somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সেদিন আমি স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখেছিলাম (তৃতীয় খন্ড)

১২ ই জুন, ২০০৮ দুপুর ১:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(এটি একটি চলমান লেখার তৃতীয় খন্ড। দ্বিতীয় খন্ড পড়তে ক্লিক করুন )

শেষ সেমিস্টার! মাস্টার্স এবং ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেরও। কথায় বলে সব ভালো তার, শেষ ভালো যার। আমি নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করলাম একটা স্মরনীয় সমাপ্তির জন্য। দেখতে দেখতে বছরের শেষ প্রান্তে এসে দাড়িয়েছি আমি। আর মাত্র তিন মাস। চুড়ান্তু তিন মাস। এই তিন মাসই ঠিক করে দেবে সব কিছু - আমার সাফল্য, আমার ব্যার্থতা।

সেমিস্টারের শুরুতেই কিছু সমস্যায় পড়লাম। ক্রিপ্টোগ্রাফি কোর্সটা কেউ নিতে চাচ্ছে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম হচ্ছে যদি কোন কোর্সে ছয় বা ততোধিক ছাত্র না হয়, তাহলে সেটা অফার করা হয় না। আমি বহু চেষ্টা করে মাত্র দুজনকে রাজী করাতে পারলাম কোর্সটা নেয়ার ব্যপারে। এটা আমার খুব প্রিয় একটা কোর্স এবং আমি কোন ভাবেই এটা ছাড়া মাস্টার্স শেষ করতে চাচ্ছিলাম না। আকতার স্যারকে বলার পর দেখলাম স্যারও আমাকে সমর্থন দিলেন এবং নিজেই কোর্সটা নিতে চাইলেন। কিন্তু সমস্যা হলো নিয়ম। তবে যেখানে নিয়ম থাকে, সেখানে নিয়ম ভাঙ্গার নিয়মও থাকে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ছয়ের নিচে ছাত্র হলেও কোর্স অফার করা হয়। তখন সেটাকে রিডিং কোর্স বলা হয় এবং সেটা ক্লাস রুমের পরিবর্তে স্যারদের কেবিনে অনুষ্ঠিত হয়। আকতার স্যার বেশ কয়েকদিন চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত কোর্সটা অফার করালেন।

সমস্যা হলো এবার দ্বিতীয় আরেকটি কোর্স নিয়ে। আমাদের হার্ডঅয়্যার অংশ থেকে বাধ্যতামূলক একটা কোর্স করতে হতো। ডিপার্টমেন্ট চাচ্ছিল ডিজিটাল লজিকের একটা কোর্স দিতে। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা VLSI এর উপরে করবো। লেআউট সিনথেসিস এন্ড অপটিমাইজেশন নামে একটা কোর্স ছিল যেটা আমি প্রথম থেকেই নেব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম। কিন্তু এই কোর্সটা নাকি নেয়ার মত শিক্ষক তখন কেউ ছিল না। আমিও ছাড়ার পাত্র না। আকতার স্যারকে জানালাম বুয়েটের হারুন-অর-রশীদ স্যারের কথা। স্নাতক পর্যায়ে স্যার আমাদের VLSI Design কোর্স নিয়ে ছিলেন। অতঃপর সায়েন্সেস এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির ডিন আজাদ স্যার এবং আমাদের চেয়ারম্যান আকতার স্যারের সাথে হারুন স্যারের বদ্ধ-কামরা মিটিং হলো। শেষ পর্যন্ত হারুন স্যার এক শর্তে রাজী হলেন, তিনি সকাল সাড়ে আটটায় ক্লাস নেবেন। যেহেতু আমাদের মাস্টার্স ছিল সান্ধকালীন মাস্টার্স। এটা একটা সমস্যা সৃষ্টি করার কথা ছিল, কিন্তু দেখা গেল মোটামোটি সবাই এক বাক্যে রাজী। ফলে আর কোন সমস্যাই রইলো না। তৃতীয় যে কোর্সটি নিলাম, এডাপটিভ সিসটেমস, সেটা নিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের বর্তমান প্রধান, শরীফ উদ্দিন স্যার।

