“অন্ধকারে নীল জলে ঢিল ছুঁড়ে দিলে কি হয়? তারচে'জোছনায় জলের ঢেউয়ে স্বপ্নের সিঁড়ি দেখা যায়।” একটুকরো কাগজে দুটো লাইন লিখে থেমে যায় সমু। চেয়ে থাকে কালো কালো অক্ষরগুলোর দিকে। সাদা কাগজে প্রত্যেকে এক একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে উঠে আসে চোখের সামনে। কেউ কেউ চোখের গর্তে ঢুকে যেতে চায়।
আর কতদুর এগোবে নিম্নবিত্ত অর্ধ-শিক্ষিত লেখক? তোমার কাঙ্খিত নীল কমল কোন পুকুরের তলায় পাকের বুদবুদ হয়ে ভেসে উঠছে – “তুমি কি জানো ??কবি হবার সাধ হয়? লেখনা দু চারটে লাইন। দেখি সাহস কত।”
না সাহস নেই ,সাধও। আর্তনাদ করে উঠে সমু এবং সাথে সাথেই ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে হাত জোড় করে। মনের সাথে এমন এক জটিল বিষয়ে তর্কে লিপ্ত হওয়া তার ঠিক হয়নি। আসলেই তো জানেনা। সমু কিছুই জানেনা। সে কি জানতো তার স্বপ্নের ইন্জ্ঞিনিয়ার সমু চৌধুরী কেরানীর বাই প্রোডাক্ট হয়ে কবিতা কিংবা গল্প লেখে জীবন চালাবে? জানতো না। জানতো না বলেই প্রথমদিকে কষ্ট পেতো। আর সবাই যেমন পায়। এখন আর কষ্ট নেই। এসব বাড়তি কষ্ট পাবার অবকাশ কোথায়? এগুলো অসম্ভব সুখী মানুষের কাজ। পার্ট টাইম দুঃখ বিলাস ।
তবে মাঝে মধ্যে দু এক ধরণের কষ্ট এখনও বিপাকে ফেলে সমুকে। মনুষ্য জাতির স্বভাব তো। আফটার অল দৈত্য-দানব অথবা জীন-ফেরেস্তা তো আর হতে পারে না মানুষ। মাঝে মাঝে মনে হয় ওমন কিছু একটাই হয়ে যায়। কিন্তু যাই বললেই তো হওয়া যায়না। তার মানে তার বাধন কাটার ক্ষমতা নেই। রশির যেমন ইলাষ্টিসিটি গুন থাকেনা তেমন মানুষেরও ফেরেশতা হবার ক্ষমতাও নেই। তা না হলে কৃপাময় আল্লাহ মানুষকে ফেরেশতা আর ফেরেশতাকে মানুষ বানাতেন। প্রতিটি বস্তুর গুনাগুন ভিন্ন। কখনো কখনো একই ধরনের কিংবা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারনে কিছু কিছু বস্তুকে একই গোত্রভুক্ত করা যায়। যেমন সমু যখন অফিসে থাকে তখন কেরানী জাতভুক্ত আর কাগজের অফিসে কবি। কিন্তু দুজন একই রকমে শোষিত। যেমন শেয়াল তেমন মুরগী !
সমু তার পারিবারিক জীবনে অসুখী একথা বললেও বিশ্বাস্য নয়। পরিবার মানে দাম্পত্য জীবন। কিন্ত তার চালনে বলনে একথা বোঝার উপায় নেই। প্রতিটা মানুষের ভেতরেই একটা প্রতারক বাস করে। সেই ভালো,কোনো কিছু বোঝা না গেলেই ভালো। সব চুকে বুকে যায়। তোমার দুঃখ তোমার থাক। কেউ যেনো তোমার জন্য কষ্ট না পায়। কারো ভেতরে যেন তোমার বুকের যক্ষা সংক্রামিত না হয়। তাহলে সবাই খুশি হবে ।
তন্দ্রাও খুশী কথাটি বলেছিলো। সে দুবার দু অর্থে “খুশি” কথাটি বলেছে। একবার বলেছিলো –“তোমাকে পেয়ে খুশী” অরেকবার – “তোমার যত কষ্টই হোক তা আমাকে না বললেই আমি খুশি হবো।” প্রেক্ষিত ভিন্ন। তাই শব্দার্থও আলাদা হয়েছে। এই সময় প্রেম ছিলো,রোমান্চ্ঞ ছিলো। পরে প্রেমহীন বাস্তবতার প্রেক্ষিতে জীবনের দাবী হয়েছে প্রকট। জীবনকে এখন মনে হয় একটি সুন্দর কবিতার বইয়ের ক্যাঁথা বোর্ডের কংকাল ।
সকালে তন্দ্রা যখন বললো -
-“আমি চলে যাচ্ছি।”
