক ঝামেলা। সব সময় খুব কেয়ারফুল থাকতে হয়। কখন কোথা থেকে ব্যাকটেরিয়া ঢূকে পড়ে এই ভয়ে আমরা সব রকমের সাবধানতা অবলম্বন করি। তুমি জানোই যে আমাদের নিঃশ্বাস থেকেও ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস বেরিয়ে আসতে পারে।"
আমার তখন একটু বিরক্ত লাগছে এত বায়নাক্কা সামলাতে হবে। আগে জানলে এর মধ্যেই ঢুকতাম না। হাত ধোয়া,তারপর হাত ঢাকা, তারপর মুখ ঢাকা। এরপর কি? এই চোখ দিয়ে যেহেতু কোষদের দেখবো, তবে কি এখন চোখজোড়াও ঢাকতে হবে নাকি?
আমার মনের কথা যেন ডঃ বার্ট্রাম পড়তে পারলেন। তৃতীয় ড্রয়্যার খুলে এবারে তিনি বের করলেন একজোড়া ল্যাব গগলস। "এগুলো লাগাও চোখে।"
"এটা আবার কেন?" এবারে আমি একটু আপত্তি জানাই।
"জেনারেল ল্যাব প্র্যাকটিস। যেকোন সায়েন্স ল্যাবে কাজ করতে হলে এটা চোখে পরতেই হবে। তাওতো ভাগ্য ভাল যে তোমাকে এ্যাপ্রন পরতে বলিনি। কিন্তু যদি তুমি এখানে কাজ করবে বলে সিদ্ধান্ত নাও, তাহলে তোমার জন্যে একটা এ্যাপ্রনের অর্ডার দেবো। বায়োলজিক্যাল ল্যাবে কাজ করতে গেলে এইসব বায়নাক্কাতে অভ্যস্ত হয়ে যেতে হয়। তা না হলে দেখা যাবে তোমার আবাদ করা প্রাণীকোষেদেরকে ব্যাকটেরিয়া ধরাশায়ী করে ফেলেছে।"
হোয়াট এভার, আমি মনে মনে বলি।
ডঃ বার্ট্রাম এবারে একটি আলমারীর দরজা খোলেন। ভিতরে অনেকগুলো তাক। প্রত্যেকটি তাকে রয়েছে অনেকগুলো গোলগোল চ্যাপটা স্বচ্ছ পাত্র। অনেকটা দেখতে বৈয়ামের ঢাকনির মতো। তাদের ভিতরে লালচে রঙ্গ এর একটি দ্রবন।
আমি একটু নিরাশ হলাম। আমিতো ভেবেছিলাম মাংসপিন্ডের মতো কিছু একটা দেখতে পাবো।
"এগুলোকে বলে পেট্রিডিশ। কেন বলে জানো?"
আমি মাথা নাড়ি। আমি কিভাবে জানবো হে? তোমার জিনিশ তুমিই ব্যাখ্যা করো।
"এই জাতীয় ডিশ যিনি বার করেছিলেন তার নাম ছিল পেট্রি। সেই জন্যেই এর নাম পেট্রি ডিশ।"
খুব সাবধানে একটি ডিশ তিনি তাক থেকে তুলে আনেন। আমি তার কাঁধের উপর দিয়ে উকিঝুকি মারি। যদি কিছু একটা দেখা যায়। কিন্তু ডিশের ভিতরে লালচে রং এ দ্রবন ছাড়া আর কিছুই নজরে আসেনা।
ডিশ হাতে এবারে তিনি ঘরের অন্য কোনার দিকে এগোন। সেখানে বেশ একটি বড়সড় মাইক্রোস্কোপ দেখতে পেলাম। ডিশটিকে মাইক্রোস্কোপের লেন্সের নীচে বসান তিনি। তারপর চোখ লাগান মাইক্রোস্কোপে।
"এখানে কি জাতীয় কোষেরা আছে জানো? এখানে আছে ইঁদূরের কোষ, ফাইব্রোব্লাস্ট শ্রেণীর কোষ এখানে। এসো- এখানে এসে চোখ লাগাও।"
আমি আস্তে আস্তে মাইক্রোস্কোপে চোখ রাখি।
