গুরুর অন্বেষণ এবং ভগবানের রক্তচক্ষু
কেটে যায় আরো কিছু দিন। তারপর একদিন এসে গেল যন্ত্রটি। বলা ভালো যন্ত্রসমষ্টি। শুধু কি মাইক্রো ইঞ্জেকটর? তার সাথে আছে খুব দামী মাইক্রোস্কোপ, আছে সিসিডি ক্যামেরা, আছে ইমেজ অ্যানালিসিস এর জন্য বিশালাকায় এক কম্পিউটর।
একটি আলাদা ঘরে বসানো হোল সবকিছু। পুরো জিনিসটি সেট-আপ করতে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এক মোটকা ইঞ্জিনয়ার এলেন। এক সপ্তাহ ধরে আমাদেরকে ট্রেনিং দেওয়া হোল। কি করিলে কি হয় সব কিছু জানতে হবে না?
সেই ট্রেনিং এ গুরুজী গেলেন না। পাঠালেন আমাকে। মুখে বললেন,"ইউ আর দ্য ম্যান! আমার আর যাবার দরকার কি?"
বুঝলাম পরে যদি কোন সমস্যা হয় তাহলে তার কাছে সাহায্যের বা উপদেশের জন্য গিয়ে কোন লাভ হবে না। আরো বুঝলাম ব্যাটাচ্ছেলে বুদ্ধিমান লোক। আমার ঘাড়ে বন্দুক তো সে আগেই রেখেছে, এখন হাবেভাবে বুঝিয়ে দিল যে শিকারটিও আমাকেই করতে হবে।
আবার নতুন সেমেস্টার এসে পড়ে। আবার ভগবানের দ্বারস্থ হই। এবারে বোধহয় ভগবান সাহেব বুঝতে পারেন যে আমি খুব সম্ভবতঃ এই ল্যাবেই আমার মূল গবেষণার কাজটি করবো। তিনি এবার খুব একটা প্রশ্ন করলেন না আমাকে, শুধু একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,"আমি কিন্তু তোমাকে ওয়ার্নিং দিয়েছি অনেক বার, কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি আমার কথাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছো না। আমি আবারও বলছি, তোমাকে কিন্তু অ্যাকাডেমিক কাউনসিল পারমিশন দেবেনা। তখন তোমার পি এইচ ডি পাওয়া নিয়েই সমস্যা হবে।"
আমি একগুঁয়ে ছেলের মতো ঘাড় শক্ত করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকি।
ভগবান আবার বলেন,"তুমি অন্য কোন প্রফেসরের সাথে কাজ করছো না কেন?"
আমি মাথা নীচু করে বলি, "ওই ল্যাবের কাজটি আমার কাছে খুব এক্সাইটিং লাগছে।"
"হুমম! পরে আমাকে আবার দোষ দিও না যেন।"
এর মধ্যে এক বছর পার হয়ে যায়। আবার সামার চলে আসে। সেই সামারে আমি দেশে গেলাম। কিভাবে কেটে গেল তিনটে মাস তা টেরও পেলাম না। সেই সামারেই কি করে যেন আমার কুমারজীবন চিরকালের তরে বিদায় নিল। আমার গলায় দড়ি পড়িল। আমি স্বামী হইলাম। বিয়ে হোল নদীর নামের একটি মেয়ের সাথে।
বিয়ের পর আমরা একসাথেই ফিরলাম হনলুলুতে। পরদিনে থেকে ল্যাবের দিনমজুরী। স্ত্রীর মুখ গম্ভীর হয়। তার আর দোষ কি? একজন অজানা মানুষের হাত ধরে সে সাত সমুদ্দুর পাড়ি দিয়ে উড়ে এসেছে এক অজানা দেশে। তারপরেও কিনা সে অজানা মানুষটি আবার গবেষণার নামে প্রতিদিন সকালে কাকডাকা ভোরে উধাও হয়।
তখন মনে হয়েছিল যে আমাদের প্রতিটি অবিবাহিত ছেলেমেয়েকে (বিশেষতঃ ছেলেদেরকে) বিবাহ-উত্তর জীবন কেমন হবে তার একটা শর্ট ট্রেনিং নেওয়া উচিত। তাতে প্রতিপদে বিস্মিত হতে হয় না। কত রকম নতুন জিনিস, কত রকম নিয়ম কানুন। বলা যায় এখনো শিখছি।
যাকগে-সেকথা। মূল গল্পে ফিরে আসি।
সপ্তাহখানেক পরে গুরুজী ডাকলেন তার ঘরে। "শোনো- তুমি যেহেতু আমার এখানেই কাজ করবে বলে মনস্থির করেছো, তাহলে ব্যাপারটা অফিসিয়াল করে ফেলা দরকার।"
একথায় বুকের মধ্যে গুরগুর করে উঠলো। মনে পড়লো ভগবানের চেহারা মুবারক। বুঝলাম-এইবার আমার খবর আছে।
প্রথমে গেলাম ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারীর কাছে। পি এইচ ডি র অ্যাডভাইসার ঠিক করার নিয়ম কানুন আগে জানা দরকার। সে আমাকে একটা লম্বা ফর্ম ধরিয়ে দিল।
"এ আবার কি জিনিস হে?"
