somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিশ্বকাপ দেখা ও ঘোরাঘুরি: লন্ডন ২০১৯

২৩ শে মে, ২০২০ ভোর ৬:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিখ্যাত টাওয়ার ব্রীজ / Tower bridge

‘’জানালা খুলে যদি কাঠবিড়ালী এবং খেঁকশিয়াল দেখতে পছন্দ কর তবে আমার বাসায় তোমাকে স্বাগতম’’ বারবারা’র ভাষায় বাড়ির বর্ণনা তে এই লাইনটা দেখে চোখ আটকে গেল। লোকেশনও পছন্দ হল। মূল শহরতলী থেকে পনের মিনিট লাগে মেট্রো-তে। Airbnb-তে বুকিং এর জন্য যোগাযোগ করলাম। সে সম্মতি দেয়ার পর কনফার্ম করে ফেললাম বুকিং। চাপা উত্তেজনা অনুভব করা শুরু তখন। যাচ্ছি তাহলে লন্ডন!

লন্ডনে যাবার ইচ্ছা ছিল অনেকদিন ধরেই কিন্তু সুযোগ এবং ভিসা জটিলতার (Schengen visa দিয়ে যুক্তরাজ্য ভ্রমণের সুযোগ নেই) কারণে যাওয়া হয়নি। তো সেবার ভাবলাম বিশ্বকাপ তো এসে গেল। না দেখলে কিভাবে হয়! কিন্তু সমস্যা হল টিকেট পাওয়া নিয়ে। ICC ওয়েবসাইট কিংবা তৃতীয় পক্ষের ওয়েবসাইট কোথাও টিকেট পেলাম না। এমন সময় পরিচিত এক ছোট ভাই জানালো তার পরিচিত একজন টিকেট কেটেছিল কিন্তু শেষমেশ যেতে পারছেনা কোন এক ঝামেলার কারণে। আসল দামেই বিক্রি করে দিতে চাচ্ছে কাউকে। খুশি হয়ে গেলাম শুনে। মাত্রাটা বেশী হল যখন শুনলাম খেলাটা লন্ডনে এবং তাও আবার Lord’s- এ! (Lord's Cricket Ground) …Lord’s! সেই ছোটবেলা থেকে যাকে কেবল টিভি’র পর্দাতে দেখেছি আর তার মাহাত্মের কথা শুনেছি। আর বিন্দুমাত্র না ভেবে কিনে ফেললাম টিকেট। বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তানের ম্যাচ। জুলাই মাসের ৫ তারিখ, শুক্রবার। শুরু হল প্রস্তুতি। আগেই বলেছি ভিসা পাওয়াটাই এক ঝামেলা। গিয়ে দেখি যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও বেশী। লং স্টোরি শর্ট- ভিসা প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে ধাপে টাকা। প্রকৃত ভিসা ফি’র চেয়ে চারগুণ বেশি টাকা খরচ হয়ে গেল সব মিলিয়ে। শুরুতেই সর্বশান্ত অবস্থা! যারা এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছেন তারা জানবেন। যদিও ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি এবং ভিসা পেতেও বেশিদিন সময় লাগেনি। সব মিলিয়ে সম্ভবত দুই-তিন সপ্তাহের মত লেগেছিলো। আমার শহরের কাছাকাছি বিমানবন্দর থেকে টিকিট কাটলাম লন্ডন স্ট্যানস্টেড এর (London Stansted Airport)। যদিও ওদের বড় এবং প্রধান বিমানবন্দর হলো হিথ্রো। বাজেট এয়ারলাইনস বলে স্ট্যানস্টেড হয়ে যাচ্ছি। জুলাই মাসের এক সামারের সকালে রওনা দিলাম, বাজে তখন ৬:৪৫। খেলা শুরু সকাল দশ টায়। ভেবেছিলাম লন্ডনে পৌঁছে বাসায় ব্যাগ রেখে তারপর