সমকামিতা কী সেটা জানার আগেই আ্মাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা খুব স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চান যে তারা সমকামিতাকে সমর্থন করেন না। এই না করার স্বাধীনতা আপনার ছিল, আছে এবং থাকবে। কেউ সেটাকে কেড়ে নিতে আসছে না। তারপরও সময় এসেছে এটা জানার যে 'সমকামিতা কী'। তাই লেখার শুরুতেই জানাতে চাই, সমকামিতা কী?
সমকামিতা- একটি যৌন প্রবৃত্তি, যা সমলিঙ্গের দুই ব্যক্তির মধ্যে প্রেম কিংবা যৌন আচরন বোঝায়। প্রবৃত্তি হিসেবে, সমকামিতা (Homosextuality) বলতে বোঝায় মূলত সমলিঙ্গের কোনো ব্যক্তির প্রতি জেগে ওঠা “এক যৌন, স্নেহ বা প্রণয়-ঘটিত স্বাভাবিক প্রবনতা”, এছাড়া এই ধরনের সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ব্যক্তিগত বা সামাজিক পরিচিতি, এই ধরনের আচরন এবং সমজাতীয় ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত এক সম্প্রদায়ের সদস্যতাও নির্দেশিত হয়।
গ্রীক সাংস্কৃতিতে যদিও কিশোর এবং নারীদের দেখা হত যৌনতা উপভোগের প্রতীক হিসেবে, কিন্তু তারপরও ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে বহু ব্যক্তি কেবল পুরুষের প্রতি প্রণয়াসক্ত থেকেছেন। তাদের কাছে ‘যৌনতা উপভোগ’ এবং ‘যৌনতার দায়িত্ব’ ছিল আলাদা। ‘যৌনতার দায়িত্ব’ পালন করতে তারা হয়ত একসময় বিয়ে করতেন, কিন্তু যৌনতা উপভোগের জন্য তারা অনেক সময়ই দ্বারস্থ হতেন তাঁর পছন্দের পুরুষ সঙ্গীর কাছে। জুলিয়াস সিজার কে তো বলাই হতো, তিনি প্রতিটি নারীর পুরুষ এবং প্রতিটি পুরুষের নারী।
সমকামিতার ইতিহাস আসলে অনেক পুরনো। প্রাচীন গ্রীসের পুরানে সমকামিতার স্পৃহার কথা জানা যায়। আসলে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই সমকামিতা সবসময়ই মানব সমাজে ছিল।গ্রীক, রোমান, চৈনিক, পাপুয়া নিউ গিনি অথবা উত্তর আমেরিকার প্রাচীন সভ্যতায়, মধ্যযুগ এবং রেনেসাঁর সময় সমকামিতের অজস্র উদাহরণ আছে। সমকামিতা ছিল অ্যাজটেক ও মায়া সভ্যতায়। হিন্দু পুরাণেও উল্লেখ পাওয়া যায় তৃ্তীয় প্রকৃ্তির।
এখন কথা হচ্ছে সমকামিতা কী জন্মগত নাকি আচরনগত? এটি বুঝতে হলে আমাদের যৌন-প্রবৃ্ত্তি বুঝতে হবে।আজকের দিনের মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন যৌন-প্রবৃ্ত্তির ক্যানভাস আসলে সুবিশাল। এখানে বিসমকামিতা যেমন আছে, ঠিক তেমনভাবেই দেখা যায় সম লিঙ্গের মানুষের মধ্যে প্রেম এবং যৌনাকর্ষন। সংখ্যাগরিষ্ঠের বাইরে অথচ স্বাভাবিক এবং সমান্তরাল ধারায় অবস্থানের কারনে এ ধরনের যৌনতাকে অনেক সময় সমান্তরাল যৌনতা বা Parallel sex নামেও অভিহিত করা হয়।
