সম্পর্কের সমাপ্তিতেও কোথায় যেন কিছু একটা থেকে যায়। অভিনামহীন- অনুযোগহীন কিছু। যেমন চায়ের কাপের চা ফুরিয়ে গেলেও এক চুমুক চা থেকে যায়। হালকা উষ্ণ সেই কাপটাতে আর ঠোঁট ছোঁয়ানো হয় না কখনো। মানুষ কাকে ভালোবাসবে আর কাকে বাসবে না, তার তো কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। তাই তো আজ যাকে ভালোবাসে হয়ত কালই তাকে আর বাসে না। কিংবা অন্তহীন বিষাদময় অনুভূতি নিয়ে কাটিয়ে দেয় একটা জীবন।
ভুলে থাকতে পারলে জীবন একভাবে না একভাবে কেটেই যায়। তারপরও ঘরের সিলিং জুড়ে আলসেমি ভরা কিছু গল্প জমে। যত্ন করে সবকিছু জমিয়ে রাখি। এমনকি ক্ষোভও। জমিয়ে রাখতে রাখতে একসময় মায়া পড়ে যায়। রেখে দিই কিংবা থেকে যায়। কষ্টগুলোকে অ-গোছালো করে রাখলেও ক্ষতি নেই, হারানোর ভয় নেই, চুরি যাওয়ার আশংকা নেই। সুখদের রাখতে হয় গুছিয়ে, আলমিরার তাকে তাকে, ন্যাপথলিনে মুড়ে... জীবনের কিছু কথা কেবল রূপ কথা নয়; তাদেরকে বরং অপরূপ কথা বলাই যুক্তিযুক্ত।
স্মৃতির খেলা বড় অদ্ভুত! স্মৃতি আর দুঃখের কোন রং হয় না। না-চাইতেই পুরোনো অনেক কিছুই মনে জায়গা করে নেয়। কারো জন্য মন খারাপ করার বিশ্রী ব্যাপারটা না থাকলে, পৃথিবীটা অর্থহীন হয়ে যেত! প্রায়শ নিষেধের বরফে ডুবিয়ে দিই ইচ্ছের আগুন। বিজ্ঞজনদের মতে এ একধরণের অসুখ। অসুখই বটে! নিরাপদ অ-সুখ! দুজন মানুষ দুটো আলাদা শহরে একই আক্ষেপ নিয়ে বেঁচে থাকার নাম ভালোবাসা! দুজন মানুষ একই সংসারে নিয়ত ঝগড়া করার নামও ভালোবাসা! নির্দিষ্ট কোনোকিছুর মধ্যে ডুবে থাকার পরও জীবনের অনেক কিছুই উহ্য, অনুক্ত আর সামঞ্জস্যহীন। অসন্তুষ্টি কি ভীষণ বদলে দেয় মানুষকে!
চাইলেই দুপুরগুলো ঘুমিয়ে উড়িয়ে দেয়া যায়। ঘুমের প্রবল প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করে, তবু আমি স্মৃতি নিয়ে কাটিয়ে দিতেই বেশি পছন্দ করি। যে অতীতগুলো এখন আগের ক্লাসের বইয়ের মতো নিরর্থক! জীবনের ক্ষনস্থায়ী বিষয়গুলোকে আমরা কী তুমুলভাবে ভালোবেসে ফেলি। চারপাশটা বড় দ্বান্দিক। সাদা না কালো, চা না কফি, ভোর না গোধূলী, পাহাড় না সমুদ্র। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের বোধগুলো হারিয়ে যায় কিংবা ফুরিয়ে যায় ...। পাছে আলসেমির ভাজ ভাংগে! তাই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়না। মাঝেমাঝে কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়াই একধরনের সিদ্ধান্ত।
জলের মাছের, ভেজা কিংবা নাভেজার প্রশ্ন ওঠে না। জীবন আমাকে সবকিছু মেপে মেপে দিচ্ছে, হোমিওপ্যাথিক ওষুধের ডোজের মতো। পাথুরে নির্লিপ্ততা এবং আত্মধ্বংসী অবহেলা। নিরাপত্তা-স্থিরতা এবং নির্জনতা চেয়েছি। জীবনের কাছে আমি জীবনকে চেয়েছি। প্রতি রাতে-প্রত্যেক রাতেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কিছু কষ্টের তো কোনো অনুবাদ হয়না। তবুও গভীর রাতের কাছে আমার কিছু ব্যক্তিগত চাওয়া থাকে, কয়েকটা তারিখ ক্যালেন্ডার থেকে মুছে দিতে ইচ্ছে করে।
আমরা প্রতিদ্বন্দী নয়, কিংবা প্রতিপক্ষও নই। তবুও ভীষণ সবুজ, ভীষণ অদ্ভুত সেই আমরা আজ কোথাও নেই; বিশ্বাসে নেই, অবিশ্বাসেও নেই। এইসব ভেবে কুটি কুটি করি অজস্র দুপুর আর উদ্বিগ্ন সন্ধ্যা। মাঝে মাঝেই ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে এই শহরকে, মহান রাত্রিকে। জীবনের রানওয়ে জুড়ে শুন্যতা থাকুক। ঝড়ের আশংকা নিয়ে দিন যাপনের উদ্বেগটুকু থাকুক। আকাশ জুড়ে মেঘের আনাগোনা থাকুক। আর থাকুক নিরবতার শক্তিমান আলিঙ্গনের আচ্ছন্নতা!
“আমার প্রেম না হয়ে ওঠার দিন,
আমার তুমুল প্রেমে পড়ার দিন
কিংবা সম্পর্কে সম্পূর্ণ হবার দিনগুলোতে
আমি কি অদ্ভুত ভাবেই না ভালোবাসতে শিখেছিলাম শব্দ-কথার জীবনটাকে...
অথচ, এখন বহু চেষ্টার পরও কেন যে দেখা মেলেনা সেই শব্দ-মিছিল এর!
শুধু একটা শব্দই বনবন করে পাক খেতে থাকে মাথার ভেতর - 'অপসৃয়মান'...”
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:৪০