স্টেডিয়াম যাবো। কিন্তু সমস্যা হল বিমানবন্দর থেকে রওনা দিলে আগে স্টেডিয়াম পড়ে, তারপর বাসা। তবুও লাগেজ নিয়ে স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যাবার মানে হয়না। দুই ঘন্টা যাত্রার পর যথাসময়ই পৌঁছালাম লন্ডন। ওয়েস্টার কার্ড (Oyester card) বলে একটা কার্ড আছে সেটা কিনলাম ট্রান্সপোর্ট ব্যবহারের জন্য। এ্টাকে রিচার্জ করতে হয়। কে কি পরিমাণ এলাকা ভ্রমণ করবে তার উপর নির্ভর করে রিচার্জ করা ভাল। ইউরো ভাঙিয়ে পাউন্ড করার সময় কাউন্টারের কালোমত বিশালদেহী লোকটা জিজ্ঞেস করলো, খেলা দেখতে আসছো? উত্তরে হ্যাঁ বলতেই বললো, কোন দেশ? বাংলাদেশ শুনে বললো, তোমাদের ভাগ্য ভালো এবার আমরা খেলছি না। জানতে চাইলাম, তুমি কোন দল? শরীর দুলিয়ে হেসে বললো ‘বারমুডা, চেনো?’ তার হাসি দেখে মিন মিন করে উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ, চিনেছি। আমরা আসলেই ভাগ্যবান!’ স্টেশন থেকে বের হয়ে শহরে যাবার এক্সপ্রেস ট্রেনে (Stansted express) উঠলাম। সবকিছু মোটামুটি প্লান অনুযায়ীই আগাচ্ছিলো। বারবারা’কে মেইল করে বললাম, আমি এক ঘন্টা পর আসব চেক-ইন করতে। করেই চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। হয়তো অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠেছিলাম বলেই একটু ক্লান্ত লাগছিলো। চোখ লেগে এসেছিলো কিছুটা। কিছুক্ষণ পর স্টেশন চেক করতে গিয়ে দেখলাম আগে দূরত্ব দেখাচ্ছিল পঁয়ত্রিশ মিনিটের। আর এখন ঊনষাট মিনিট! ভালোমত চেক করতেই দেখি সবই ঠিক আছে শুধু আমি উল্টোদিকের ট্রেনে উঠে বসে আছি। তাড়াতাড়ি পরের স্টপে নেমে গেলাম। বাজে তখন নয়টার কাছাকাছি। কিছুক্ষণ পর অন্য একটা ট্রেন ধরে আবার স্ট্যানস্টেডে গেলাম। সেখান থেকে ঠিক এক্সপ্রেস ট্রেনটা নিলাম এবার। লন্ডন পৌঁছে ট্রেন চেঞ্জ করে মেট্রো ধরে শেষমেশ যখন লর্ডস স্টেডিয়ামের কাছের স্টেশনে পৌঁছলাম তখন দেখি অলরেডি দশটা বেজে গেছে। কত আশা ছিল জাতীয় সঙ্গীত গাইবো দেশের প্লেয়ারদের সাথে। কোথায় কি! মেট্রোতে দেখলাম যাত্রীদের প্রায় সবাই-ই খেলার দর্শক, সমর্থক। দু’দেশেরই। ছেলে-বুড়ো, মা-বোন, বাচ্চা সবাই খেলা দেখতে যাচ্ছে। পিচ্চিদের গালে দেশের পতাকা আঁকা, মাথায় পতাকা বাঁধা। আমার সাথে দেশের জার্সি, পতাকা কিংবা ব্যানার কিছুই ছিলো না। উল্টো হাতে হ্যান্ড লাগেজ। মেট্রো থেকে বের হয়ে জনস্রোত লর্ডসের দিকে হাঁটতে থাকলো। দূর থেকে তখন অলরেডি শোনা যাচ্ছিলো গ্যালারী্র আওয়াজ। বলাবাহুল্য এটা ছিলো স্টেডিয়ামে বসে আমার জীবনে দেখা প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ। দেশে থেকেও কখনো যাওয়া হয়নি। আর এখন ভিনদেশে এসে....!

