সরকার বাংলাদেশের আবাসন খাতে বিনিয়োগের জন্য ভারতীয় কোম্পানি সাহারা গ্রুপের সাথে একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছে। এতে বলা হয়েছে- “ঢাকার আশেপাশে কয়েকটি উপশহর গড়ে তোলার জন্য সরকার উপযুক্ত নির্মাতা প্রতিষ্ঠান খুঁজছে এবং সাহারা পরিবার এ কাজ করার জন্য যোগ্য প্রতিষ্ঠান। কম আয়ের মানুষদের জন্য বাসস্থান নির্মাণে দুই পক্ষ একে অপরকে সহযোগিতা করবে”।
উদ্ধৃত অংশটুকু পড়ে প্রথমে মনে যে প্রশ্ন আসে তা হলো- সরকার কি এ কাজে টেন্ডার দিয়েছিলো? সাহারা কীভাবে যোগ্য প্রতিষ্ঠান হলো? সে প্রসঙ্গে পরে আসি। আমি জানি, এ খবর পড়ে অনেকে নিশ্চয়ই আশাবাদী হয়ে উঠেছেন যে উপশহরগুলো তৈরি হলে ঢাকা শহরের জনসংখ্যার চাপ কিছুটা হলেও কমে আসবে, আবাসন সমস্যার সমাধান হবে- বিশেষ করে যেখানে এরপরে বলা আছে “কম আয়ের মানুষদের জন্য বাসস্থান নির্মাণে দুই পক্ষ একে অপরকে সহযোগিতা করবে”।
কিন্তু আমি তা হবার তেমন সম্ভাবনা দেখছি না। খবরের নিচে সাহারার পরিচিতি হিসেবে দেয়া আছে- “মহারাষ্ট্রে অ্যাম্বি ভ্যালি নামের আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলে সুনাম অর্জন করে সাহারা”। এই ‘অ্যাম্বি ভ্যালি সিটি’ নিয়ে একটু খোঁজ-খবর করে বুঝলাম- এটা আসলে উন্নত দেশের ‘রিসোর্ট-লিভিং’ জাতীয় প্রকল্প। এই আর্টিকেলে তারা তাদের অ্যাম্বি ভ্যালি সিটির টার্গেট কাস্টমার সম্পর্কে জানাচ্ছে-
We are planning to target NRIs based in the US, the UK and the UAE to sell our 7,000 plots
অর্থাৎ প্রবাসি ভারতীয়রাই তাদের মূল টার্গেট কাস্টমার। আপনি যদি পত্রিকায় খবর পড়ে ঢাকা শহরের জ্যামে বাসে ঝুলতে ঝুলতে গলদঘর্ম হয়ে ‘নিম্ন আয়ের মানুষদের’ জন্য নির্মিত ‘উপশহরে’ শান্তিতে বসবাস করার স্বপ্ন দেখে থাকেন, তবে সে গুড়ে বালি। এই ‘রিসোর্ট’ আপনার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আমার মতো বাংলাদেশের যে বিপুল সংখ্যক এনআরবি বিদেশে আছে তারাই যে এই সাহারা প্রকল্পের কাস্টমার হবে তা তাদের কথা-বার্তা ও পুরনো প্রকল্পের বৈশিষ্ট্য থেকে অনুমান করে নেয়া যায়। এবং এ বিষয়ে আমি যে খুব আক্রোশ নিয়ে লিখছি তাও না, বরং সাহারা গ্রুপের এ প্রকল্পের খবর জেনে ভেতরে ভেতরে আমিও উল্লসিত- আমাকে আর ঢাকা শহরের ঘিঞ্জির মধ্যে প্লট বা ফ্ল্যাট খুঁজতে হবে না; সাহারা আমার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসতে যাচ্ছে উন্নত বিশ্বের সমতুল্য ‘রিসোর্ট লিভিং’ প্রকল্প। এখন দেশে গেলেও আরাম করে থাকা যাবে। সাহারা নিশ্চয়ই এখানে লোডশেডিং করে রাখবে না। নিম্নবিত্ত যেমন ঢাকায় পোঙ্গামারা খাচ্ছে, তেমন খেতে থাকুক। এনআরবিদের পাশাপাশি এর কাস্টমার হিসেবে আরো দেখতে পাচ্ছি গুলশান-বনানী-বারিধারার অভিজাতদের, যারা হয়তো ঢাকার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে এই উপশহরগুলিতে তাদের ‘সেকেন্ড হোম’ গড়ে তুলবেন, আর নব্য ও পুরানো কালো টাকার মালিকদের- টাকাগুলো সাদা হবার আরেকটা জায়গা খুঁজে পাবে। সাহারা যে সবকিছু খোঁজ-খবর করে এখানে মধু চাখতে এসেছে, তার জন্য তাদের প্রশংসা না করে পারছি না। সরকারকে শুধু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়- ভাগে কত পেলেন এবং পাবেন?
