somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অসমাপ্ত দুটি অণুগল্পঃ সিগারেট এবং ফোনালাপ

৩১ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ১১:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১।
ছোটবেলা থেকেই রাতিনের একটা বদঅভ্যাস ছিল। সেটা হলো সময় অসময়ে তার বাবাকে চিমটি কাটা। হাতে, পায়ে, নাকে, ঠোটে, গোফে, সবখানে। সবেধন নীলমণির এইসব দুষ্টুমি হাসিমুখেই মেনে নিতেন রাতিনের বাবা। রাতিনের বয়স যখন বারো, তখন তার বাবা আচানক করলার রস খাওয়া শুরু করলেন। সকাল-সন্ধ্যা দুইবেলা ঘন সবুজ রঙের একগ্লাস করে করলার রস।

কিছুদিন পর রাতিনকে ডেকে বললেন, দেখ আব্বাজান, আমি বেশি বেশি করলার রস খেয়ে খেয়ে আমার শরীরের রক্ত বিষাক্ত তেতো হয়ে গেছে। সাপের বিষের চেয়েও। এখন তুমি যদি আমাকে চিমটি কাটো তাহলে তোমার শরীরেও সেই বিষ ভুস করে ঢুকে যাবে।

সেই থেকে রাতিনের চিমটি কাটা অভ্যাস দুর হয়। রাতিনের বয়স এখন বিশ, তার বাবা এখনও পরম তৃপ্তি নিয়ে দুইবেলা করলার রস খান। এতদিনে তিনি সাপের চেয়েও বিষাক্ত মানব হয়েছেন বলে রাতিনের ধারণা। এখন যদি ইয়া বড় কোন সাপ গা দোলাতে দোলাতে এসে রাতিনের বাবাকে ছোবল মারে তাহলে সে গোবেচারার দুইমিনিটের মধ্যে পগার পার হওয়া অবশ্যম্ভাবী। এতে কোন মিস নেই।

রাতিনের বাবা আজ রাতিনকে নিয়ে বাজার করতে বেরিয়েছে। রাতিনের বাবা পুরাতন সওদাগরের মত লম্বা সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা লুঙ্গি পড়েছেন। তার পেছন পেছন রাতিন আস্ত সবজিক্ষেত ঢুকানো যাবে এমন একটা ব্যাগ নিয়ে হেলতে দুলতে হাটছিল। রাতিনের মনে হচ্ছিল তার বাবা শুধু তাকে নিয়ে বাজারে আসেন নি, মাথার উপর একটা গনগনে সূর্যকেও তাদের সাথে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছেন। অর্ধেক বাজার ঘোরাঘুরি করেও এখনও তার বাবা কিছু কিনেন নি। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হল তিনি করলা ছাড়া আর কিছুরই দাম করছেন না। রাতিন মোটামুটি নিশ্চিত, আজ করলার মতই তিক্ত স্বাদ বিশিষ্ট একটি দিন কাটাতে হবে।

সাহস করে সে বাবার পাশাপাশি এসে জিজ্ঞেস করল
-বাবা, মায়ের বাজারের লিস্টিটা দাও তো।
- কার লিস্ট?
-মা যেটা তোমাকে দিয়েছেন। কেনার জন্য।
-আজ তোর মায়ের লিস্টের দিন না। আজ আমার ইচ্ছামত বাজারের দিন।
-এরকম নিয়ম আছে নাকি তোমাদের? রুটিন করে বাজার করা?
-এত কথা জিজ্ঞেস করবি না। আমি ছোটবেলায় আব্বার সাথে বাজারে গেলে কোন কথা বলতাম না। শুধু বাজার শেষে একটা আস্ত রসগোল্লা খেতাম। নো কোয়েশচেন।
-ও

রসগোল্লা রাতিনের মোটেও পছন্দ না। করলার রসও না। অথচ তার বাবা এই দুই জিনিসকেও পরম আদরে নিজের পছন্দের তালিকায় পুষে আসছেন।