লম্বা লাইন পার হয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকার পর বসে দেখি আমার সীট একগাদা পাক সমর্থকের মাঝে! মোটামুটি সামনে-পিছে, আশেপাশে বেশিরভাগই ওদের সমর্থক। তবে পুরো স্টেডিয়ামে অনেক বাঙালী। দুই দলের সমর্থকও প্রায় সমান সমান। বাংলাদেশ বোলিং করছিলো। আমি জানিনা জীবনে প্রথমবার বলে কিনা ভিনদেশে নিজের দেশের ছেলেদের প্রতিবার চিয়ার করার সময় গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। পুরো ম্যাচ তো বলা সম্ভব না তবে সংক্ষেপে বললে বলবো মাঠে আমাদের খেলোয়াড়দের শারীরিক ভাষা আরকটু বলিষ্ঠ হওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়েছে। ম্যাচের ফলাফল যা-ই হোক তারা লড়াই করে যাবে এটা দেখার জন্যও অনেক দর্শক মাঠে যায়। উল্লেখ্য, ততদিনে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান দুই দলেরই বিশ্বকাপ ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছিল বলতে গেলে। বিদায় নিশ্চিত ছিল প্রায় দুই দলেরই। তাই অপেক্ষাকৃত কম চাপ নিয়ে খেলার সুযোগ ছিল হয়তো বাংলাদেশের। যা হোক পাকিস্তানের বিশাল রান তাড়া করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেললো বাঘের দল। আমার সীট থেকে তিন-চার সারি দূরে ছিল পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বিখ্যাত সমর্থক জলিল চাচা। এই বয়সেও কি তেজ আর উদ্দীপনা! অবাক করার মত। পাকিস্তান ভাল করলেই গ্যালারীতে একটা গান বেজে উঠছিলো 'দিল দিল পাকিস্তান, যা যা পাকিস্তান' প্রতিবারই যখন এটা বাজে তখন আমার আশেপাশের সব পাক সমর্থকদের দাঁত বের করে নাচানাচি শুরু হয় আর অমিও যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করছিলাম ভদ্রতার হাসি ধরে রেখে বড় স্ক্রিনের দিকে মনোযোগ দিতে। আমাদর সমর্থকরাও কম যায়নি কিন্তু। একটু পরপরই এদিক সেদিক থেকে চিৎকার ভেসে আসছিলো ‘শাবাশ শাবাশ বাংলাদেশ!’ দুটো পর্যবেক্ষণ না বললে নয়- লর্ডসকে টিভিতে দেখে যত জৌলুসপূর্ণ লাগে, দিনের আলোতে সরাসরি মাঠে বসে কেন যেন ততটা আহামরি কিছু মনে হয়নি। আর দ্বিতীয়ত, খেলোয়াড়দের মাঠে আসলেই খুব সহ্যশক্তি নিয়ে এবং ফোকাস্ড হয়ে খেলতে হয়, সেটা বুঝলাম। মোটামুটি খেলা দেখতে আসা বারো বছরের ছেলে থেকে শুরু করে তার মা সবারই পাড়াতো বন্ধুতে পরিণত হয় তখন মাশরাফি-রা। অতএব মুখে যা আসবে তা-ই বলা যাবে তাদের, এমন একটা অবস্থা! যাহোক, বাংলাদেশ ম্যাচটা হেরে যায়। সবাইকে বড় গলায় বলে এসেছিলাম যে জয় নিয়ে বাড়ি ফিরব। সিরিজ খারাপ করলে খেলোয়াড়রা বাড়ি ফিরতে ভয় কেন পায় এবার সেটা বুঝলাম। খেলা শেষে বন্ধুদের যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার সাথে সাথে নিজেও উপলব্ধিতে আনার চেষ্টা করলাম- জীবনে আরও অনেক কিছু আছে করার, শুধু খেলা নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না!

