somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'কয়েক মিনিট সময়ের মধ্যে বিনা চিন্তায়, বিনা ইচ্ছায়, বিনা ভালোবাসায় কি স্ত্রীলোকের গর্ভে সন্তান আসে না?'

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




'আমরা প্রত্যেকেই তিন ধরনের জীবন যাপন করি- একটা সামাজিক, একটা ব্যক্তিগত আর অন্যটা গোপনীয়'। মানুষের তৃতীয় যে গোপন জীবনযাপন সেখানে একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো 'প্রেম'। প্রেম নামক সম্পর্কের সহজলভ্যতা; সম্পর্কগুলোকে তুলনামূলক কম স্থিতিশীল ও আবেগহীন করে ফেলেছে। একই সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে গোপনীয়তাও। অবিবাহিতদের গোপনীয়তায় থাকে একসঙ্গে একাধিক প্রেম আর বিবাহিতদের জন্য বিবাহ বহির্ভূত প্রেম! প্রচলিত সমাজে যা পরকীয়া নামে বেশি পরিচিত।

অন্য অনেকের মতো আমারও ধারণা ছিল বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক আধুনিক বিষয়। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আমদানি কৃত। সামাজিক অস্থিরতা, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, নৈতিক অধপাতের কারণে মানুষ বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়ায়। মধ্যবিত্ত মানসিকতা থেকে এমনটা জানা ও ভাবা অতি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়তে (এবং পড়াতে) গিয়ে রোমান্টিক প্রণয় উপাখ্যান নিয়ে একটু আধটু পড়াশোনার সুবাদে জানলাম, পনের শতকের ইউসুফ-জোলেখা, ষোল শতকের লায়লা-মজনু কিংবা সতের শতকের পদ্মাবতী প্রণয় উপাখ্যানের মূল কাহিনি বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক।

সম্প্রতি সোস্যাল মিডিয়াতে বহুল চর্চিত অনুপম-পিয়া-পরম ত্রিকোণমিতি কান পাতলে এখনো শোনা যায়। কোনো কোনো ইউটিউব চ্যানেল তো অনুপমের হয়ে খানিকটা কেঁদেও নিজেকে হালকা করেছে। মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় যে, অনুপম-পিয়া-পরম' ই প্রথম যেখানে বিবাহ বহির্ভূত প্রেমের প্রমাণ মিলেছে। এর আগে পৃথিবীতে কখনো এমন ঘটেনি। ঘটেছে। রাধা সমস্ত চোখ ফাঁকি দিয়ে আয়ানের ঘর ছেড়ে অন্ধকার আর আষাঢ়ের ভারি জল ডিঙিয়ে ঠিক কৃষ্ণ'র বাঁশির টানে চলে আসতো। ওয়ার্দ আস সাকফী'র স্ত্রী লায়লা মজনু (কায়েস) এর প্রেম কাহিনিকে যুগ দুর্লভ ছয়টি বৈশিষ্ট্য দিয়ে আলাদা ভাবে চর্চিত। তবুও বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে এখনো মধ্যবিত্ত শ্রেণির সিদ্ধান্তে আসতে সময় লাগে, এবং দীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষে তারা এটাকে অত্যন্ত খারাপ বলে রায় দেন।

সমাজ কামের দ্বারটি খোলা রাখলেও, প্রেম-ভালোবাসার দ্বারটি বোধহয় অভ্যাস নামক তালায় আবদ্ধ করে রাখতে চায়। তাই বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানে যে দুজন মানুষের পরস্পরের কাছাকাছি পছন্দ, মূল্যবোধ, বিচার-বিশ্লেষণ ক্ষমতা ব্যতীত কোনো গভীর বন্ধন তৈরি হয় না এটা আমার বেমালুম ভুলে যাই। বিশেষ করে বিয়ে ও দীর্ঘমেয়াদে একসঙ্গে বসবাসের জন্য এগুলো অপরিহার্য সেটাকে যথা সম্ভব অশ্রুত এবং অপলাপ করে ভাবি। বিয়ের বাজারে লাভ-ক্ষতি নিয়ে যত ভাবা হয়, শেয়ারবাজারেও ততটা ভাবা হয় কিনা আমার সন্দেহ আছে।

অতঃপর (যারা অসুখী দম্পতি) আজীবন প্রেমহীন কমিটমেন্ট-এ জিইয়ে থাকে দুটো নির্বাক শরীর; যার প্রয়োজন আছে কিন্তু কোনো ভাষা নেই, অনুভব নেই। অদ্ভুত এক মুখোশের আড়ালে কখনো নিজেকে, কখনো অন্যকে ঠকানোর ছলচাতুরির খেলা চলে। এই যে সমাজের এত-শত বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের চর্চা এটা নারী ও পুরুষ উভয়েরই সম্মিলিত আকাংক্ষার ফল। যদিও একসময় এ সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সামনে এসে দাঁড়ায় ব্যক্তির যাপিত দাম্পত্য সম্পর্ক। পারিবারিক অবিভাবকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, আইনের বেড়াজাল, আবার কখনো সামাজিক সম্মান বাঁচানো জন্য এই বেশিরভাগ বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে আপাত সমাধান খুঁজে দেয়া হয়। কিন্তু সমস্যার শেকড়টা কেন সমাজের গভীরে প্রথিত হলো, কেন এই সম্পর্কের সংখ্যা হু-হু করে বাড়ছে সেটা নিয়ে সঠিক সমাধান জরুরি।

সরল রেখায় দাম্পত্য সম্পর্কে দুজন মানুষ 'বৈধ' শারীরিক সম্পর্ক, উত্তরাধিকার ও সম্পদের মালিকানার জন্যই দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। কিন্তু দাম্পত্য সম্পর্কে বিশ্বাস ও আত্মত্যাগ যখন একতরফা দায়িত্বে পরিনত হয়, তখন দাম্পত্য সম্পর্কটা বোধহয় আর অটুট থাকে না। যেকোনো পক্ষের জন্যই তা 'দাসত্ব' হিসেবে পরিগনিত হয়ে পড়ে। 'দাসত্ব' থেকে মুক্তি কে না চায়?