"এটা আমাদের নিয়ম। প্রথমে তোমাকে সব প্রফেসরের সাথে কথা বলতে হবে। শুনতে হবে তাদের সবার রিসার্চের কথা, তাদের ওখানে কাজ করলে কি ধরনের রিসার্চ-প্রজেক্টে তুমি কাজ করতে পারবে সেগুলো শুনতে হবে। তারপর তুমি ঠিক করবে যে তুমি কার সাথে কাজ করবে।"
"কিন্তু আমি তো ইতিমধ্যে ঠিক করে ফেলেছি যে আমি কার সাথে কাজ করবো। তাহলে আর এদের সাথে কথা লাভ কি?"
"জাস্ট ফরম্যালিটি। এই ফর্মে সব প্রফেসরের দস্তখত নিয়ে আসবে তাদের সাথে কথা বলার পর।"
এই জাতীয় উদ্ভট নিয়মে আমি হাসবো না কাঁদবো তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এতো দেখি এনগেজমেন্ট হয়ে যাওয়ার পর বিয়ের কনে দেখার কাজ শুরু করা। কিন্তু কি আর করা?
প্রফেসরদের সাথে কথা বলতে গিয়ে আর এক ঝামেলা হোল। প্রায় সবাইই চায় যে আমি যেন তাদের ল্যাবে কাজ করি। সবাই রীতিমত জমকালো সব রিসার্চ প্রজেক্ট হাজির করতে লাগলো আমার সামনে। আমি ঘাবড়ে যাই। এর রহস্য কি? এ কথা সত্যি যে আমি কয়েকটা কোর্সে ভাল গ্রেড পেয়েছে। কিন্তু তার মানে তো এই না যে আমি রিসার্চেও ভাল করবো। তবে কি তাহলে তাঁরা আমার মধ্যে বিরাট কোন বিজ্ঞানীর ছায়া দেখতে পেরেছেন?
গর্বে আমি বৌয়ের সামনে বুক ফুলিয়ে হাঁটাহাঁটি করি।
ক'দিন পরে বন্ধুবর সুজাত আলীর শরণাপন্ন হ'লাম। সে বুঝিয়ে দিল,"কারণটা খুবই সোজা। তুমি এদেশে এসেছো ফুল স্কলারশিপ নিয়ে, তাই তোমাকে তাদের কোন রকম পয়সাপাতি দিতে হবে না। ফ্রি ওয়ার্কার। তাইই সবার এতো উৎসাহ।"
গর্বের বেলুনে পড়ে বাস্তবতার আলপিন এর নির্দয় খোঁচা। চুপসে যাই সুজাতের কথায়। এতক্ষণে টের পাই আসল ঘটনা।
যাকগে-একদিন শেষ হোল দস্তখত নেবার পালা। এবারে আবার হাজির হই ভগবানের দরবারে।
সেদিন আকাশে মেঘের ঘনঘটা। সাগর ফুলে উঠছে। বাতাসে ঝড়ের আগাম বারতা। (আসলে এসবের কিছুই ছিলনা সেদিন, শুধুশুধু একটা গম্ভীর ভাব তৈরী করার জন্যে এসব লিখলাম)।
তবে ভগবানের মুখ সেদিন আসলেই গম্ভীর ছিল। আমি দুরুদুরু বুকে তার দিকে এগিয়ে দিলাম কাগজটি।
"কি এটা?" তার গলায় আমি সর্বনাশের ইঙ্গিত পাই।
"এটাতে সব প্রফেসরের সই নিয়েছি আমি। এখন আমি আমার অ্যাডভাইসর ঠিক করতে চাই।"
"তুমি তাহলে বার্ট্রামের সাথেই কাজ করবে? ফাইনাল ডিসিশান?"