-“যাও।” বলেছিলো সমু। সে ভাবেনি তন্দ্রা সত্যি চলে যেতে পারবে কারণ বিশ্বাস ছিলো মানুষ চাইলেই সব পারেনা। তন্দ্রার অভিমান তার কোলে ফুটফুটে চাঁদের শিশু উপহার দিতে পারেনি সমু। সমুও চায়। কিন্তু বাধা অর্থনৈতিক অক্ষমতা! এসব বাস্তব চিন্তা মাথায় রেখেই সমু ভেবেছিলো “তন্দ্রা যেতে পারবেনা।” অথচ ঘরে ফিরে যখন দেখলো তন্দ্রা নেই তখন বিশ্বাস হলো মাঝে মাঝে অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটতে পারে।
সমু জানতো যে ইউনিভার্সিটির মোহ কেটে গেলে তন্দ্রা সংসারের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে পারবেনা। চাওয়া পাওয়ার ব্যাপারটা দায়িত্বের সমান্তরালে চলে আসবে। বাস্তবতা বদলাবে। রং ফিকে হবে। তবে এতটা বদলাবে ভাবেনি সে। বাস্তববাদীদের বুঝের মধ্যেও অনেক ফাক থাকে। সমুর বোঝা উচিত ছিলো যে ,বিয়ের এক বছর পর যাই বলেই তন্দ্রা সত্যিই চলে যেতে পারে।
এমন কিছু ঝগড়াঝাটি কিংবা বড় রকমের বিবাদ সম্বাদ হয়নি। শুধু ক'দিন থেকে ওর মনটা ভারী দেখাচ্ছে। সমু বুঝতে পেরেছে একটা ফ্রিজ কিনে দিতে না পারার অক্ষমতার জন্য নীরব প্রতিবাদ জানাচ্ছে তন্দ্রা। পরে বুঝতে পেরেছে অভিমানটা ক্রোধে রূপান্তরিত হচ্ছে। সকালে অফিসে যাবার পথে তন্দ্রা যখন এসে সমুর সামনে দাঁড়ালো,তখন তার মনে হয়েছিলো রাগ পড়ে গেছে।
টাই এর নট ঠিক করতে করতে পিঠের কাছে কোট ঝুলিয়ে ধরে তন্দ্রা বললো -
-“আমি ভেবে দেখেছি ,তোমার সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখার একমাত্র উপায় তোমাকে ত্যাগ করা!”
সমু কি বলবে বুঝলো না শুধু খানিকটা স্মৃতি ভেসে উঠলো -
বটতলায় তখন বিক্ষোভ মিছিলের প্রস্তুতি চলছে ।সমুর পাশে দাঁড়িয়ে তন্দ্রা বলে
-“আমি তোমার বিরুদ্ধে একটি মিছিল বের করবো।”
-“কী ?”
-“পতন চাই,পতন চাই!” বলেই হেসে উঠে তন্দ্রা। সেদিন তন্দ্রা আসলে মুখে পতনের কথা বললেও মনে বলেছিল
-“প্রতিষ্ঠা চাই ।সম্ভাবনাময় তরুন সমু চৌধুঁরীর প্রতিষ্ঠা চাই।”
তবে সমু প্রতিষ্ঠা পায়নি। ইউনিভার্সিটি থেকে পা পিছলে ঢুকে পরে কেরানীর পাঠশালায়। তারপরো তাদের বিয়ে হয়েছিল ।
তন্দ্রা সম্পর্কে প্রবল আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছিল তিলে তিলে। মুলতঃ এটা তার নিজের প্রতি নিজের বিশ্বাসের প্রকাশ। অথচ আজ তন্দ্রা সে বিশ্বাস গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এরকমই হয়। কখনো এর চেয়ে বেশী ।
সারাদিন অফিস করে ঘরে ফেরার পথে একজোড়া কানের দুল কিনেছিল সমু । ভেবেছিল প্যাকেটটা হাতে দিয়ে ওরচুলের আগায় আদর জড়িয়ে বলবে
-“আর রাগ করোনা প্লিজ ।প্রভিডেন্ড ফান্ডের লোনের জন্য দরখাস্ত করেছি। পেলেই ছোট সাইজেরএকটা ফ্রিজ কিনে দেবো!”
ঘরে ঢুকে সমু তন্দ্রাকে দেখতে পায়না। সারা ঘরে তন্দ্রার ছোয়া। চোখ পড়ে টেবিলের এক টুকরা কাগজে। তন্দ্রার মুক্তোর মতো লেখা
-“আমি পারলাম না ।একজন কেরানীর সংসারে কবিতার ছন্দ হয়ে জীবনের অপমৃত্যু মেনে নিতে পারলাম না । আমার আশা ছিল। তবে দেখলাম তুমি আমাকে যা দিয়েছো তার বেশী দেয়ার ক্ষমতা তোমার নেই। দারিদ্রের দোহাই দিয়ে তুমি একটি অনাগত জীবনের মৃত্যু কামনা করতে পারলেও আমি মাতৃত্বের অধিকার থেকে বন্ঞ্চিত হতে পারিনা। কথা দিচ্ছি আমার সন্তান যেই হোক তাকে জানতে দেবোনা যে তুমি তার ঘাতক হতে চেয়েছিলে।
ইতি তন্দ্রা”
চিঠিটা পড়া শেষ করে পাতায় শুধু তন্দ্রার মুখ টুকু ভেসে উঠলো। কে পরাজিত হল দারিদ্রের কাছে জীবন নাকি ভালোবাসা নাকি সমুর কপাল??