সামাজিক ভাবে এখনো ভাবা হয়, দাম্পত্যদূরত্ব সন্তান হলে আর থাকে না। দম্পতির মধ্যে ভালোবাসা, একসাথে থাকার আকাংক্ষার ফলাফল হলো সন্তান। আসলেই কি তাই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটাই হয়তো সত্যি। তবে এমন বক্তব্যও অস্বীকার করা যাবে যে,
'কয়েক মিনিট সময়ের মধ্যে বিনা চিন্তায়, বিনা ইচ্ছায়, বিনা ভালোবাসায় কি স্ত্রীলোকের গর্ভে সন্তান আসে না?' (দোসর চলচ্চিত্রের নায়িকা মালতীর কন্ঠে কালাতিক্রমী স্বাভিমান বাক্য। দাম্পত্যের টানাপোড়েন নিয়ে নির্মিত দোসর চলচ্চিত্রের কাহিনি প্লট বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক)

আমরা যদি 'প্রতারণাবিহীন' 'পরকীয়াবিহীন' সমাজ সত্যিই কামনা করি, তাহলে দেখতে হবে এ সমস্যার মূল কোথায়। ব্যাপারগুলোকে কেবল 'অপরাধ', 'ভুল করে অন্যায়' 'বিশ্বাসঘাতকতা' কিংবা 'ওটা খারাপ' এই ধরনের অপবাক্য আওড়ে ব্যাখ্যার চেষ্টা করে খুব একটা ভালো ফল যে পাওয়া যাবে না সেটা প্রমানিত।

ব্যক্তি মানুষ শূন্যতার এক অসীম শৃঙখলে বন্দি হয়ে পড়ছে। জীবনের মোহে পড়ে ছুটে চলছে। নিজের অবস্থার উন্নতির জন্য, ‘ভালো’ বেতনের কাজের সন্ধানে, আরও অনেক অনেক ‘ভালো’ কিছু খুঁজতে খুঁজতে ব্যক্তি মনের শূন্যতার দিকে হেলে পড়ে; ফলত অন্যদিকে অবহেলা জুড়ে বসে। তখন অবহেলিত যে তার মনে যে অভাব তৈরি হয়, তা পূরণের জন্য প্রয়োজন হয় নতুন আরেকটি সম্পর্ক। অভাব বোধের কাছে আত্মসমর্পণ করে অনেক বিবাহিত ব্যক্তিই বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে যান। শুরু হয় মোরাল ডিলেমা বা নৈতিক সংকট।

পুঁজি প্রাধান্যশীলতার আজকের দিনে এই 'নৈতিক সংকট' মানুষের নিত্য দিনের সংগী। সিদ্ধান্তহীনতার সমস্যা। যখন প্রায় সমগুরুত্ব সম্পন্ন দুটি অবস্থানের মধ্যে যথোপযুক্ত একটিকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বেছে নিতে হয়, তখনই এই সমস্যার উদ্ভব ঘটে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক অবস্থান বেছে নেওয়াটা জটিল। কারণ দুটি অবস্থানের তাৎপর্য প্রায় অভিন্ন।

লিভিং টুগেদার সেপারেটলি' তত্ত্ব মতে, কেবল যে বৈবাহিক সম্পর্কে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে ব্যাপারটা এমন নয়। বাবা, মা, ভাই, বোন, স্বামী স্ত্রী সবাই একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। একই বাড়িতে (পরিবারের সবাই) সম্পূর্ণ ভিন্ন রুচিবোধ সম্পন্ন অন্তঃকরণ নিয়ে কয়েকটা মানুষ একসঙ্গে বসবাস করে 'ঠিকই তবে মেরুকরণের মধ্যে দিয়ে প্রত্যেকেই বিচ্ছিন্ন।

'ফেইলড ম্যারেজ' সমস্যাটি কি সবসময় কেবল বিচ্ছিন্নতার?  নাকি সমস্যা অন্য কোথাও?  সমস্যাটা কি কোনো অনুর্বর জমিতে জন্ম নেওয়া অপ্রত্যাশিত কোনো বৃক্ষের ; যার অনাকাঙ্ক্ষিত শিকড় ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয় যেদিন; এখন গাড়ি যেভাবে মেকারের কাছে ঠিক করা হয়, পারিবারিক এবং বৈবাহিক সম্পর্কগুলোও তেমনই মেকারের কাছে ঠিকঠাক করে নিতে হবে। একটা ফুলকে আরো কয়েকটা দিন ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখতে...
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৬
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৯

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???



আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে আছি,
আমাদেরও যার যার অবস্হান থেকে করণীয় ছিল অনেক ।
বলা হয়ে থাকে গাছ না কেটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×