মনের মত সবগুলো কোর্স গুছিয়ে নিয়ে ক্লাস শুরু করার পর আবার সমস্যায় পড়লাম। এবার আর্থিক সমস্যা। আমার বাবা মারা যাবার পর ব্যাংকে নমিনি পরিবর্তন সহ বিভিন্ন ঝামেলা শুরু হয়, যার কারনে টাকা তোলা যাচ্ছিল না। তাছাড়া কিছুটা অর্থিক জটিলতার ভেতর দিয়েও যাচ্ছিলাম। তাই সহকারী রেজিস্ট্রার মাসফিক স্যারের সাথে দেখা করে জানতে চাইলাম কোন স্কলারশীপ আছে কিনা, সাথে এটাও জানালাম গত দুই সেমিস্টার (স্নাতকের শেষ সেমিস্টার থেকে ধরলে টানা তিন সেমিস্টার) আমার সিজিপিএ 4.00। স্যার জানালেন ইঞ্জিনিয়ারিং মাস্টার্সগুলো যেহেতু শুরু হয়েছে মাত্র এক বছর হচ্ছে, তাই এখনও বিশেষ কোন স্কলারশীপ চালু করা হয়নি। অন্য সব কোর্সের মত এখানেও এক বছর যাবার পর সে বছরের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে মেরিট স্কলারশীপ (বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে নাম করা স্কলারশীপ) দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু আমার মাস্টার্সইতো এক বছরেই শেষ হয়ে যাবে। ব্যাপারটা জানালে তিনি বললেন তার পক্ষে কিছুই করার নেই। তবে একটা পরামর্শ দিলেন। ফরাস স্যার (ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য) -এর বরাবর একটা আবেদন করতে বললেন যাতে আমাকে কিস্তিতে টিউশন ফিস পরিশোধ করার সুযোগ দেয়া হয়। চিন্তা করে দেখলাম স্কলারশীপের আশা ছেড়ে দিয়ে এখন কিস্তিতে পরিশোধ করার সুযোগটাই গ্রহন করা উচিত, আর সে জন্য ফরাস স্যারই আমার শেষ ভরসা। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে স্যারের কাছে আমার অনেক ঋন। যখনই বিপদে পড়েছি, স্যারের কাছে গিয়েছি। সবসময়ই স্যার চেষ্টা করেছেন সাহায্য করতে। ভাবলাম শেষ বেলায় এই সাহায্যটুকু চেয়ে দেখি।

পরদিন কিস্তিতে পরিশোধরে সুযোগ দেয়ার জন্য আবেদন নিয়ে অর্থনীতি বিভাগে গেলাম যেখানে স্যার বিভাগীয় প্রধান। স্যার তখন খুব ব্যাস্ত। দেখা পাওয়া বেশ কঠিন। তাই আবেদনপত্রটি অফিসেই রেখে আসলাম। স্যারের পি. এ. আমাকে জানালেন তিনি চেষ্টা করবে দুই-তিনদিনের মাঝে স্যারকে দেখাতে। কয়েকদিন খুব চিন্তার মাঝে ছিলাম। চতুর্থ বা পঞ্চম দিন আবার অর্থনীতি বিভাগের অফিসে গেলাম। ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম কোন ফলাফল কি এসেছে? পি.এ. আমাকে দেখে হাসছিলেন। বললেন আমি যেন দ্রুত একাওন্টস বিভাগে যাই, সেখানে আমার জন্য সুখবর অপেক্ষা করছে। বুঝতে পারলাম কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগটা পাশ হয়েছে তাহলে। বেশ শান্তি লাগলো। অন্তত কিছুটা সময়তো পাওয়া গেল। আমি আস্তে ধীরে একাওন্টস-এ গেলাম। গিয়ে জানতে চইলাম কিস্তিতে পরিশোধের ব্যাপারটা। যিনি কর্মরত ছিলেন তিনি আমার নাম শোনার পর যেন হারিয়ে যাওয়া কাউকে খুঁজে পেয়েছেন এভাবে আমাকে সম্ভোধন করলেন। তার পর বললেন আপনার কিস্তিতে পরিশোধরে আবেদন পাশ হয়নি। আমি একটু দমে গেলাম। বললাম কেন? তিনি হাসতে হাসতে বললেন কারন আপনাকে স্কলারশীপ দেয়া হয়েছে এবং আমি আপনাকে গত দুইদিন ধরে খুঁজছি। আমি অবাক হয়ে রইলাম কিছু সময়। তার পর জানতে চাইলাম এটা কি করে সম্ভব হলো, আমিতো প্রচলিত কোন নিয়মের মাঝে পড়ি না? তিনি জানালেন ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিজন ডায়রেক্টরের হাতে দুটা করে স্কলারশীপ আছে। তারা যাকে খুশি, যেভাবে খুশি এই স্কলারশীপ দিতে পারেন। তবে তারা চেষ্টা করেন যাদের সত্যই স্কলারশীপ দরকার তাদের দিতে। আমার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে (যদিও আমি পুরো আবেদনপত্রে স্কলারশীপের কথা কোথাও লিখিনি) ফরাস স্যার আমার জন্য এই স্কলারশীপের ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন। স্যারের প্রতি কৃতঙ্গতায় আমার মনটা আরেকবার ভরে উঠলো।