-তুমিও কি আজকে আমাকে রসগোল্লা খাওয়াবে?
-আবার প্রশ্ন? আমার কোন গুণই তুই ধরতে পারলি না।
-না মানে, রসগোল্লা আমার ভাল লাগে না। এর বদলে অন্য কিছু মেনুতে রাখলে ভাল হয়।
-নো কোয়েশচেন, নো চয়েজ। আমি যেটা খাওয়াবো সেটাই। ইচ্ছা হলে সিগারেটও খাওয়াতে পারি। বেনসন এন্ড হেজেস, কোয়ালিটি ফিল্টার সিগারেট।
-মানে? সিগা……রেট! সিগারেট কেন খাব!
- কেন খাস সেটা তো জানি না। সেটা জানার জন্যই আমার সামনে সিগারেট খেতে হতে পারে। আই ওয়ান্ট টু সি, তুমি সিগারেট খেয়ে কিরকম অনুভব কর।
- আমি সিগারেট খাব কেন? আজেবাজে কথা বলো কেন?
-চাপকায় দাত উপড়ে ফেলব। কলেজ লাইফে আমিও তিনপিস সিগারেট খেয়েছি। চারদিনের মাথায় আব্বার কাছে ধরা খেয়েছি। তোমার তো ভাগ্য ভাল, আমি চারমাস পর টের পেয়েছি।

রাতিনের কথা বন্ধ হয়ে গেছে। বাবা কখন টের পেল? সে তো দিনে একটা সিগারেট খায় তাও আবার দুইমাইল দুরের একটা চায়ের দোকানের পেছনে। খাওয়ার পর চা খায়। বাড়ি ফেরার সময় এক বন্ধর বাসায় ঢুকে বডি স্প্রে দেয়। তবু কিভাবে টের পেল?

- কি? কথা বন্ধ?
- না। আমি এখন খাই না তো। ভুলে একদিন খাইছিলাম।

রাতিনের বাবা এবার শুধু চোখ গরম করে তাকালেন। রাগের সাথে কিছুটা দেখ বাবাজি কেমন লাগে দৃষ্টি দিয়ে তাকালেন। রাতিন বুঝতে পারছে না কি বলবে। বাবার সামনে সিগারেট খেতে হলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। নিজের উপরে ভয়াবহ রাগ হচ্ছিল রাতিনের। কেন বলতে গেল রসগোল্লা ভাল লাগে না!

রাতিনের বাবা করলার দাম করছেন। একেকটা লাউ সাইজের বড় বড় করলা। রাতিন একবার ভাবল, এক ছুট দিয়ে পালিয়ে যাবে। কিন্তু তাতে অবস্থা আরও ঘনীভুত হতে পারে। করলাগুলোকে বড় আপন মনে হলো কেন যেন এই সময়। করলা আর রাতিন দুইয়ের ভেতরই এখন তিক্ত রসের বন্যা হচ্ছে।

রাতিন দৃশ্যটা কল্পনা করতে যেয়েও পারল না। কটকটে রোদে দাঁড়িয়ে সে সিগারেটে একটা করে টান দিচ্ছে। সামনে তার বাবা চেয়ারে বসে আছেন। এক টান দেয়ার পর পর তার বাবা জিজ্ঞেস করছেন, কি স্বাদ কেমন? আমার করলার রসের চেয়ে ভাল?

(সিগারেট)

২ ।

ফাহাদ ছেলেটার কন্ঠে অত্যধিক মায়া। ছেলেদের কন্ঠে এত মায়া থাকবে কেন! এমন কিছু ছেলেদের জন্যই মেয়েদের কন্ঠ এখন শিরিষ কাগজ ঘষার শব্দের মতন হয়ে যাচ্ছে। দেখতে হয়ত ভাল লাগবে, মনের মধ্যে হালকা মোমবাতির আচের মতন লাগবে। কিন্তু যখনই কথা বলা শুরু করবে মোমবাতি ভুস করে বন্ধ হয়ে যাবে। ছয়হাতি শাড়ি পরা আধুনিকা মেয়ের কর্কশ কন্ঠে মন পুড়ে ধোঁয়া বের হওয়া শুরু হবে। এসবই এমন কিছু ফাহাদের জন্য। এরা মায়া চুরি করে নিজের কন্ঠে বসিয়েছে।

ফাহাদের ব্যাপারে কোনকিছু ভাবতে গেলেই সুবণীর মনে শুধু ওই স্বরটাই ভাসে। একটা পরিশুদ্ধ মানুষের কন্ঠস্বর যা কিনা একাকি বিকেলে ছাদে ওড়না ওড়ানো কোন মেয়ের স্বপ্নকে ডেকে আনতে পারে। ফাহাদ আসলেও পারে, সুবণীর বিশ্বাস। অন্তত সুবণীর রাতজেগে দেখা স্বপ্ন ফাহাদ একদিন নিশ্চয়ই নিজ কন্ঠে তাকে উপহার দিবে। সুবণী ঠিক করে রেখেছে একদিন, কোন এক আশ্বিনের হাড় কাঁপানো বৃষ্টির দিন বারোহাতি বালুচরি শাড়ি পড়ে এসে নিজে ফাহাদের কাছে সেই উপহার চাইবে। শুধু ক্যালেন্ডারের পাতাটা আজ্ঞা দিলেই হয়।

