ছোটবেলা থেকেই আমি খুব বাজে ছাত্র। স্কুলে আমার রোল কোনদিন ২৫ এর উপরে উঠেনাই। একবার রোল ২৩ হয়েছিল, কিন্তু অন্য সেকশন থেকে দুইজনকে চলে আসতে হয়েছিলো, তাই সেই রোল হয়ে গিয়েছিলো আবারো ২৫। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আমার আশেপাশের সব বন্ধুরা না বন্ধু প্রজাতির মানুষেরা রেজাল্ট নিয়ে যত বেশী টেনশন করতো, আমার টেনশন ঠিক ব্যাস্তানুপাতিকভাবে কম ছিলো। শুধুমাত্র গনিত ছাড়া আর কোন বিষয়েই আমি ৮০ এর উপরে পাইনি। এইভাবে অনেক কষ্টে আমি এসএসসি, এইচএসসি পাশ করি। বলতে বাধা নাই, আমার রেজাল্ট কোনদিক দিয়ে বলার মত ছিলোনা।
এইচএসসি পরীক্ষার করার পরে অনার্সে ভর্তি হতে হবে। এইটা নিয়ে আমার আশেপাশের সবাই অনেক পড়াশুনা করা শুরু করে দিলো। আমি টেনশন ছাড়াই সারাদিন খালি খাই আর ঘুমাই। সকাল ১০টায় উঠতাম, নাস্তা খাওয়া আর পত্রিকা পড়তেই পার করে দিতাম ১২টা। এরপরে টিভি দেখা, দুপুরের খাওয়া, তারপরে আবারো ঘুম। বিকালে খেলতে যেতাম। সন্ধ্যায় এসেই কম্পিউটারে গেম খেলা, চলতো রাত ১২টা/১টা পর্যন্ত। তারপরে আবার ঘুম। পুরা ৩মাস আমি এইভাবেই দিন কাটাইসি। বাসায় বকা শুনতে শুনতে আমার সহ্য হয়ে গিয়েছিলো। রেসাল্ট দেয়ার পরে দেখা গেলো আমার রেসাল্ট বলার মত না। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলতাম পাশ করেছি, গ্রেড বলতাম না।
এরপরে শুরু ভর্তিযুদ্ধ। সবার রেসাল্ট সেইরকম। এই ইউনিভার্সিটি সেই ইউনিভার্সিটি থেকে ফর্ম তোলা, কোচিং-এ মডেল টেস্ট দেয়া, টিচারে কাছে পড়া ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত সবাই, শুধু আমি ছাড়া। আমি ভেবেই নিয়েছিলাম আমার জন্য ওইসব না, কারন আমার রেজাল্ট ভালো না। কখনো ভাবিওনাই যে আমার একসম্য চাকরি করতে হবে, পরিবার সামলাইতে হবে। আমি ভাবসি, এখন যে সময় আছে, সেইটা এখন যদি উপভোগ না করি তাহলে আর উপভোগ করা হবেনা। তারপরেও আমাদের মতো বাজে ছাত্রের শেষ সম্বল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য চেষ্টা করা শুরু করলাম। আমার পরিচিতদের অনেকেই ঢাকা কলেজে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিচ্ছে। আমিও দিলাম। সেই একি কপাল। সেইখানেও হলোনা। এখন কি হবে? শেষমেষ এক ভাইয়ের পরামর্শে ভর্তি হইলাম একটা প্রতিষ্ঠানে যেটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু ভর্তি পরীক্ষা না দিলেও হয়। তবে সেইখানে খুব অল্প সাবজেক্ট।
শুরু করলাম ইলেক্ট্রনিক্স এন্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়া। ওরিয়েন্টেশনের দিন, খুব এক্সাইটেড আমি। বড় ভাইরা এরেঞ্জ করছে প্রোগ্রামটা। হঠাত করে আমাদের দিকে এসে বলল, নতুনদের মধ্যে থেকে একজনকে লাগবে একটা বক্তৃতা দেয়ার জন্য। স্কুল বা কলেজ কোথাও আমি এইসব করিনি। কেউ কথা বলছেনা, মনে হয় কারো তেমন আগ্রহ নাই, আর কারো কারো আগ্রহ থাকলেও কি করবে করবেনা বুঝতে পারছেনা, নতুন নতুন সব। কি ভেবে জানি আমি বলে ফেললাম, আমি দিবো। সাথে সাথে আমাকে নিয়ে গেলো একজন টিচারে কাছে। আমাকে নাম জিজ্ঞাসা করলেন, তারপরে বললেন, একটা স্পীচ লিখে এখনি নিয়ে আসতে। আমি লেখায় ভালো থাকার কারনে ১০ মিনিটে লিখে ফেললাম স্পীচ। নিয়ে গেলাম, পছন্দ হয়ে গেলো উনার। বললেন, আমরা তোমাকে ডাকবো যখন মঞ্চে এসে এইটা বলে যেও। আমি তো উত্তেজনায় অস্থির।