২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ / Lord's

বিকেলে স্টেডিয়াম থেকে যখন রওনা দিয়েছি তখন খেয়াল করলাম মাথা ধরেছে। না, ক্লান্তি কিংবা ম্যাচের চাপে না, ক্ষুধায়! সকালে নাস্তা করা হয়নি তেমন কিছু। আর খেলার মাঝে ব্রেকে সিঙ্গারা ছাড়া কিছু পাওয়া যায়নি খাবার মত। লর্ডসের আশেপাশে তেমন কোনো রেস্তোঁরা চোখে পরলো না। আর ছোট খাটো যা দুই-একটা ছিল সেগুলোতেও অনেক ভীড়। হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুদূর যাবার পর একটা রেস্তোঁরা পেলাম। নাম দেখে মনে হল উপমহাদেশীয় হবে। খাবার অর্ডার দেয়ার বিশ মিনিট পর জানতে পারলাম বিশ মিনিট পর খাবার আসবে। ক্ষুধা আর মাথাব্যথায় চিন্তা-চেতনা তখন লোপ পেয়েছিল সম্ভবত। আমার চেহারা দেখে ওয়েটার মায়া করে বললো, আপনি চাইলে এর মাঝে একটা ছোট আইটেম খেতে পারেন। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে কোনমতে জিজ্ঞেস করলাম, কি সেটা? জবাব এল, সিঙ্গাড়া! উত্তরে আবারো সেই একই দৃষ্টি। এবার সে নিজেই বলে চললো, আচ্ছা থাক। আমি মেইন খাবারই আনছি। বিশ মিনিট লাগবে, তবে চেষ্টা করব আরেকটু আগে আনতে। সত্যি বলতে কি কতদিন পর খাবার এসেছিলো সেটা ঠিক মনে নাই তবে কিছুটা খাবার পর আবিষ্কার করলাম ওয়েটার আমার পরিস্থিতি বিবেচনা করে আধাসেদ্ধ খাবারই তাড়াহুড়ো করে নিয়ে এসেছে। ভিনদেশে এসে এমন মমতা পেয়ে মনটা ঠান্ডা আর মাথাটা গরম হয়ে গেল। আর এসবের মাঝে এতক্ষণ খেয়াল করিনি যে আমার সামনের টেবিলে বসা পরিবারটা এতক্ষণ পুরো দেশী বরিশালের ভাষায় কথা বলছিলো। তাদের আলোচনার বিষয় কিছুটা কানেও আসছিল। শুনে এবার মাথাও ঠান্ডা হয়ে গেল!