কোর্স এবং ফিস সক্রান্ত সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবার পর আমি পড়াশোনায় মনযোগ দিতে শুরু করলাম। হারুন স্যারের কোর্স করেছিলাম স্নাতক পর্যায়ে। তাই স্যারের ব্যপারে আমার স্পষ্ট ধারনা ছিল। স্যার একদমই কার্ভ করতে চান না। যে যেমনটা নাম্বার পেয়েছে সে তেমনই গ্রেড পাবে - এটা স্যারের নীতি। অতএব প্রথম থেকে ভালো ভাবে পড়তে শুরু করলাম এবং দুই মিডটার্মেই ৯০%-এর উপরে নাম্বার নিয়ে সর্বোচ্চ নাম্বার পেলাম। আকতার স্যারের কোর্সও মুঠিবন্দি করে ফেললাম প্রথম থেকেই। গত সেমিস্টারের কথা মনে হলে তখনও আমার ভয় লাগতো। তাই শেষ সেমিস্টারে যেন কোন সমস্যা না হয় সে ব্যপারে প্রথম থেকেই সতর্ক ছিলাম।

কিন্তু এত সতর্কতার পরও সমস্যা হয়ে গেল এডাপটিভ সিসটেম কোর্সটা নিয়ে। কেন যেন এই কোর্সটাকে ঠিক গুছিয়ে আনতে পারছিলাম না। মনের মাঝে একটা ভয় কাজ করতে শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত কি এই কোর্সটাই সর্বনাশ করবে? তাই ক্লাস যেদিন শেষ হলো, সেদিন স্যারের কাছে গিয়ে সংক্ষেপে খুলে বললাম আমার অবস্থা। স্যার হেসে জানালেন আমার অবস্থা খুব একটা খারাপ না তবে ফাইনাল পরীক্ষা ভালো দিতে হবে A পেতে হলে।

তিনটা বিষয়ের ফাইনাল পরীক্ষা এবং থিসিস সাবমিশন। আমি আমার লক্ষ্যের একে বারে দোর গোড়ায় এসে পৌছেছি। আর মাত্র সাতদিন, শেষ সাতদিন। এ সপ্তাহটাই ঠিক করে দেবে আমার স্বপ্ন কি স্বপ্নই থাকবে নাকি বাস্তবে রুপ নিবে। মনেমনে বললাম, আমার মাস্টার্স করাটা যদি ওয়ানডে ক্রিকেট হয়, তাহলে এই সপ্তাহটা হলো শেষ ওভার। মাস্টার্স জীবনের সেরা ব্যাটিংটা আমাকে এই শেষ ওভার তথা সাতদিনে করতে হবে। আমি আমার সমস্ত প্রচেষ্টাকে এক করে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম ফাইনাল স্লগ-এর জন্য! (চলবে)

২৮ এপ্রিল ২০০৮

চতুর্থ এবং শেষ খন্ড - Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০০৮ রাত ৮:৩৪
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×