আজকের দিনের বিজ্ঞানীরা বলেন, সমকামিতা নিঃসন্দেহে যেমন আচরনগত হতে পারে, তেমনি হতে পারে জন্মগত বা প্রবৃ্ত্তিগত। এতে পরস্পর বিরোধিতা নেই। যাদের সমকামী যৌন-প্রবৃ্ত্তি জন্মগত, তাদের যৌন-প্রবৃ্ত্তিকে পরিবর্তন করা যায় না, তা সে থেরাপি দিয়েই হোক, আর ঔষধ দিয়েই হোক। সিমন লিভ দেখিয়েছেন যে, মানুষের মস্তিষ্কে হাইপোথ্যালামাস নামে একটি অঙ্গ রয়েছে, যা মানুষের যৌন-প্রবৃ্ত্তিকে নিয়ন্ত্রন করে। এটি সমকামীদের ক্ষেত্রে আকারে অনেক ভিন্ন হয়। ডিন হ্যামার তাঁর গবেষণায় আমাদের ক্রোমোজোমের যে অংশটি (Xq28) সমকামিতা ত্বরান্বিত করে তা শনাক্ত করতে সমর্থ হয়েছেন। এছাড়াও আরো গবেষণায় মনস্তাত্ত্বিক নানা অবস্থার সাথে পিটুইটরি, থাইরয়েড, প্যারা- থাইওরয়েড, থাইমাস, এন্ড্রেনালসহ বিভিন্ন গ্রন্থির সম্পর্ক আবিষ্কৃত হয়।
আমাদের যৌন-প্রবৃত্তির ক্যানভাস আসলে খুবই বিস্তৃত, এবং যৌন-প্রবৃত্তি একই ভাবে সকলের মাঝে ক্রিয়াশীল হয় না। মিল্টন ডায়মন্ড কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষনার মাধ্যমে দেখালেন যে, মানুষের মধ্যকার যৌনতার পার্থক্য আসলে পরিবেশ দ্বারা সূচিত হয় না, সূচিত হয় ‘প্রিনেটাল হরমোন’ দ্বারা।
ম্যাকহটার, স্টেফানি স্যান্ডার্স এবং জুন ম্যাকহোভার (১৯৯০) এর গবেষণা থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে শতকরা চৌদ্দ ভাগের মতো সমকামী রয়েছে। ১৯৯৩ সালের ‘জেনাস রিপোর্ট অন সেক্সুয়াল বিহেভিয়ার’ থেকে জানা যায়, পুরুষদের মধ্যে শতকরা নয় ভাগ এবং নারীদের মধ্যে শতকরা চার ভাগ সমকামি রয়েছে। সায়েন্টিফিক আমেরিকান মাইন্ড-এর ২০০৬ এর একটি ইস্যুতে সমকামিদের সংখ্যা সমগ্র জনসংখ্যার ৩ থেকে ৭ ভাগ উল্লেখ করা হয়েছে।
পৃ্থিবীতে শিল্পবিপ্লব, প্রযুক্তিবিপ্লব, এনলাইটমেন্টের পাশাপাশি হাত ধরে বিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করল ‘যৌনতার বিপ্লব’- যা মানুষের যৌনতাসংক্রান্ত সামাজিক এবং মনস্তাত্বিক ধ্যান-ধ্যারনাকে আমূলে পালটে দিল। আর যে ব্যক্তিটির গবেষণা এই যৌনতার বিপ্লবকে ত্বরান্তিত করেছিল সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আলফ্রেড কিন্সে (১৮৯৪-১৯৫৬)। কিন্সের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি দশ জন ব্যক্তির একজন সমকামী। খুব রক্ষনশীল হিসাবও যদি ধরা হয় সেটা কোনোভাবেই পৃথিবীর সামগ্রিক জনসংখ্যার শতকরা ৫ ভাগের কম হবে না।
রক্ষনশীল সমাজে তো সমকামীদের অস্বিত্ব স্বীকার-ই করা হয় না একেবারেই। খোদ ইরানে ১৯৭৯ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৪০০০ ব্যক্তিকে সমকামিতার অজুহাতে হত্যা করা হয়েছে। আমেরিকার প্রায় ৪০টি অঙ্গরাজ্যে সমকামীদের কোনো কারণ না দেখিয়ে বিভিন্ন সময়ে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সামাজিক নির্যাতন ও নিপীড়নের পাশাপাশি কয়েকটি বিষয় সমকামীদের জীবনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত তা হলো সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা, বিষণ্ণতা এবং আত্মহনন। ব্যাপারটি সব দেশের জন্যই কমবেশি প্রযোজ্য। ১৯৮৯ সালে প্রাকশিত এক রিপোর্টে দেখা যায়, প্রতিবছর আমেরিকাতে গড়ে পাঁচ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে, আর এর মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশই সমান্তরাল যৌনতার মানুষ।