প্রথমেই পুরাতন ছাত্রদের মধ্যে একজন আমাদের স্বাগতম জানিয়ে বক্তৃতা দিলো। তারপরে উপস্থাপিকা বলে উঠলেন, এবার আমাদের সামনে আসবে নতুনদের মধ্যে থেকে ফাহিম যে এবারে ইলেক্ট্রনিক্স এন্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়েছেন। এইবারে আমার উত্তজনা পরিনত হলো ভয়ে। আমি কিভাবে কিভাবে যেনো মঞ্চে উঠলাম। ভয়ে স্পীচ এর কাগজটাও ঠিকমত রাখতে পারছিলাম না। মঞ্চে প্রতিষ্ঠানের প্রধান, একজন এমপি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন পদার্থবিজ্ঞানের টিচার( তার মধ্যে আবার একজন হলেন ডঃ ইউনুসের ভাই, ডঃ মোহাম্মদ ইব্রাহিম), আমি কিভাবে কি করবো বুঝে পাচ্ছিলাম না। যাহোক, ডায়াসের সামনে দাড়ালাম। প্রায় ২০০ জনের মত মানুষ, কেউ সহপাঠি, কেউ বড় ভাই/বোন। মাইকের সামনে আমি বোকা হয়ে গেছি। কেমনে কথা বলবো, বুঝে উঠতে পারছিলামনা। হঠাত কাগজটা ধরে মনে হল, যা হবে হোক, বলে ফেলি। সালাম দিয়ে পুরা ৫ মিনিট কথা বলে গেলাম। কথার শেষে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেয়ার সময় যে হাততালি শুনেছি সেটা আমি কোনদিন ভুলবনা।
শুরু হলো ক্লাস, ১ বছর পরে পরীক্ষা, টেনশন করার তো কিছু নাই। কেটে গেলো এক বছর কোনদিক দিয়ে বুঝলাম না। দিলাম পরীক্ষা। ৩ মাস পরে রেজাল্ট, আবার মাস্তির সময়। রেজাল্ট আসলো, খারাপ না হলেও খুব ভালো না। এইভাবে ৩ বছরের পরীক্ষা দিলাম। এর মাঝে একবার ক্লাস ঠিকমত না করার জন্য পরীক্ষা দিতে না পারার মতো অবস্থাও হয়েছিলো। পরে কোনভাবে ম্যানেজ করে দিয়েছিলাম পরীক্ষা।
শেষ বর্ষ, ধুমায়ে পরতেসে সবাই। আমি গায়ে বাতাস লাগায়ে না ঘুরলেও একদম বেছে বেছে পরতেসি। এর মাঝে অনেকেই চাকরী কই করবে সেই চিন্তায় বিভোর। ক্লাসে সবসময় প্রথম হওয়া ছেলেটার মার্ক ছিলো গড়ে ৭৮%, ওদের যে কি চিন্তা ভালো চাকুরির জন্য। আমি ফান করতে করতে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে এপ্লাই করলাম। কিভাবে কিভাবে যেনো তিন মাসের মধ্যে আমার চাকরিটাও হয়ে গেলো। যেদিন আমি ক্লাসে এসে এই কথা বললাম, সেইদিন প্রথম সারির ছাত্রদের মুখ শুকায়ে আমসি হয়ে গিয়েছিলো, কারন তাদের প্রত্যেকেরই ওইখানে চাকরি করার শখ ছিলো। আমি একজন ব্যাকবেঞ্চার হয়ে কিভাবে পেয়ে গেলাম ওইটা ওদের মাথায় ঢুকলোনা। যদিও চাকরিটা খুব বেশি ভালো পদের না, তারপরেও উপরে উঠার অপশন আছে গ্র্যাজুয়েশনের পরে। এইটা ভেবেই ওদের মাথার চুল ছেড়া বাকি রেখেছে ওরা।
যথাসময়ে পরীক্ষা শুরু। দিলাম অল্প পড়ায় পরীক্ষা। ভালো ছাত্ররা ধুমায়ে লিখে আর আমি কোনমতে উত্তর লিখে বের হই। একমাস লাগলো পরীক্ষা শেষ হলো। এবার ছয়মাসের ছুটি। চাকরি করতাম আর ঘুমাইতাম। ৬ মাস পরে রেজাল্ট দিলো। আমি কোনভাবে ৬০% মার্ক নিয়ে পাস করসি। আর ভালো ছাত্ররা সেইরকম নাম্বার পেয়ে পাস। আমি অফিসে এইবার উপরে উঠার প্রস্তুতি নিবো, এমন সময় শুনলাম যে আমাদেরকে আপাতত আর নেয়া হবেনা, বরং নির্দিষ্ট সময় পরে আমাদের চলে যেতে হবে। এইসময় এসে আমি কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলাম। এই প্রথম আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম কারন আমার রেজাল্ট খুব একটা ভালো না, তাই চাকরি হবে কোথাও হবে সেই আশাও নাই।
