গুরুর অন্বেষণ এবং ভগবানের রক্তচক্ষু
আগেই বলেছি যে জনাব ভগবান সাউথ ইন্ডিয়ার লোক। তার সাথে আমার বার দুয়েকের মতো মোলাকাত হয়েছে মাত্র। এমনিতে দেখে-টেখে তো ভালই বলে মনে হয়েছিল আমার কাছে। এখন পারমিশনের জন্য গেলে কি মূর্তি ধারণ করবে তা খোদা মালুম।
ভগবান মনে হয় আমাদের ডিপার্টমেন্টের আজীবন চেয়ারম্যান। সে দু একটা কোর্স পড়ায় বটে কিন্তু সেগুলো হচ্ছে ডাক্তারী যারা পড়ে তাদের জন্যে। বান্দা একখানি টেক্সটবুক লিখেছেন, এবং শুনেছি যে সেটি বেশ চালু। ফলে পয়সা-পাতির দিক দিয়ে সে ভালই করছে বলে মনে হয়। তার নিজের কোন রিসার্চ প্রোগ্রাম নেই বলে তার কোন ল্যাবও নেই, আর তার আন্ডারে কোন গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টও নেই। সে আছে তার চেয়ারম্যানী করা নিয়ে।
বোধহয় এ কারণেই তাকেই বারবার চেয়ারম্যান বানানো হয়। সেও মনে হয় আপত্তি করেনা। ফ্রি ফ্রি মাতব্বরী করার সুযোগ পেলে কেইই বা আর ছাড়তে চায়?
দিন দুয়েক পর গেলাম তার সাথে দেখা করতে। হাজার হোক একই উপমহাদেশের লোক। পাড়াতুতো মুরুব্বী। তিনি আমাকে দেখে একগাল হাসেন।
"কি খবর তোমার? ক্লাশ নিয়ে ব্যস্ত মনে হয়। তোমাকে খুব একটা দেখিনা আজকাল।"
"এইই চলছে কোনরকম। পরীক্ষা-টরীক্ষা তো আছেই, তার উপর আরো কত রকম অ্যাসাইনমেন্ট আছে পাকে পাকে। নাকানি-চুবানি অবস্থা।
"এসব তো থাকবেই। তবে ভাল খবর হচ্ছে যে সেমেস্টার তো প্রায় শেষের দিকে। আর অল্প ক'টা দিন মাত্র, তারপরেই তো সামার চলে আসছে। তখন তুমি একটু বিশ্রাম পাবে। তা তোমার সামারের প্ল্যান কি? দেশে বেড়াতে যাবে নাকি এখানেই থাকবে?"
যাক- আমাকে আর সামারের কথাটা তুলতে হোলনা। সেইই নিজে থেকে তুলে ফেললো। আমিও ঝোপ বুঝে কোপ মারলাম।
"সামারের কথা আলাপ করতেই এলাম তোমার সাথে।"
ডঃ ভগবান সে কথায় নড়েচড়ে বসেন। "কি কথা? বলতো শুনি।"
"ভাবছি সামারে কারো সাথে রিসার্চ করবো।"
"বাহ- সেতো খুব ভাল কথা। আমাদের বিভাগের বেশ কয়েকজন প্রফেসর ভাল ভাল কাজ করছেন। তুমি চাইলে আমায় তাদেরকে অনুরোধ করে দেখতে পারি যেন তুমি তাদের ল্যাবে কাজ করার সুযোগ পাও। আমি বললে তারা না করতে পারবেন না আশাকরি। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে আমি চাই তুমি একটা ভাল ল্যাবে কাজ করো।"
আমি এবার বোমাটাকে ড্রপ করলাম। "আমি চিন্তা করেছি যে এবারের সামারটা আমি ডঃ বার্ট্রামের সাথে কাজ করবো।"
সেকথায় জনাব ভগবানের মুখ আঁধার হয়ে আসে। "বার্ট্রাম? কোন বার্ট্রাম? আমাদের বিভাগে তো এই নামে কোন প্রফেসর নেই।"
"উনি ক্যান্সার সেন্টারে কাজ করেন।"
"ওহ- দ্য নিউ কামার ফেলাহ্। কিন্তু সে তো আমাদের ডিপার্টমেন্টের ফ্যাকাল্টি না। তুমি তার সাথে কাজ করবে কি ভাবে?"