বিবর্তন তত্ত্বের প্রেক্ষাপটে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে পারে সামাজিক নির্বাচন। শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই সমকামিতা আছে এমনটা নয়, সমকামিতা ছড়িয়ে আছে প্রানিজগতের সকল প্রজাতির মধ্যেও।ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে সম্প্রতি ‘Out in Nature: Homosexual Behavior in the Animal Kingdom’ নামের একটি ডকুমেন্ট্রিতে পাণিজগতের অসংখ্য সমকামিতার উদাহরণ তুলে ধরা হয়। সমকামিতার ব্যাপারটি নিখাদ বাস্তবতা। শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই নয়, পুরো প্রাণিজগতের ক্ষেত্রেই। জীববিজ্ঞানী ব্রুস ব্যাগমিল তাঁর ‘ বায়োলজিকাল এক্সুবারেন্সঃ এনিমেল হোমোসেক্সুয়ালিটি এন্ড ন্যাচারাল ডাইভার্সিটি’ বইয়ে প্রায় পাঁচশ প্রজাতির প্রানীদের মধ্যে সমকামিতার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
আসলে প্রকৃ্তিতে সবসময়ই খুব ছোট হলেও একটা অংশ ছিল এবং থাকবে যারা যৌন-প্রবৃত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের চেয়ে ভিন্ন।কিন্তু কেন এই ভিন্নতা? এর একতি উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় ইকোলজিস্ট জোয়ান রাফগার্ডেন রোথসবর্গ তাঁর ‘Evolution’s Rainbow: Diversity, Gender and Sexuality in Nature and People’ বইয়ে। তিনি বলেন, যৌনতার উদ্দেশ্য সনাতন ভাবে যে কেবল ‘জিন সঞ্চালন করে বংশ টিকিয়ে রাখা’ বলে ভাবা হয়, তা ঠিক নয়। যৌনতার উদ্দেশ্য হতে পারে যোগাযোগ এবং সামাজিকীকরন।
সমকামিতার ইতিহাসে স্টোন ওয়াল রায়ট একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। এই রায়টের কথা না জানলে কিংবা না উল্লেখ করলে সমকামিতার আলোচনা অপূর্ণই থেকে যাবে। নিউইয়র্ক সিটির গ্রীনুইচ গ্রামের ক্রিস্টফার রোডের ৫১-৫৩ নাম্বারে “স্টোনওয়াল ইন” নামে একটা রেস্তঁরা সমকামীদের বার ও আড্ডা দেওয়ার তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত ছিল বহুদিন ধরেই। ষাট-সত্তরের দশকে এ ধরনের বার গুলো ছিলো পুলিশি হামলা এবং ধরপাকরের পয়লা নম্বর লক্ষ্যবস্তু। দিনটি ছিল ১৯৬৯ সালের ২৮ শে জুন। পুলিশ খুব স্বাভাবিক নিওয়মেই গ্রীনুউইচের গ্রামের বারটিতে হানা দেয়। সাধারণত ধরপাকরের ব্যাপারটা যেটা ঘটত- খুবই গতানুগতিক এবং নিয়ম মাফিক। বারে হানা দিয়ে বারের সবাই কে বাইরে বের করে এনে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যেত পুলিশ। ২৮ জুন দিন টি বোধহয় অন্যরকম ছিল। পুলিশ বারটিতে হানা দিলে সেদিন সেখানকার লোকেরা পিছু না হটে সরাসরি পুলিশের সাথে সম্মুখ লড়াইওয়ে লিপ্ত হয়। থালা, বাসন, গ্লাস, বোতল যার সামনে যা ছিলো তাই নিয়েই পুলিশের মোকাবেলা করে। একটা পর্যায়ে পুলিশ কে রেস্তঁরার ভিতরে আবদ্ধ করে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। দিনভর আর রাত জুড়ে রায়ট চলতে থাকে। এ ধরনের পরিস্থিতি ছিল পুলিশের চিন্তারও বাইরে। এর পরদিন সমকামীদের সমর্থনে গ্রীনউইচ গ্রামের আশপাশ থেকে আরো বহু লোক এবং সংগঠন এগিয়ে আসে। সূচনা হয় নতুন এক আন্দোলনের- জন্ম হলো সমকামিতা মুক্তির আন্দোলন।
