গুরুর অন্বেষণ এবং ভগবানের রক্তচক্ষু
পরের কয়েকটা দিন কাটলো অসহ্য দুশ্চিন্তায়। কি করবো এখন। এমন সময় একদিন হঠাৎ করে দেখা হয়ে গেল জিমের সাথে।
জিমের পুরোনাম জিম বার্কাস। সেও আমারই মতো একজন ছাত্র। আমার চেয়ে এক বছর আগে এসেছে এখানে। তার সাথে আমি একটি ক্লাশ নিয়েছিলাম একবার। খুব একটা দোস্তি তাই হয়নি তার সাথে।
ক্যাফেটেরিয়ার এক কোণে বসে জিম কি যেন লিখছিল। সেদিন পুরো ক্যাফেটেরিয়াই ভরতি, একটাও খালি চেয়ার নেই। শুধু জিমের সামনেরটি ছাড়া। বাধ্য হয়ে তাই সেখানেই বসেছিলাম সেদিন।
জিম লিখতে লিখতে মুখ তুলে তাকায় আমার দিকে। "তোমাকে আমি চিনি, রাইট?"
"হ্যাঁ- বায়োকেম সিক্স নাইনটিন কোর্সটি একসাথে নিয়েছিলাম আমরা।"
"ও হ্যাঁ। তা কেমন আছো তুমি, ভাল?"
"খুব একটা না। খুব দুশ্চিন্তায় আছি।"
"ঘটনা কি?"
সংক্ষেপে তাকে বললাম সবকিছু। জিম একটি প্রশ্নও না করে চুপচাপ শুনলো আমার কথা। তারপর সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,"তুমি কি কফি খাবে? তাহলে তোমার জন্যেও নিয়ে আসি এককাপ।"
আর কফি? আর কয়দিন পরেই আমার নামাজে জানাযা হবে। কথা না বলে মাথা দোলাই শুধু।
জিম কফি নিয়ে আয়েস করে বসলো। তারপর খুব শান্ত ভাবে সে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা শুরু করলো।
"-- বাচ্চা ভগবান আর তার আশপাশের --বাচ্চা প্রফেসরগুলোর এইবার দফা রফা করা দরকার। এরা সব শুরু করেছে কি? যা ইচ্ছে তাই করবে?"
আমি হতভম্ব হয়ে বসে থাকি। জিম যে আমার এত হিতৈষী, তা তো আগে জানতাম না।
আরো মিনিট খানেক পর সে থামে। তারপর সে বললো তার কাহিনী। সেও আমারই মতো বিভাগের বাইরের একজনের সাথে কাজ করতে চায় এবং তাকেও ভগবান ওই একই রকম ভয় দেখিয়েছে। পরে শুনলাম যে আরো একটি মেয়ে আমাদেরই মতোন অন্য ল্যাবে কাজ করতে চায় কিন্তু ভগবানের হুমকির দাপটে সে সাহস পাচ্ছেনা।
জিম বললো,"তুমি কোন চিন্তা করোনা। আমি উইসকনসিনের ছেলে, আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো।"
আমি ভয়ে ভয়ে বলি,"কি করতে চাও তুমি? ওকে মারবে-টারবে নাতো?"
জিম একটু অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। "মারবো কেন? আমি ওর বিরুদ্ধে ডীনের কাছে নালিশ করবো। তখন ভগবান বুঝবে কত ধানে কত চাল।"
"আচ্ছা- এরকম করা যায় নাকি?"
"অবশ্যই। দেশে কি আইন-কানুন কিছু নেই নাকি?"
পরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত। যথাসময়ে জিম এক বিশাল পাঁচপৃষ্ঠার দরখাস্ত মুসাবিদা করে ফেললো। তাতে ভগবান এবং আমাদের বিভাগের আরো কয়েকজন প্রফেসরের বিরুদ্ধে নানান রকম অভিযোগ এর বর্ণনা দেওয়া আছে। তা পড়ে তো আমার আক্কেল গুড়ুম। এই জিনিসে আমাকে সই করতে হবে? সর্বনাশ!
জিম হাসে। "কাউকেই সই করতে হবে না।"
"তার মানে?"
"অলরেডী ভগবানের কানে এই খবর চলে গেছে যে তার বিরুদ্ধে একটি দরখাস্ত ডীনের অফিসে যাচ্ছে। এই খবরেই সে ভয় পেয়ে যাবে, এবং আমার ধারণা সে এই বিষয়টাকে আর বাড়তে দেবে না। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড সী!"