"হ্যাঁ। সিদ্ধান্ত পাক্কা।"
ভগবান কাগজটি নিলেন আমার কাছ থেকে। "এই কাগজটি আমি যখন অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে পেশ করবো, তখন তুমি কি জানো যে তারা এটাকে কি হিসেবে নেবে? যে তাদেরকে তুমি বলছো যে এই বিভাগের এত নামকরা শিক্ষকদের মধ্যে তোমার অ্যাডভাইসার হ'বার মত যোগ্য কেউ নেই।"
"সে কি? এমন কথা আমি কোথায় বললাম? আমার যেখানে কাজ করতে ভাল লাগছে, আমি সেখানেই কেবল কাজ করতে চাইছি। আমি একবারও বলিনি যে এনারা অযোগ্য।"
"তাদের কাছে মেসেজটা কিন্তু দাঁড়াচ্ছে অন্যরকম। ওনারা কিন্তু তাইই বুঝবেন, এবং তারা তোমাকে কখনোই পারমিশন দেবেন না। আমি তোমাকে গ্যারান্টি দিচ্ছি, যে তোমার রিকোয়েস্ট তারা শুনবেন না।"
"কিন্তু তুমি হচ্ছো বিভাগের চেয়ারম্যান। তুমি যদি ভাল করে বুঝিয়ে বলো তাহলে ওনারা নিশ্চয়ই তোমার কথা শুনবেন।"
ভগবান এবারে কেমন যেন বাঁকা করে হাসেন। "আচ্ছা-তাই নাকি? আমি চেয়ারম্যান বলে তাঁরা আমার কথা শুনবেন?"
"হ্যাঁ-নিশ্চয়ই শুনবেন। চেয়ারম্যানের কথা সবারই শোনা উচিৎ।"
গলার স্বরে একটি নতুন ধরণের কাঠিন্য এনে ভগবান চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন,"তাহলে তুমি আমার এতবারের বারণ শুনলে না কেন? আমি তোমাকে প্রতিটি বার সতর্ক করেছি, প্রতিটি বার বলেছি যে এ জিনিস করে তুমি পার পাবেনা। অথচ তুমি দিব্যি আমার নিষেধ অগ্রাহ্য করে ওই ল্যাবেই কাজ করতে গিয়েছো। তোমার কি কোন ধারণা আছে যে আমি যখন কাউনসিলকে বলবো যে তুমি আমার বারণ শোননি, তখন তারা কি পরিমাণে রেগে যাবে?"
আমার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল। ভগবান কি বলছেন এসব?
"তাহলে আমি কি করবো এখন?"
"এই প্রশ্ন তুমি আমাকে এখন করছো কেন? যখন আমি তোমাকে বারবার বারণ করেছি, কই তখন তো তুমি আমার কাছে উপদেশ চাওনি। তুমি ভেবেছিলে যে তুমি মহা চালাক, আর আমরা সবাই ঘাসে মুখ দিয়ে চলি। তোমার চালাকি আমরা কেউ ধরতে পারবো না।"
"তাহলে কি হবে আমার? আমাকে তাহলে এখন অন্য কারোর ল্যাবে কাজ করতে হবে?"
ভগবান এবারে হাসেন। তবে সেটা বাঁকা হাসি।
"তোমাকে আমি ওয়ার্স্ট কেইস সিনারিও দেই। এমনও হতে পারে যে তোমাকে কেউই তাদের ল্যাবে নিতে চাইলো না। কেননা তুমি সবার চোখে একজন শিক্ষক অবমাননাকারী ছাড়া আর কিছুই না। এমন একজনকে ল্যাবে নিতে কেউ আগ্রহী নাও হতে পারে।"
আমার মাথা টলে ওঠে। কি হবে তাহলে এখন? আমি যদি এখানে পড়তে না পারি, তাহলে আমার স্কলারশিপের বারোটা বাজবে। আমাকে তাহলে ডিগ্রি না নিয়েই ফিরে যেতে হবে দেশে। সেখানে গিয়ে কি বলবো? টীচারদের সাথে বেয়াদবী করেছি বলে আমাকে তারা ফিরিয়ে দিয়েছে? সবার কাছে মুখ দেখাবো কি করে?
শুধু দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ভিতর থেকে।
ডঃ ভগবান বলেন,"প্লিজ- এইসব ন্যাকামী করোনা। এখানে ওইসব অভিনয়ের কোন দাম নেই।"
ডর্মে ফিরে স্ত্রীকে বললাম,"আমাদের এখানকার পাট বোধহয় চুকলো। বাক্স-প্যাঁটরা গুছানোর আঞ্জাম করো।"
সে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো শুধু।
(বাকী অংশ পরের পর্বে)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১০:৩০