১৯৭৩ সালের ১৫-ই ডিসেম্বর আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন বিজ্ঞানস্মমত আলোচনার মাধ্যমে একমত হন যে সমকামিতা কোনো মানসিক ব্যাধি নয়, বরং এটি যৌনতার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। তারা রোগের তালিকা থেকে সমকামিতাকে বাদ দেন। এটি সমকামিতার আইনি অধিকার এবং সামাজিক স্বীকৃ্তি আদায়ের লড়াইয়ে এক বিরাট মাইল ফলক।
নিজেদের যৌনপরিচয়ের সংকট এবং তার পাশাপাশি কাছের মানুষ এবং সমাজের নেতিবাচক মনোভাব এবং অবমাননাকর পরিস্থিতি তাকে নিদারুন বিষিণ্ণতার মধ্যে ডুবিয়ে দেয়। আর বিষণ্ণতার পথ ধরে শেষ পর্যন্ত আসে আত্মহননের চিন্তা, অন্তত অনেকের মধ্যেই। এ প্রসঙ্গে ববি গ্রিফিথের আত্মহননের ঘটনাটি তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক। কিভাবে সমাজ এবং পারিবারিক চাপে ববি আত্মহত্যার পথে পরিচালিত হয়েছিল, তা এক সন্তানহারা মা বর্ণনা করেছেন ‘Prayers for Boby: A Mother’s Coming to terms with the Suicide of Her Gay Son’ নামের বইয়ে। ববি গ্রিফিতের মা যখন কিশোর ববির মধ্যে প্রথম সমকামিতার আলামত পেয়েছিলেন, দুঃশ্চিন্তায় হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ববি কে তার মতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন চেষ্টা করেন। এমনকি ববিকে সাইকোথেরাপিও (কনভার্শন থেরাপি) দেয়া হতে থাকলো নিয়মিত। কিন্তু ববি সুস্থ্ হলো না মোটেও। বরং দিনে দিনে আরো বিষণ্ণ হয়ে পড়তে লাগলো। হয়ে উঠলো হতাশাগ্রস্থ। একটা সময় পর জীবন-যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ব্রিজ থেকে ব্যস্ত রাস্তার উপর লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে।
সন্তানের আকস্মিক মৃত্যু ববির মা ম্যারি গ্রিফিথের সবটুকু একেবারে নাড়িয়ে দিয়ে গেল যেন। স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি। বহুবছর ধরে ম্যারি ভাবলেন তার সন্তানের মৃত্যুর পেছনে আসলে দায়ী কে ছিল? যতই তিনি ভাবেন ততই তিনি বুঝতে পারেন- পারিবারিক আর সামাজিক চাপ ছিলো অভিমানী ববির চলে যাওয়ার কারণ। সমাজ তাকে গ্রহন করেনি, এমনকি তার পরিবারও তাকে স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে মেনে নেয়নি। মা অবশেষে বুঝতে পারলেন তার ভুল। নিজেকে সংশোধনের উদ্যোগ নিলেন। সমকামীদের সামাজি অধিকার নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। পরে বইটির ঘটনার উপর ভিত্তি করে আমেরিকার লাইফলাইম নেটওয়ার্কে একটি তথ্যচিত্রও তৈরি করা হয়েছিল ‘Prayers for Boby’ নামে।
কোনো কিছুর অস্তিত্ব অস্বীকার করলেই তার অবস্থান বিনাশ হয়ে যায় না। গবেষণায় উঠে আসা তথ্য বলছে, পৃথিবীর জনসংখ্যার ১০ ভাগ সমকামী। এই ১০ ভাগ কখনোই প্রজন্মের ধারা টিকিয়ে রাখতে হুমকী হবে না বলে আশা রাখি।