কার্যতঃ তাইই হোল। দু' দিন বাদে বিভাগের সেক্রেটারী আমাকে ফোন করে জানালো যে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল আমাকে বিভাগের বাইরের ল্যাবে আমার পি এইচ ডির গবেষণা করার অনুমতি দিয়েছে। আমার যাবতীয় সমস্যার সমাধান হইলো।
মজার ব্যাপারটি হোল এই যে এ ঘটনার মাস খানেক পর জিমের সাথে দেখা হলে সে বললো যে সে মেডিক্যাল স্কুলে পড়ার চান্স পেয়েছে এবং সে হনলুলু ছেড়ে কেন্টাকি চলে যাচ্ছে। যদিও ব্যাপারটি সে কিছুটা আগে থেকে জানতো, তারপরেও সে এখানে নালিশ করার কাজটি করে গেছে।
এখন বুঝি যে সে না থাকলে আমার ওখানে পিএইচডি করাটাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়তো। বরাবরের মতই এবারেও আমার বন্ধুরা আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল।
ডঃ ভগবানের সাথে এরপরে আর খুব একটা দেখা সাক্ষাত হয়নি। ততদিনে আমার কোর্স-ওয়ার্ক শেষ বলে আর ডিপার্টমেন্টে যাইনা খুব একটা। শুধু মাঝেমাঝে দু এক বার দেখা হয়েছে ভগবানজীর সাথে। একটু হাত তুলে চলে গেছি যে যার মতো।
মনে মনে বলেছি,"এখন কেমন বুঝতাছেন ভাইজান? বাঙ্গালী পোলার সাথে বিটলামী? হু ইজ স্মাইলিং নাউ?"
শেষ ঘটনাটি ঘটলো আরো বছর কয়েক পর। তখন আমার পি এইচ ডি প্রায় শেষের দিকে। দেশে বেড়াতে গেছি। একবার গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিভাগে। এর ওর সাথে কথা বলছি, এমন সময় আমাদের একজন সিনিয়র প্রফেসর আমায় বললেন আমি যেন অবশ্যই তার অফিসে এসে একবার কথা বলে যাই। কি যেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে একটা।
গেলাম তার ঘরে। উনি কি যেন একটা লিখছিলেন। চোখের ইংগিতে আমায় বসতে বললেন। বুকটা দুরুদুরু করে উঠলো। নিশ্চয়ই সিরিয়াস কিছু একটা হবে।
লেখা শেষ করে উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, "তারপর তোমার গবেষণা কেমন চলছে ওখানে?"
"ভালই স্যার। প্রায় শেষ করে এনেছি কাজ। দু এক মাসের মধ্যেই থিসিস লেখা শুরু করবো।"
"ভাল-ভাল।"
"দোয়া করবেন স্যার।"
"নিশ্চয়ই-নিশ্চয়ই। যাকগে- যা বলার জন্যে তোমাকে ডেকেছি। মাস ছয়েক আগে আমি একটা ইন্টারন্যশনাল কনফারেনস এ্যাটেন্ড করতে গিয়েছিলাম টোকিওতে। সেখানে একজন লোক হঠাৎ করে যেচে এসে আমার সাথে কথা বললেন। বললেন উনি নাকি হনলুলুতে তোমার বিভাগের চেয়্যারম্যান। নামটা এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না। হিন্দু কোন গড এর নাম। বিষ্ণু না কৃষ্ণ কি যেন একটা।"
আমার বুক ঠান্ডা হয়ে আসে। মনেমনে প্রমাদ গুনতে থাকি। মুখে বললাম, "ডঃ ভগবান।"
"হ্যাঁ-হ্যাঁ, ভগবান। উনি আমাকে তোমার সম্পর্কে অনেক কথা বললেন। বললেন উনি এই ব্যাপারে কথা বলার জন্যেই আমাকে খুঁজে বের করেছেন।"
সাত সমুদ্দুর তের নদী পাড়ি দিয়ে ভগবানের কালো হাত যে ঢাকা অবধি এসে পৌঁছেছে, তা জানা ছিলনা। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়।
সিনিয়র প্রফেসরটি এবারে বললেন,"উনি তোমার খুব প্রশংসা করলেন। বললেন যে তুমি নাকি কোর্স-ওয়ার্কে খুব ভাল করেছো, আর এখন নাকি খুব এক্সাইটিং একটা রিসার্চ প্রজেক্টে কাজ করছো। উনি বললেন তোমার মতো সুবোধ ছাত্র নাকি রীতিমতো দুস্প্রাপ্য। উনি আরো বললেন যে আমাদের এখান থেকে আরো ভাল ভালো ছাত্র ওখানে পাঠাতে। বললেন যে আমাদের এই বিভাগ থেকে যেকোন ছাত্র অ্যাপ্লাই করলেই উনি তাকে অ্যাডমিশন দিয়ে দেবেন। তোমাদের কৃতিত্বের কথা শুনতে খুব ভাল লেগেছিল আমার। একবার ভেবেছিলাম তোমাকে একটা চিঠি লিখবো, পরে দেখলাম তোমাকে সামনা-সামনি বলাটাই ভালো হবে। আমরা সবাই তোমার জন্যে গর্বিত। তোমার সুনাম মানে আমাদেরও সুনাম। দোয়া করি তুমি আরো ভাল করো।"
গাধার মতোন হতভম্ব হয়ে উনার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বুঝলাম গ্র্যান্ডমাস্টার দাবাড়ুর মতো শেষ চালে কিস্তি মাত করলেন জনাব ভগবান। তার উপর রাগ করা উচিত নাকি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, সেটা ভাল করে বুঝতে পারছিলাম না।
এতদিন পরেও ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হোলনা। ভগবানের বুদ্ধিদীপ্ত চালের রহস্য কিআর আমার মতো গাধারা বুঝতে পারে?
(এরপর নতুন পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১০ রাত ৩:২৪