এইভাবে চলতে থাকলো আরো ৩ মাস। কিভাবে কিভাবে যেনো এই খবরটা আমার সেই ভালো ছাত্রদের কানে চলে গেলো এইটা। আমাকে অনেকেই ফোন দিয়ে, দেখা হলে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা শুনাতে চাইলো। আমিও শুনলাম। এভাবে ৬ মাস চলে গেলো। আমি চাকরির চিন্তা করি আর অ্যাপ্লাই করি এই জায়গায় সেই জায়গায়। হঠাত এক জায়গা থেকে কল আসলো যেটাইয় চাকরির কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনাই কোনদিন। কারন সেই একটাই,আমার রেজাল্ট। আমি জানি আমার চাকরি হবেনা,তাও গেলাম ইন্টারভিউ দিতে। যেয়ে আমি বোকা হয়ে গেলাম। আমার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সেই সব ভালো ভালো ছাত্ররাও এসেছে। কুশল বিনিময়ের পরে আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম। যথাসময়ে আমার ডাক আসলো, আমি গেলাম। মোটামুটি একটা ইন্টারভিউ দিয়ে বের হলাম। আমি খুব বেশী আশাবাদী, তারপরেও আমার মনে হলোনা যে আমার চাকরি হবেনা। অন্যরা মুখ টিপে হেসেই গেলো আমার পিছে।
৩ দিন পরে কল দেয়ার কথা, দিলোনা। আমি বুঝে গেলাম আমার হবেনা। নতুন করে আবার অ্যাপ্লাই করা শুরু করলাম। হঠাত করেই প্রায় ১৫দিন পরে একটা কল আসলো আবার, বললো আরেকটা ইন্টারভিউ হবে। আমি পুরাই আকাশ থেকে পরলাম। কিছুটা খুশী হয়ে আবার গেলাম। গিয়ে আবারো দেখলাম ভালো ছাত্রদের মধ্যে দুইজন আর অপরিচিত আরো একজন, সাথে আমি। আমার সহপাঠীরা এইবার অবাক হলো আমাকে দেখে। আমি আসতে পারার যোগ্যতা রাখি এইটা ওরা কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। ইন্টারভিউ শেষে আমাকে বললো বাইরে বসতে, আমি বসলাম। অন্যরাও বসে আছে ইন্টারভিউ দিয়ে। আজকের ইন্টারভিউ এর আগে আমি এইটাই ঠিক করে ঢুকেছিলাম যে আমাকে এই চাকরিটা পেতেই হবে। নিজেকে প্রমান করতে হবে। আত্ববিশ্বাস নিয়ে ১০ মিনিটের একটা ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম আমি ওইদিন। সবার ইন্টারভিউ শেষে, ১৫ মিনিট পরে আমাদের একটা কনফারেন্স রুমে নিয়ে গেলো, আমরা বসে আছি। একজন বিশালদেহী লোক ঢুকলেন ৫ মিনিট পরে। ঢুকেই বললেন, আমি আপনাদের রেজাল্ট জানাতেই এসেছি। বলেই আমার এক সহপাঠির নাম বললেন। সে উঠে দাড়াতেই বললেন, আমি খুবই দুঃখিত যে আপনাকে নিতে পারলাম না। সে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বসে পড়লো। এবারে আমরা ছাড়া আরেকজন যিনি ছিলেন তার নাম ধরে ডেকেই বলে উঠলেন, কংরেচুলেসন। সে তো খুশিতে আটখানা। এবার আমার নাম ডাকলেন, আমি তো প্রস্তুত “নিতে পারলাম না” শোনার জন্য। কিন্তু নাম ধরে ডেকেই আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বললেন আমাদের প্রতিষ্ঠানে আপনাকে স্বাগতম। এরপরে দ্রুত আমার আরেকজন সহপাঠিকেও “নিতে পারলাম না” বলে দিলেন।
ওই মুহুরতে আমার কেমন লাগছিলো এইটা আমি বলে বুঝাতে পারবোনা। যারা আমার চেয়ে অনেকগুনে ভালো ছাত্র তাদের বাদ দিয়ে আমাকে কেন নিলো, আবার আমার একটা চাকরি হয়ে যাওয়ার খুশি, সহপাঠিদের জন্য দুঃখ। সব মিলিয়ে মিশ্র একটা অনুভুতি।
সেইদিন আমি বুঝলাম, রেজাল্ট আসলে খুব বড় বিষয় না। আমি কি করতে পারি, আর নিজেকে বুঝাতে বা প্রমান পারা হলো, সবচেয়ে বড় ব্যাপার। খুব খারাপ লেগেছিলো, যখন আমার সহপাঠীরা আমার চাকুরি হওয়ার জন্য নুন্যতম খুশি না হয়ে ভদ্রতার শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিয়েছিলো।
তারপরেও ধন্যবাদ তাদেরকে কারন তাদের কারনেই আমার ওইদিন আত্ববিশ্বাসটা এসেছিলো, তাই আমি ওদেরকে সরিয়ে নিজে জায়গা করে নিতে পেরেছি।
নিজের উপরে বিশ্বাস রাখুন, আপনি সফল হবেনই। আমি বলে দিতে পারি।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:২৫