আমার কেন জানি মনে হয়, প্রত্যেকটা মানুষ একেকটা সবুজ গাছ হয়ে জন্মায়, সারাজীবন ধরে চলতে থাকে সেই গাছটার মরুকরণ।
আমার ভেতর মরুকরণ শুরু হয়েছিল মেডিকেল লাইফে পা দেওয়ার পর থেকে, কিংবা তারও কিছুকাল আগে।
সময়ের নিষ্ঠুর স্রোত এনে দাড় করিয়েছে অদ্ভুত এক আয়নার সামনে।
কি গভীর আনন্দমাখা ছিল শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলো !
আগে বাবার আংগুল ধরে হারিয়ে যেতাম দূর দূরান্তের পথে, পাহাড়ে, বনে জঙ্গলে।
কাঠঘর সৈকতে দাঁড়িয়ে নিশ্বাস নিতাম, লোনাজল ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে শুনতাম সাগরের গর্জন
শীতের রাতে কীর্তিপুর - চকগৌরী-শালুকান গ্রামে লেপমুড়ি দিয়ে ভাপাপিঠা খাওয়া
কাকাডাকা ভোরে কুয়াশা জড়ানো মেঠোপথে খেজুরের রস হাতে হারিয়ে যাওয়া,
পরে মানুষ পাঠিয়ে আমাকে খুজে আনা হত।
টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ ঘুমাতে দিত না কোনরাতে।
সেই ছোট যমুনার পাশে ভরদূপুরে বসে বসে নৌকা দেখতাম,
মনে হত টুপ করে একটা নৌকায় উঠে যাই, খুজেই পাবে না কেউ কোনদিন।
ভরদূপুরে ধু ধু মাঠে হা করে তাকিয়ে থেকে কি সব চিন্তা করতাম।
ছাদে শুয়ে শুয়ে আকাশগঙ্গা দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকেছি কত ঘন্টার পর ঘন্টা তার ইয়ত্তা নেই।
ছোট চাচার সাথে মাছ ধরার জাল বানাতাম।
সেই জালে একবার কিভাবে যেন অনেকগুলা লাল খলিসা মাছ ধরা পড়ল।
আমার সে কি খুশী!!!!
আম্মুর হরলিক্সের কাঁচের বোতলে রেখে সারারাত তাকিয়ে থাকি, তাদের সাঁতার কাটা দেখে নিজেরও তাদের সাথে সাঁতার কাটার ইচ্ছা হত।
পরে সাবান দিয়ে গোসল করাতে যেয়ে সব মাছ মারা গেল
নানীমার হাত ধরে ফুল চিনতাম, পাখি চিনতাম।
এক সময় ডাক শুনেই বলে দিতে পারতাম পাখিটার নাম।
বাসার ছাদে ছোটখাটো বনবাগান বানিয়ে ফেলেছিলাম।
পরিত্যক্ত হ্যারিকেনের ভেতর জোনাকী ধরে ধরে বানিয়েছিলাম নিজের ছায়াপথ।
সেই দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেছে !
আইটেম, কার্ড, ডিসেকশন, প্রফ, সাপ্লিমেন্টারীর ভীরে একটু একটু করেই কেমন জানি না
বাণিজ্যিক হয়ে উঠেছি তিন বছর ধরেই।
বাস্তবতার সাথে অসম যুদ্ধে বদলে যাওয়ার অসহায় চেষ্টায় জয় পরাজয় দুটাই আমার নিজের।
কেন জানি, সেই আগের মানুষ টাকে পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করতে পারিনি এখনো।
এখনো হলের ছাদে শুয়ে শুয়ে উড়ন্ত মেঘ দেখি,
বৃষ্টি নামলে ঘরে ঢুকে পড়ি জ্বর বাঁধানোর ভয়ে।
লাং কলাপ্স হওয়ার চিন্তায়।
রাতে কালো পিচের মহাসড়কের ওপর খালি পায়ে হেটে বেড়ানো
আর পদ্মার ধুধু বালুচরে জোছনা দেখার ইচ্ছাগুলো কেড়ে নিয়েছে ছিনতাইকারীদের দল কিংবা পুলিশী প্রহরা।
আগে আরব্য রজনীতে ডুবে থাকতাম, মেঝেতে বইয়ের স্তুপের ভীরে অজানা কোন জগতে হারিয়ে যেতাম।
ঠাকুরমার ঝুলি, ভূতের গল্প, রুশ দেশের রূপকথা ছিল পরম বন্ধু ।
এখন সময় কাটে " লা মিজারেবল " কিংবা "জয় গোস্বামী"র কবিতার বইয়ে মুখ গুঁজে।
গান শোনার ক্ষেত্রেও কতটা বদলে গেছি!
আগে গান ই শুনতাম না, বিরক্ত লাগত।
এখন Poets of the Fall, Beatles,Lady Gaga আর রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া দিনই কাটে না।
সেই সাথে আগের যুগের বাংলা ব্যান্ডগুলা, শিরোনামহীন, অর্থহীন, মহীনের ঘোড়াগুলি।
আগে ভাল লাগত না ঢাকার অসহ্য যানজট, দানবীয় ট্রাকের তীক্ষ্ণ হর্ন, মানুষের স্রোত। ইটপাথরের মরু।
আর এখন জনমানবহীন সিল্ক শহরে দমবন্ধ লাগে।
ঢাকা শহরের মানুষের ভীরে শ্বাস নেই বুকভরে।
কোলাহলই তো প্রানের চিহ্ন, গ্রীন সিগন্যাল।
জানালার ওপাশের গ্রেটার রোডের গাড়িগুলোর টায়ারে জমে থাকা আর্তনাদ সহ্য করতে শিখে গেছি সেই কবেই।
এখন শুধু দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসা অসুস্থ মানুষের আর্তনাদ সয়ে নেবার অন্তহীন অপেক্ষা।
কয়েক বছর , ব্যস, এরপরেই আমি পুরোপুরি অন্য আমিতে পরিনত হব।
নামের আগে যোগ হবে একটা ছোট্ট নাম, উপাধি... ডক্টর!
সাথে আরো কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত উপাধি পেয়ে যাব আমজনতার কাছ থেকে - কসাই, রক্তচোষা, ডাকাত আরো কত কি,
বাকি সব অগ্রজ দের মতই
এই একটা "ডক্টর " পদবীর জন্য একজন স্বপ্ন দেখা মানুষকে কতগুলো স্বপ্ন নিজ হাতে খুন করতে হয়,
তার নিজের অস্তিত্ব কে গলাটিপে হত্যা করতে হয়
সেই ইতিহাস আমজনতা কোনদিন জানবে না
কোনদিন না