পাশাপাশি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আছে কোষগুলো। অনেকটা কব্ল্স্টোন এর মতো। বেশী ম্যাগনিফায়ইং লেন্সের ভিতর দিয়ে দেখলে পরিষ্কার দেখা যায় নিউক্লিয়াস। বই পড়ে জানি যে ওটাই হচ্ছে কোষের প্রাণকেন্দ্র। ওখানে থাকে ক্রোমোসোম যা কিনা সব জীনের সমষ্টি।
কানের পাশে ডঃ বার্ট্রামের গলা শুনতে পাই,"এগুলো হচ্ছে নরমাল কোষ। এরা সংখ্যায় বাড়তে বাড়তে যখন পুরো ডিশটা ভরে ফেলে তখন এরা আর সংখ্যায় বাড়েনা। খেয়াল করে দেখো, কোষেরা কিন্তু সবাই পাশাপাশি আছে, একটার উপর আর একটা কোষ দেখতে পাবে না তুমি। কিন্তু এই কোষেরাই যখন ক্যানসারাস হয়ে যায়, তখন এরাই পাগলের মতো সংখ্যায় বাড়তে থাকে। একের উপর আর একটা। এভাবেই আমাদের শরীরে তৈরী হয় টিউমার। আন-কন্ট্রোল্ড্ গ্রোথ অফ সেলস্।"
ল্যাব থেকে আবার ফিরে আসি ডঃ বার্ট্রামের অফিসে।
"তারপর? কেমন লাগলো তোমার সবকিছু? ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে? ভাল কথা-আমি সম্প্রতি একটা নতুন রিসার্চ গ্র্যান্ট পেয়েছি। তা দিয়ে নতুন একটা দামী যন্ত্র কিনবো ভাবছি। একে বলে মাইক্রো ইঞ্জেকটর। এটি দিয়ে তুমি একটি প্রাণীকোষের ভিতর কোন কিছু ঢুকাতে পারবে। তারপর দেখবো কোষটির কোন পরিবর্তন হোল কিনা। অনেক চমৎকার চমৎকার এক্সপেরিমেন্ট করার প্ল্যান আছে আমাদের। তুমি এলে তোমাকে দিয়েই করাবো তাহলে কাজগুলো। তোমার ভালই লাগবে কাজগুলো করতে।"
আমার সবকিছু মোহময় মনে হয়। কত ছোট একটি প্রাণীকোষ, খালি চোখে দেখা যায়না, আর আমি সেই কোষটির ভিতরে কিছু একটা ইঞ্জেক্ট করবো। তাহলে সেই সূঁইটি না জানি কত সূক্ষ্ম।
আমি মাথা নাড়লাম। কাজ করবো এখানেই।
ডঃ বার্ট্রাম খুশী হলেন। ইউ ওন্ট রিগ্রেট ইট, আই প্রমিস!
"তাহলে কবে থেকে শুরু করবো আমি?"
এ প্রশ্নে ডঃ বার্ট্রামের মুখ একটু গম্ভীর হয়ে আসে। "তুমিতো জানো যে আমি তোমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন ডিরেক্ট ফ্যাকাল্টি নই। তাই তুমি যদি আমার ল্যাবে কাজ করতে চাও, তাহলে তোমাকে তোমাদের ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের পারমিশন নিয়ে আসতে হবে। আশাকরি তিনি কোন আপত্তি করবেন না।"
রোদেলা সেই দিনটিতে আবার আমি পথে নামলাম। এবারে দেখা করতে হবে আমাদের চেয়ারম্যানের সাথে। চেয়ারম্যান মানে ডঃ ভগবান।
গুরুর দেখাতো পেলাম, এবারে চাই ভগবানের সম্মতি।
(বাকী অংশ পরের পর্বে)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:৪৫