প্রথম যখন দেখেছিলাম, প্রচন্ড শীতের মাঝে ময়লায় কালো হয়ে যাওয়া একটা শার্ট পরে বসে ছিলো মাছ বাজারটার পাশে। আনমনেই কাঠি দিয়ে দাগ কাটছিলো মাটিতে। বয়স বড়জোর ৮/৯ বছর হবে। চোখের মাঝে ছিলো কান্নার আভাস, কিন্তু কাঁদছিলো না। কি যেন এক অভিমানের ছোঁয়া সারাটা মুখে। তারপরের বেশ ক'য়েকটা দিন ঠিক একই জায়গায় দেখেছিলাম। হঠাৎই একদিন দেখলাম ছেলেটা আর ওখানটাতে নেই। তারপরের ২/৩ টা দিন অজান্তেই চোখ চলে যেতো মাছ বাজারের পাশের জায়গাতে। না নেই।
সেদিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে, শনিবার। আগেরদিনও অফিস বন্ধ ছিলো। সারাদিন শুয়ে বসে অলস সময় কাটিয়ে আর ভালো লাগছিলো না। মাথাটাও ধরেছিলো। অলস বিকেলে বাসা থেকে বের হলাম এককাপ চা'য়ের টানে। গন্তব্য সেই বাজার। চা খেয়ে চলে আসার পথে হঠাৎ মাছওয়ালার ডাক, "স্যার তাজা কৈ মাছ আছে, দেশী কৈ, নিয়া যান স্যার।" জানতাম কেনা হবে না, তবুও গেলাম মাছগুলো দেখতে। অল্প পানিতে দাপড়িয়ে বেড়াচ্ছে মাছগুলো। পাশে চোখ পরতেই দেখি আজো ছেলেটি ওখানে নেই। মাছওয়ালাকে জিজ্ঞাস করলাম এখানে যে ছেলেটি বসে থাকে সে কোথায়? মাছওয়ালা জানালো গত সপ্তাহ থেকে ছেলেটি আসছে না। তখনই জানলাম ছেলেটির নাম সাগু। বাড়ী কোথায় জানতে চাইলে বলতে পারলোনা। শুধু জানালো ক্যাম্পাসের পিছনের রাস্তা দিয়ে ২ কিলোমিটার গেলে একটা প্রাইমারী স্কুল আছে। স্কুলের আশেপাশের গ্রামেই হয়তো বাড়ী হবে। জানতে চাইলাম, ছেলেটি সারাদিন এখানে বসে কি করে? জানালো সারাদিনের মাছ বিক্রির পর যদি কিছু পচাঁ অবিক্রিত মাছ থেকে যায়, তা ফেলে দেয়ার সময় ছেলেটি নিয়ে যায়। বাজারের অন্য দোকানগুলো থেকেও এভাবে ফেলে দেয়া পচাঁ-গলা সবজি নিয়ে যায় দিনশেষে। কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে না আসার কারণটা জানা গেলো না।
পরেরদিনের সকালের ক্লাসের শেষে অফিস পিয়ন আজগরের আনা নাস্তা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলাম ক্যাম্পাসের পেছনের প্রাইমারী স্কুলটা সে চেনে কিনা। আজগর জানালো প্রাইমারী স্কুলে যাওয়ার পথেই তার বাড়ী। হঠাৎ তার প্রশ্ন, কেনো স্যার? তাকে সাগুর কথা জানালাম। বললাম যদি পারে ছেলেটাকে খুজেঁ বের করে আগামীকাল সকালে আমার কাছে নিয়ে আসতে।
কাজের চাপে ভুলেই গিয়েছিলাম। সকাল থেকে পরীক্ষা চলছে মিড-টার্ম প্রাকটিক্যাল। দুই শিফটের পরীক্ষা শেষ হতে হতে শেষ বিকাল গড়ালো। অফিস বন্ধ করার আগে আজগরকে শেষ কাপ চায়ের জন্য নির্দেশ। পরীক্ষার খাতাপত্র সব গুছিয়ে নিচ্ছি, রাত থেকেই দেখা শুরু করতে হবে। আজগর হঠাৎ বললো স্যার, আপনি গতকাল সাগুর কথা জিজ্ঞাস করছিলেন, ছেলেটির খবর কিছু জানেন? চমকে বললাম নাতো? কি হয়েছে? তারপরের কথাগুলো একটা একটা করে শরীরের সকল লোমকূপের গ্রন্থিক্ষরণ বাড়িয়ে দিয়েছিলো। ঠান্ডা শীতল একটা অনুভূতি নেমে এসেছিলো ঘাড় থেকে মেরুদন্ড বেয়ে। আজগর জানালো, কালরাতে জ্বর নিয়ে ছেলেটি বাজারে এসেছিলো। কিছু তরকারী টুকানোর জন্য। রাতে বাড়ী ফেরার পথে হয়তো মাথা ঘুরেই পরে যায় রাস্তার পাশে। তারপর হয়তো বুলেটের মতো ছুটে চলা বাস বা ট্রাকগুলোর কোন একটা ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে সাগুর ছোট্ট শরীরটুকু। সে দিনটি ছিলো ১৪ই ফেব্রুয়ারী...। ভালোবাসা দিবস...
১৪ই ফেব্রুয়ারী আসলেই মনে পরে কান্না লুকানো সেই চোখ দু'টোর কথা। রাস্তার পাশে আজো খুঁজে ফেরা সাগুর অভিমানী মুখ। আট-নয় বছরের ছেলের চোখে পৃথিবীর প্রতি করুণার প্রতিফলন। আমাদের সকল প্রচেষ্টাও পারবে না আর সাগুর অভিমান ভাঙাতে, পারবে না ছলছল দু'টো চোখের কান্না মুছে দিতে।
আজ এই ভালোবাসার দিনে আমাদের একটুখানি ভালোবাসার ছোঁয়াই হয়তো পারে এরকম আর সব সাগুদের মুখের অভিমানটুকু মুছে, দু'টো চোখে আনন্দের পরশ বুলাতে। চাইলেই আমরা দিতে পারি সাগুদের জন্য ভালাবাসার হাত বাড়িয়ে দিতে। আমরা কি তা করবো?
============================
প্রাককথনঃ লেখাটি ব্লগার স্বপ্নজয় ভাই, বাবুনি সুপ্তি ও kisuna আপু-র "ভালোবাসি - ভালোবাসা দিবসের লেখা সন্কলন"-এ প্রকাশিত। সংকলন বিষয়ক স্বপ্নজয় ভাইয়ের পোষ্টটি এখানে । আর সংকলনটির সরাসরি লিংক এখানে । সন্কলনটির জন্য স্বপ্নজয় ভাই, বাবুনি সুপ্তি ও kisuna আপুকে অশেষ ধন্যবাদ।
============================
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০১০ সকাল ১০:০৯