বেকার ষ্ট্রীট / Baker street

রেস্তারা থেকে বের হবার পর মনে পড়ল বারবারাকে মেসেজ দেয়া হয়নি। সকালের ঝামেলার মাঝে ভুলে গেছি। দুঃখ প্রকাশ করে বললাম, আমি রাতে ফিরব বাসায়। সামার ছিল বলে তখনও সূর্যের অনেক তেজ। ভাবলাম সময়তো আছে, একটু ঘুরে যাই। মোটে থাকব তিনদিন। সময় নষ্ট করা যাবেনা। হাঁটতে হাঁটতে কেন জানিনা মনে হল রাস্তাঘাট, বাড়িঘর এমনকি গাছের সারিগুলোর সাথে কোথায় যেন মিল আছে আমাদের দেশের সাথে। ইউরোপের অন্যা্ন্য দেশে যেটা চোখে পড়েনি। গাড়িঘোড়া সব রাস্তার বামদিকে চলে এটাও একটা কারণ হতে পারে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর নিজেকে বেকার ষ্ট্রীটে (Baker street) আবিষ্কার করলাম। শার্লক হোমসের বাড়ি এখানে- ২২১/বি, বেকার ষ্ট্রীট। কথিত আছে একশ’ বছর আগের পুরোনো এই ঠিকানায় এখনও নাকি মাঝেমধ্যে চিঠি আসে। রহস্য কিংবা সমস্যা লিখে সমাধান চায় মানুষ। একটা জাদুঘরও আছে সেখানে। ঢুকিনি অবশ্য। হাঁটতে হাঁটতে বৃটিশদের অহংকার কালের সাক্ষী শহরটাকে দেখার চেষ্টা করলাম । এক পর্যায়ে প্রবল ক্লান্তি ভর করলো শরীরে। রওনা দিলাম বাসার দিকে। ঠিকানার কাছাকাছি পৌঁছাবার পর বাসা নিয়ে বারবারা’র বর্ণনার যথার্থতা বুঝতে পারলাম। বনের মাঝে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় অপরূপ লাগছিল জায়গাটাকে। শেষ মাথায় গিয়ে মোড় নিলে বাসার গলি শুরু। গাছগাছালিতে ভরা এলাকাটা। বেশ নিরিবিলি। সেই সাথে বাড়িগুলোও বেশ পুরোনো ধাঁচের। বেল টেপার খানিকক্ষণ পর দরজা খুলে দিল লাস্যময়ী এক মাঝবয়সী মহিলা। শুরুতেই জিজ্ঞেস করলো কোন রাস্তা দিয়ে এসেছি বাড়ির পথে। ধাঁধাটা বুঝলাম না। এরপর সে নিজেই বললো রহস্য ভেঙ্গে। এই বাসায় আসার আরো একটা রাস্তা আছে। বাসে করে আসলে বাসার কাছেই একটা বাস স্টপে নেমে পড়লেই হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত যত গেস্ট এসেছে সবাই-ই নাকি বন-জঙ্গলের রাস্তাটা ধরেই এসেছে। এরপর একটু নিচু গলায় বললো, ‘everyone took the same wrong turn, so did you!’ শুনে আমি কথাবার্তা ছেড়ে দিলাম। দেখে মুচকি হেসে বললো, আমি একজন সাইকোলজিস্ট। বলতে বলতেই নিজের ব্যাপারে একের পর এক তথ্য দিয়ে যাচ্ছিল। মিনিট পাঁচেকের লেকচার শেষে আমি যা বুঝলাম তা হল ভদ্রমহিলা একাধারে মিউজিশিয়ান, গবেষক, কন্সাল্ট্যান্ট, পর্যটক, পেইন্টার, উদ্দ্যোক্তা এবং লেখক! (একটুও বানিয়ে বলছিনা)। দু’যুগের বেশী সময় ছিলেন নিউজিল্যান্ডে। ইদানীং নাকি শর্টফিল্মও বানানো শিখছেন! কথা বলতে পারেন দুই-তিনটি ভাষায়। বারবারা এত কাজের কাজী বলেই হয়তো তার কেনিয়ান স্বামী জীবনে করার মত কিছু পায়নি আর। তাকে দেখলাম বিয়ার নিয়ে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছে। নিতান্ত অনিচ্ছায় কিছু কথা বললো। জানালো ইটালীতে অনেক বছর ছিলো সে, জার্মানীতেও। এই দুই ভাষাও জানে। শুনে আমার চোখমুখ শুকিয়ে গেল- এই না আবার জার্মান বলা শুরু করে এখন! ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই কিনা কে জানে সকালের ওই বারমুডার লোকটার মত দু’গাল জোড়া হাসি দিয়ে বললো, আমার জার্মান ভালোনা অতটা, তাই ইংলিশেই চলুক কথা। শুনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। এদিকে বারবারাও কথা বলেই যাচ্ছিলো আর ক্লান্তিতে আমার শরীর টলছিলো। মহিলা কথা বলতে বেশ পছন্দ করেন মনে হল। তবে বেশ বন্ধুবৎসল এবং অতিথিপরায়ন পরিবার। বাসা পুরোটা নিজের মত করে ব্যবহারের অনুমতি পেলাম। এমনকি রান্নাঘরের একটা শেলফে এবং ফ্রীজে গেস্টদের জন্য আলাদা করে খাবার-দাবার রাখা দেখলাম। ফলমূল, কেক, কুকিজ, চা-বিস্কুট সহ অনেককিছু রাখা সেখানে। পুরোনো আমলের কাঠের সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতালায় উঠে রুম দেখলাম, সাজানো। ইচ্ছে করছিল তখনই শুয়ে পড়ি। বাসাটাও পরিপাটী। খুব আধুনিক না তবে আরাম আয়েশের জন্য নানা ব্যবস্থা আছে। আগেকার আমলের সৌখিন জিনিষপত্র চোখে পড়ল এখানে-সেখানে। ফ্রেশ হয়ে রুমে ফিরতেই ঘুম চলে এল। প্রথম দর্শনে লন্ডনকে ভালোই লাগলো বলা যায়।