"আমি শুনেছি যে উনি আমাদের বিভাগের অ্যাসোসিয়েট ফ্যাকাল্টি। আর ছাত্ররা তাদের সাথে কাজ করতে পারে অনুমতি নিয়ে। চেয়ারম্যানের অনুমতি নিয়ে।"
এতক্ষণে ভগবান সাহেব বুঝতে পারেন আমার অকস্মাৎ আগমনের উদ্দেশ্যটিকে।
"তুমি কি তাহলে আমার পারমিশন চাইতে এসেছো?"
আমি সম্মতিতে ঘাড় নাড়ি।
"তুমি কি ইতিমধ্যে বার্ট্রামের সাথে কথা বলেছো? তুমি কি জানো যে তুমি কি ধরণের কাজ করবে সেখানে?"
আমি আবারও ঘাড় নাড়ি। ডঃ ভগবান এবারে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন।
"শোন তাহলে। তোমাকে আগে থেকে গোটা জিনিসটি খুলে বলি। তাহলে আর কোন কনফিউশন থাকবে না।"
আমি চোখ-কান খাড়া করে তার কথা শোনার প্রস্তুতি নেই।
‘আমাদের বিভাগের নিয়ম হচ্ছে যে কোন ছাত্র ইচ্ছা করলে সে অ্যাসোসিয়েট ফ্যাকালটির সাথে সাময়িক বেসিসে কাজ বা রিসার্চ করতে পারে। তবে তাকে এর জন্যে বিভাগের চেয়ারম্যানের অনুমতি নিতে হবে। এই নিয়মটি করা হয়েছিল যেন ছাত্ররা অন্যের ল্যাবে কাজ করে কিছু পয়সা আর্ন করতে পারে। তবে যেহেতু তুমি স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে এসেছ তোমার বেলায় কিন্তু এ নিয়ম কাজ করবে না। তবে যেহেতু তুমি আমার দেশের দিকের লোক, আর তুমি অনেক আশা করে আমার কাছে এসেছ, তাই তোমাকে আমি ওখানে কাজ করার পারমিশন দেবো এবারে। তবে এর সাথে আরও কিছু কথা আছে।"
আবার কি কথা? এ তো বেশ ঝামেলার জিনিস বলে মনে হচ্ছে!
"তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো যে আমরা চাইনা যে আমাদের ছাত্ররা বাইরের কারো সাথে তাদের পি এইচ ডির রিসার্চটি করুক। তুমি যদি বার্ট্রামের ল্যাবে এক সেমেস্টার গবেষণা করতে চাও, সেটা খুব বেশী সমস্যার ব্যাপার না। কিন্তু ভয়ের জিনিস হচ্ছে যে তুমি যদি কিছুদিন পর সিদ্ধান্ত নাও যে ওই ল্যাবেই তুমি তোমার পি এইচ ডির থিসিসের কাজটি করবে, তাহলে।"
"কেন তাতেই বা সমস্যা কি?"
