somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মীজান রহমান : শোভন প্রচ্ছদ

১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ সকাল ১০:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মীজান রহমান : শোভন প্রচ্ছদ

অপরাহ্ণ সুসমিতো

মানুষ কেমন করে লেখে ? কি করে লেখে ? লিখতে যাবার আগে করোটিতে নাকি রহস্যের বেলুন দিয়ে ঘেরা অন্তরের মাঝে স্পন্দন জাগে ? শব্দের পর শব্দ কোথা থেকে জড়ো হয় ? জীবনের সাথে লেখার সম্পর্ক কতটুকু ? যাপনের জন্য বিশাল শব্দ রাশি নাকি জীবনের জন্য শব্দ মালা ? একজন মানুষের ভেতর কতগুলোন মানুষ বাস করে ?
লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত মানুষ দায়বদ্ধতার কথা বলেন,নিজের ভেতরে আচানক অচেনা কন্ঠস্বরের কথা বলেন । কি করে বোঝেন এরকম বোধের গল্প ? মীজান রহমান প্রচলিত মানুষের মতো জীবন যাপন করতে গিয়ে যখন বলেন :
তারপর একদিন হঠাৎ করেই যেন একটা অচেনা কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম নিজের ভেতর । তীক্ষ্ণ একটা শূন্যবোধ স্নায়ুর শাখা বেয়ে উঠে এল চেতনার কেন্দ্রে । অন্য একটা মানুষ সজীব হয়ে উঠলো ভেতরে । জল বিল,বৃক্ষলতার কোমল খোলস ছাড়িয়ে দেশ আমার পরিনত হলো একটা নিবস্তুক আত্মিকতায় ।
মীজান রহমানের মাঝে ‘হঠাৎ করে’ অচেনা কন্ঠস্বর করাঘাত করলো ? কোথায় করাঘাত হলো ? বোধে ? এই করাঘাত কি মাতৃভাষার প্রতি,বাংলাদেশের প্রতি ঋণ শোধের তাগাদা ? প্রচলিত বসন,ভাষন-পদ্ধতির মাঝে কোথা থেকে এরকম তূণ নাজেল ? হঠাৎ করেই ? জীবন তো তার পার্থিব বস্তু সমাহার দিয়ে মীজান রহমানকে গ্রহীতা করেছে । কোথা থেকে এলো এই কৃপাময় বোধ ? “জীবন আমাকে অশেষ করেছে,ঋণী করেছে” এই সুনির্মল বোধ ? তাহলে কি মীজান রহমানের কাছে জাগতিক চেতনা পরাভূত হয়েছে অলীক বোধের কাছে ? যা কিছু পশ্চাদপদ,সেই অবোধকে । তিনি তো অংকের ছাত্র । শুধু মাত্র ‘শূন্য’ নিয়ে আস্ত একখানা বই লিখে ফেলছেন । আসলে এখানেই তীব্র মানবিক মীজান,দর্শনেরও । এখানে জয় হয়েছে জীবনের । মীজান রহমান নিমিত্ত মাত্র । ফলিত বিজ্ঞানের সাথে সাহিত্য-দর্শনের কোন দ্বন্দ নেই । জীবনের মমতায় বিজ্ঞান তাঁকে করেছে দার্শনিক,যা কিছু ইহলৌকিক তার কাছে ঋণী,যা কিছু কল্যানের তার কাছে তিনি ঋজু ।
আমাক সুখী করে তখনি যখন বিজ্ঞান একজন মানুষকে ঋণী করে তোলে লৌকিক ব্রাত্যতায়,মানব বন্ধনে । যা কিছু লৌকিক তা বোধের আর তাই অনুপম । আমি চমকে উঠি যখন দেখি পদার্থ বিদ্যা’র একজন ছাত্র কালো বিড়াল দেখে অমঙ্গলের আশংকায় চমকে ওঠে । আর এ কারনে মীজান রহমানের লেখার অনেক ‘সীমাবদ্ধতা’ আমাকে ব্যাথাতুর করে দিলেও আমি আপ্লুত হই তাঁর দর্শনে,তাঁর লেখায় মানুষের মুখ দেখে,আমার জননীর মতো অসহায় আমার মাতৃভূমিকে দেখে । শুধুমাত্র গ্রামকে তীর্থ বলার কারনে আমি তাঁকে তিনবার করতালি দেই । কৃতজ্ঞ মানুষের কৃতজ্ঞতাবোধকে কৃতজ্ঞভাবে অনুভব করি । এখানেই আমাদের স্বর্গের সর্গ । রবীন্দ্রনাথ থেকে খানিকটা উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে :
মহাকাল নবীনকে সম্মুখে প্রকাশ করে চলেছে । মহাকালের অন্তর্গত থেকে এইভাবে পুরাণ যখন কেবলিই নবীনকে প্রকাশ করে চলে তখন তা সত্য আর যখন তার অর্থ কেবল অতীতকে পিছনে বহন করে বেড়ানো তখন সে ঘোর মিথ্যে ।