বাসার পথে সেই বন / Bushwood এলাকা

এরপরের দুইদিন লন্ডন ঘুরে বেড়ালাম। বৃটিশ মিউজিয়াম, ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবে, বাকিংহাম প্যা্লেস আর কত শত ল্যান্ডমার্ক! বলে শেষ করা যাবেনা। লন্ডনকে নিয়েতো আসলে নতুন করে বলার কিছু নেই। আর একটা ছোট লেখাতে সব বলার চেষ্টা করাও বৃথা। তবে একজন দর্শনার্থী হিসেবে প্রথমবার এসে যা চোখে পড়েছে তা বলা যেতে পারে। পথেঘাটে বাঙালি, ইন্ডিয়ান কিংবা পাকিস্তানী চোখে পড়ার মত। রেঁস্তোরার মালিক-কর্মী থেকে শুরু করে বাস ড্রাইভার কিংবা ছাত্র থেকে আমলা, সংসদ সদস্য সব জায়গাতেই এরা। আমি যে কয়টি ক্যাফে কিংবা ফাস্টফুডে গেছি সব কয়টাতে বাঙালী কিংবা উপমহাদেশীয় কেউ না কেউ ছিল এবং এরা বেশিরভাগই দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় প্রজন্মের কেউ। চমৎকার বৃটিশ উচ্চারণে ইংরেজীর মাঝে মাঝে দুই একটা বাংলা শব্দ বলছিলো। খাবার দাবারের দাম বেশ ভালই মনে হল পুরো লন্ডন শহরে। প্যারি্স, রোম কিংবা জার্মানির বড় শহরের সাথে তুলনা করলে অনেক বেশিই বলতে হবে। আরেকটা ব্যাপার হল মানুষের মাঝে ‘হাইপ‘ (hype) তৈরী করাতে বৃটিশদের জুড়ি নেই বলতেই হবে। তুচ্ছ একটা কিছুকে তারা এমনভাবে উপস্থাপন করে যাতে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে মুন গ্যালারীকে দেখলাম ওরা দারুনভাবে হাইলাইট করেছে। কি একটা শো চলছিল সেদিন। একটু পরপর ডাইরেকশন দেয়া ছিল কিভাবে সেখানে যেতে হবে। কৌতূহল সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। গিয়ে দেখি ছোট একটা হলঘরের মাঝে চন্দ্রাকৃ্তির একটা বস্তু। যেটাতে চাঁদের গায়ের মত খানাখন্দ গুলো খোদাই করা। অন্ধকার রুমের ভেতর বিভিন্ন রঙের আলোকসজ্জা দিয়ে একটা পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। ব্যস! লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে শুয়ে বসে সেলফি তুলছে। প্রত্যেকের মুখে হাসি, চোখে চন্দ্রজয়ের উত্তেজনা! বৃটিশ মিউজিয়ামের নাম অনেক শুনেছি। খুবই সমৃদ্ধ সন্দেহ নেই তবে প্যারিসের লুভরের (Louvre Museum) তুলনায় নস্যি মনে হল। তবে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং আমাদের সভ্যতা ও ইতিহাসের অনেক নিদর্শন মিলবে সেখানে। কেউ চাইলে ঘুরে আসতে পারেন। ওহ, একটা খুব ভাল ব্যাপার হচ্ছে লন্ডনে বেশিরভাগ মিউজিয়াম কিন্তু ফ্রী। অন্য অনেক দেশেই যেখানে পয়সা নেয়।