এটা সেটা ভাবতে ভাবতে খেয়াল হারিয়ে ফেলেছিল সুবণী। আয়নায় চোখ পড়তেই হুশ ফিরে এলো। লিপস্টিক দিতে গিয়েছিল হা্লকা করে। সারা দুনিয়া ভাবতে ভাবতে নাক মুখে লিপস্টিক মেখে লাল করে ফেলেছে। এখন তাকে তার ছোটকালের পুতুলগুলোর মত লাগছে। বউ পুতুল, যার প্রত্যেকদিন বিয়ে দিত ওরা। আর কত কথা, কত কথা হত সেই বিবাহের আসরে!

- কি সুন্দরী, আজ তো তোমার বিবাহ! আসো সাজায়া দেই?
- জি, দেন।
- লিপস্টিক কি লাল রঙেরটা দিব? নাকি গোলাপী?
- লালটাই দেন। বিবাহের দিন সবকিছু লাল পড়তে হয়।
- আচ্ছা।

সুবণীর হঠাৎ করে সেই বউ পুতুলটার মত করে সাজতে ইচ্ছে করছে। কেউ তাকে সাজিয়ে দেবে না। সে নিজেই সাজবে, একা একা। লালশাড়ি, লালটিপ, সাদা চুড়ি নাকি কালো! জোর করেই বউ পুতুল সাজার চিন্তা সরালো সুবণী। পুতুল হোক আর মানুষ, জীবনে একবারই বউ হয়ে সাজবে সে। আজ পেত্নী সাজলেও মন্দ হয় না!

সুবণীর যে সাজতে ইচ্ছে করছে তার পিছনে কারণ আছে। না, কোনটা বড় কিংবা কোনটা ছোট, এমন না। দু'টোই সমান গুরুত্বপূর্ণ কারণ। প্রথমত সুবণীর মন ভাল নেই। মন ভাল না থাকলেই যে সাজুগুজু করতে হবে তা কিন্তু না। তবে সুবণীর মনে হয় অন্তত বাঙালি মেয়েরা রাতের বেলা মন খারাপ হলে সাজুগুজু করে। এটা নারীজগতের মনখারাপের অবিসংবাদিত নিয়ম। এ নিয়ম ভাঙা চলবে না। এ নিয়ম ভাঙ্গলে মন খারাপের কোন স্ট্যাটাস থাকে না। সুবণী অবশ্য আরও একটা কাজ করে মন খারাপ থাকলে। কিন্তু এখন সেটা সবার সামনে বলা যাবে না।

আরেকটি কারণ হলো আজ ফাহাদ সুবণীকে গান শোনাবে। রাত একটা'র পর ফোন নিয়ে সে ছাদে যাবে। একটা বাজতে আর সাত মিনিট বাকি। ফোনে গান গাইতে লজ্জা লাগার কথা, কিন্তু সুবণীর কেন যেন এখন ফোনে গান শুনবে ভাবতেও লজ্জা লাগছে। ওর তো এত লজ্জা ছিল না! অন্তত ফাহাদের গান শোনার ক্ষেত্রে তো নয়ই। প্রায় তিনমাস থেকে সে ফাহাদের কাছে এই আবদার করে আসছে। নিজের ন্যাকামিতে নিজেরই অসহ্য লাগল সুবণীর।

একটা বাজার তিন মিনিট আগেই ফাহাদ ফোন দিলো। সুবণী তখন চাদহীন রাতে নিকষ কালো মেঘের মেলায় চড়কির হৃদস্পন্দন নিয়ে কেবল ছাদে উঠেছিল।

- হ্যালো।
- হ্যালো? কে? ণী??
- এত রাতে আমার ফোনে আর কে থাকবে! আজব তো!
- শোন, একটা ঝামেলায় পড়ে গেছি। আজ কথা বলতে পারব না।
- কি হয়েছে!!?
- এখন বলতে পারব না। খুব ব্যস্ত। পড়ে বলব।
- ও আচ্ছা।
- ওকে। রাখি তাহলে।
- আচ্ছা।

(ফোনালাপ)
১৩টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×