খবরে দেখলাম রাজউকের চেয়ারম্যান নুরুল হুদা স্মারকপত্রে সাক্ষর করেছেন। রাজউককে অবশ্য এখানে দোষ দেবার কিছু দেখছি না। রাজউকের কাজ রাজউক করেছে। এর আগে বিডিনিউজে লিখেছিলাম একটু রাজউক নিয়ে। টাউন ইমপ্রুভমেন্ট এক্ট রাজউকের ঘাড়ে ঢাকা শহরের সমস্যা সমাধানে অনেক দায়িত্ব অপর্ণ করলেও রাজউক ব্যস্ত শুধু প্লট বাণিজ্য নিয়ে উচ্চবিত্তদের পদলেহনের কাজে। সাহারা গ্রুপের প্রকল্প তাই আশ্চর্যজনক কিছু নয়, যেমন নয় বসুন্ধরা বা আরো অনেক দেশি আবাসন কোম্পানির ভূমিদস্যুতা। বলে লাভ নেই জানি, তবু জানাতে চাই উচ্চবিত্ত তোষণে রাজউক এবং সরকারের এই ভূমিকা টাউন ইমপ্রুভমেন্ট এক্ট এবং দেশীয় আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এই দেশের বড় আয়রনি হলো দেশের রক্ষকরাই এখানে আইন ও দেশের সবচেয়ে বড় ভক্ষক।
এ লেখাটা প্রথমে লিখবো ভেবেছিলাম দেশের আবাসন খাতে বিদেশি বিনিয়োগের ইম্প্যাক্ট নিয়ে। কারণ, আবাসন খাতে আমাদের দেশি কোম্পানিগুলো যেখানে অনেক দক্ষ, উপশহর গড়ে তোলার জন্য আমাদের উপযুক্ত স্থপতি-প্রকৌশলী-নগর পরিকল্পনাবিদদের যেখানে অভাব নেই, সেখানে বিদেশি কোম্পানি নিয়ে আসা মানে- খাল কেটে কুমীর আনা- এই সহজ লাভজনক খাতকেও বিদেশের হাতে তুলে দেয়া। আর সাথে উপশহর নির্মাণের নামে ভারতীয় রড, বালু, সিমেন্টের একচেটিয়া বাণিজ্যও গড়ে ওঠার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে সাহারার বদলে দেশি কোম্পানি দিয়েও 'এ ধরনের' উপশহর গড়ে তুললে ঢাকা শহরের সমস্যার কোন সমাধান হবে না।
এর আগে টাটা এসেছিলো আমাদের কাছে গ্যাসের জন্য, এখন সাহারা এসেছে জমির বেচাকেনায় অংশ নিতে। টাটার কাজটা তাও ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো- গ্যাস উত্তোলনের ব্যাপার-স্যাপার ছিলো, লাভ-ক্ষতি দুটোরই ঝুঁকি ছিলো। সাহারারটা একেবারে চিপশট- ‘নো রিস্ক, অল গেইন’। পাগলও নাকি নিজের ভালো বুঝে, কেবল আমরা বুঝি না! ভুল বললাম, আমরা দেশেরটা না বুঝলেও, নিজেরটা ষোল আনা বুঝি।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১২ দুপুর ১:৩১