"সমস্যা হচ্ছে এই যে তখন ব্যাপারটি আর আমার হাতে থাকবে না, তখন বিভাগের অ্যাকাডেমিক কাউনসিলের পারমিশন লাগবে তোমার। এই প্রসংগে বলে রাখা ভাল যে এই সব ব্যাপারে অ্যাকাডেমিক কাউনসিল পারমিশন দেয়ই না বললে চলে। বরঞ্চ তারা আমাকে প্রশ্ন করতে পারে যে আমি তোমাকে ইনিশিয়ালি কেন ওখানে কাজ করতে অ্যালাউ করলাম। আমি যা বললাম তার সারমর্ম হচ্ছে এই যে তুমি ওখানে অল্প সময়ের জন্য কাজ করতে পারো, কিন্তু তোমার আসল গবেষণাটি বিভাগের কারো সাথে করতে হবে।"
ভগবানকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। যাক-পারমিশন পাওয়া গেল তাহলে। ক'দিন কাজ করে দেখি কেমন লাগে। কোথায় কার সাথে পি এইচ ডির গবেষণা করবো তা পরে ভাবা যাবে।
পরদিন থেকেই লেগে গেলাম কাজে। প্রথম কয়দিন গেল সেখানকার লোকজন আর বিভিন্ন কেমিক্যালকে চিনতে। তার পর কয়েক সপ্তাহ গেল প্রাণীকোষ আবাদ করার পদ্ধতি শিখতে। আগে বুঝিনি যে এই কাজটি এত কঠিন। যতই সাবধানতা নেই না কেন, দুদিন পরেই দেখা যায় যে আমার আবাদ করা কোষগুলো ব্যকটেরিয়ার আক্রমনে খাবি খাচ্ছে। আবার ফির শুরুসে। ব্যাক টু স্কোয়্যার ওয়ান।
আমাদের ল্যাবে তখন নতুন একজন ল্যাব টেকনিশিয়ান এসেছে। সে ব্যাটা চাইনিজ। বয়সী লোক। বৌ, ছেলেকে চায়নাতে রেখে একাই এসেছে। পরে সময় সুযোগ পেলে তাদেরকে আনবে। তাকে একদিন তার নাম শুধোলাম। সে বললো, তার নাম হচ্ছে মিস্টার আউ। কারো নাম যে মিস্টার হতে পারে, তা জানা ছিলনা। পরে জানলাম যে তার পুরো নাম হচ্ছে পিং আউ। একে নিয়ে পরে আরো অনেক কিছু লেখা যাবে।
মাঝে মাঝেই শুনি যে মাইক্রো ইঞ্জেকটর যন্ত্রটি অলমোস্ট এসে গেলো বলে। এবং তার দাম নাকি এক লাখ ডলারের উপরে। একটু ঘাবড়ে যাই দাম শুনে। এত দামী জিনিস দিয়ে কাজ করবো। শেষে আমার পাল্লায় পড়ে যন্ত্রটির আবার বারোটা না বাজে। তেমন কিছু হলে আমার খবর আছে। থাকি আবার দ্বীপের মধ্যে। কোনদিকে যে পালিয়ে যাবো তারও কোন উপায় নেই। সাগরে ঝাঁপ দিলেও খুব একটা লাভ হবে না। কেননা আমি সাঁতার জানিনা।
এইভাবেই কোথা দিয়ে যে চলে গেল সামারটি। রিসার্চের তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। শুধু লাভের মধ্যে এইই হয়েছে যে আমি এখন নিখুঁত ভাবে প্রাণীকোষের আবাদ করতে পারি।
গুরুজী একদিন জিজ্ঞেস করলেন,"কিহে-আরও এক সেমেস্টার কাজ করবে নাকি?"
ততদিনে ওই ল্যাবের প্রেমে পড়ে গেছি। কাজ করবো মানে, আমি এখানেই আছি।
পরের সেমেস্টারের প্রথমে আবার যেতে হোল ভগবানের কাছে। পারমিশন চাই আবারো। মহানুভব এবারে ভুরু কোঁচকালেন আমাকে দেখে।
"তুমি ওখানে আবার কাজ করতে চাও? আমি তো ভেবেছিলাম শুধু এই একটা সামারেই ওখানে কাজ করবে।"
মিউ মিউ করে বলি,"না মানে- আসল কাজটিই করতে পারিনি এখনো। একটা খুব দামী যন্ত্র কেনা হচ্ছে ওখানে। সেটা এসে পৌছুলেই রিসার্চটি শুরু হবে। এতদিন কাজ করলাম, এখন তো মাঝপথে সরে আসার কোন মানে হয় না।"
গম্ভীরভাবে ফর্মটিতে দস্তখত করতে করতে ভগবান আমাকে বাণী দিলেন,"মনে রেখো-তুমি যদি ওই ল্যাবে তোমার পি এইচ ডির গবেষণা করতে চাও, তাহলে বিরাট সমস্যা হবে। এ জিনিসের পারমিশন এত সহজে পাবেনা তুমি। মাঝখান থেকে ওখানে কাটানো তোমার সময়টুকুই জলে যাবে।"
কিন্তু কে শোনে কার কথা?
(বাকী অংশ পরের পর্বে।)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ২:১০