মিসরীয়রা পশুপাখিকেও মমি করে রাখত / বৃটিশ মিউজিয়াম

রাস্তাঘাট, মেট্রোতে লোকজন মজা করে, গম্ভীর না সবাই। মেট্রোর দেয়ালে বিভিন্ন মনীষীর উক্তি ও বাণী লিখে রাখা। এই ব্যাপারটাও ভালো লেগেছে। পথ চলতে গিয়ে এরকম কোন একটা উক্তিই হয়ত কারো জীবনদর্শন কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দিতে পারে। চলে আসার আগেরদিন গেলাম বাংগালী অধ্যুষিত এলাকা পূর্ব লন্ডনে (East London)। ব্রিক লেন দেখা হল। মনে হল ঢাকার মিরপুর চলে এসেছি। আক্ষরিক অর্থেই বাংলা এলাকা এটা। দোকানপাট, মসজিদ, স্কুল, মানি এক্সচেন্জার, রেঁস্তোরা, ল’ফার্ম সবখানেই বাঙালী এবং সাইনবোর্ড গুলোও বাংলায়। একটা বিশাল বাজার আছে নাম Bangla Town। এই এলাকায় এসে পুরো দেশি আমেজে এবং স্বাদে বাংলা খাবার খেয়ে আসতে ভুলবেন না। কাছেই একটা পার্ক নাম- আলতাব আলি পার্ক।এই পার্কের নাম আগে শুনেছিলাম। উইকিপিডিয়া ঘেঁটে দেখলাম ১৯৭৮ সালে আলতাব আলি নামে পঁচিশ বছর বয়েসী এক বাংলাদেশী যুবক খুন হন রেসিজমের শিকার হয়ে। তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে ১৯৯৮ সালে পার্কের নামকরণ করা হয় তাঁর নামে। সেখান থেকে বের হতেই চোখে পড়লো দেশী কাপড় ও সাজে একদল মানুষ একটা কমিউনিটি সেন্টারের নিচে দাঁড়িয়ে। বিয়ে হচ্ছে!

মিষ্টির দোকান / ব্রিক লেন

বিকেলটা চোখজুড়ানো টেমসের তীরে কাটিয়ে সন্ধ্যার দিকে ফিরে যাব বাসায় তখন হঠাৎ মনে হল এতকিছু দেখলাম কিন্তু একটা বিশ্ববিদ্যালয় দেখে গেলাম না, সেটা কেমন হয়! চলে গেলাম লন্ডনের বিশ্বখ্যাত University College London (UCL) দেখতে। এলাকাটা তখন বেশ নির্জন আর ফাঁকা। মূল ভবনের সামনে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। এরপর আশপাশটা ঘুরে দেখলাম কিছুটা। রাতের আঁধারে মনে হচ্ছিল যেন অজস্র দার্শনিক, লেখক, রাজনীতিবিদ আর কবিসাহিত্যিকরা ভবনের এখানে ওখানে হেঁটে বেড়াচ্ছেন, কাজ করছেন। কত জ্ঞানীগুণী লোকজনের পদচারণা ছিল এখানে। বৃটেনের এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বেরিয়ে তারা পরে সভ্যতা-সংস্কৃতির সব ক্ষেত্রে করেছেন অবাধ বিচরণ, শাসন করেছেন পুরো দুনিয়া। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এত বিশাল এক সাম্রাজ্য যেখানে নাকি সূর্য কখনো অস্ত যায় না, বৈকি!
আমাদের রবি ঠাকুরও কিন্তু UCL-এর ছাত্র ছিলেন, জানেন কি?

মূল ভবন / University College London

পরেরদিন ভোরে উঠে রওনা দিলাম, তবে লন্ডনের স্মৃতি রয়ে গেল মনের মাঝে। বিকেলের রোদে বনের মাঝে ছুটে চলা সোনালী রঙের খেঁকশিয়াল কিন্তু সত্যিই দেখেছিলাম। লন্ডন ট্রিপের প্রতীক হয়েই সেটা মনে গেঁথে আছে।

পাদটীকাঃ ভ্রমন কাহিনী লিখে অভ্যেস নেই। লেখায় অপরিপক্কতা চোখে পড়বে; ক্ষমা মার্জনীয়।
লিখলাম কেন তবু?

"Happiness only real when shared’’- Chris McCandless
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০২০ সকাল ৭:৩২
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×