এ কারনে তাঁর লেখায় স্বরূপ,আত্মচেতনা,দর্শন,লৌকিকতা,গতি,নবীনতা ও আধুনিকতা খুঁজি । কোনো পাঠক হয়তো গল্প খুঁজে বেড়াতে পারেন । পুরাণ তো তখনি পুরান হয়ে যায় যখন তা কেবলি ‘পুরান’ ধরে রাখে । সে কারনে মীজান রহমান পুরান নন । মেকি সভ্যতা তাকে আচানক শূন্য করে তোলে বলে যে সব প্রতিষ্ঠান তাঁকে প্রাতিষ্ঠানিক করে তোলে তার বাইরের দরোজায় এসে দাঁড়ান তিনি । ‘আত্মচেতনা’ র কাছে নিজেকে প্রকাশ করেন,বিনয়ী দ্রাবিড় মানুষের মতো । ‘আউট সাইডার’ এর বিচ্ছিন্ন নায়কের মতো কিন্তু হাতে তুলে নেন নন-সিনিক্যাল বেহালা,আপাত ইতিহাস-বিচ্ছিন্ন মানুষের জন্য । সন্তুষ্টির দাঁড়িপাল্লায় মাপামাপি করলে এই বা কম কি ।
‘মানুষ’ যেখানে প্রিয় বিষয় হয়ে ওঠে,সেখানে নতুন করে কৃতিত্ব দেয়া জরুরী নয়,প্রাসঙ্গিকও নয় । লেখকের কাছে মানুষের সমতুল্য প্রধান আর কি হতে পারে ? তিনি তো আর কবিদের মতো প্রতিভার রহস্যে বসে থাকেননি । তাঁকে সামাজিক স্তর একটার পর একটা কলমের শব্দে খুলতে হয়েছে,একটু বিশদ ভাবে,ক্রমাগত ভঙ্গিতে । সাধারন মানুষের গল্প,নিজের বিনয়ী প্রকাশ তাঁকে জনপ্রিয় করেছে,পাঠকপ্রিয় করেছে সন্দেহ নেই । বিপুল অর্থে সামাজিকও করে তুলেছে,কারনে অকারনে দায়বদ্ধতা বাড়িয়েছে । বয়স এবং লেখা মীজান রহমানকে প্রাতিষ্ঠানিক করেছে ।
সারাজীবনের অর্জিত সাফল্য,নিজের ব্যক্তিগত অর্জন,প্রাপ্তি,নিজের রেওয়াজ ভাঙ্গতে তাঁর মায়া আছে । জীবনের পিঠাপিঠি কতকতে,প্যাঁচপ্যাঁচে,ধকধকে বাঁকগুলো নির্ণয়ে দ্বন্দ আছে সীমাহীন । সমস্যার আদিতে কিংবা বিকাশ প্রকরণে তাঁর সমীকরণ ভিন্ন । অফুরান সদিচ্ছা আছে বলেই তাঁর লেখায় নীতিবাদিতার সহজিয়া প্রকাশ,অনুপম প্রকাশ তাঁকে আলাদা করেছে । তিনি নিজেই তাঁর উপকরণ সৃষ্টি করেছেন । পাঠকদের পথ দেখিয়ে অভ্যস্ত নিরাপদ কাঠামো দিয়েছেন,সে কারনে হয়তো কোন মহাচরিত্র সৃষ্টি করেননি,কিন্তু সৃষ্ট বিদ্যমান চরিত্রের মানবিক অমানবিক সূত্র নিয়ে গাথা রচনা করেছেন । পাঠক হাত বাড়িয়ে দেখেছেন-এ চরিত্রকে ছুঁয়ে দেখা যায়,আয়নায় অপরের অপরূপা ছবি দেখা যায় । বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত,নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা সুবিধাভোগী মানুষের গল্প বলেছেন তিনি চেনা কায়দায়,সহজ ঢঙ্গে । সারাজীবন নিজের ব্যক্তিগত অর্জনেও শিকড়ের কাছে তাঁর ঋণ তাঁকে ব্যাকুল করেছে,তাঁর লেখার চরিত্রগুলো তাঁকে কখনো সুখী করেছে কখনো বা দু:খী । হতে পারে এর কারন তাঁর ব্যক্তি জীবনের সভ্যতা,বিনয় ও উচ্চশিক্ষা ।
মীজান রহমানের লেখায় ফল ভারে নতমুখী ব্যাপারটা আছে,অহংকার নেই,স্বেচ্ছাবাদ নেই,যথেচ্ছার নেই,শ্রেনী সংগ্রামের দ্বন্দ নেই,যৌনতা নেই । ব্যক্তি-উচ্চারণ শত ফুলে গ্রথিত হয়েছে,সামাজিক উদ্যম,আদি দ্বন্দ,মধ্যবর্তী বিকাশ ও পরিণয় কিংবা বিকিরণ অনেক সময় দমিত হয়েছে । স্বদেশের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাঁর ফ্ল্যাশব্যাক স্বত্তেও তিনি দেশ নির্বাচন করেন তাঁর লেখায়,দেশের মানুষগুলো । একেবারে আটপৌরে তাঁর মানুষগুলো,মানচিত্রগুলো । ‘বিবি’ , ‘বাবার চিঠি’ ইত্যাদি থেকে পুরানো ঢাকার সড়ক,ঘিঞ্জি গলিগুলো,বাবার পেশা থেকে পরিবারবর্গে ঘিরে থাকা মানুষগুলো-এ সবই বড্ড চেনা মানুষ আমাদের । ওদের না পাওয়ার যন্ত্রণা,উপরের সিঁড়ি পাবার বাসনা পাঠকের বাসনা যন্ত্রনার সাথে বিলীন হয়ে গেছে । মিশেল ফুকো’র ‘লিমিট য়্যাটিচিউড’ এর মতো পাঠক পাঠ করেন আর দেখেন যে চরিত্রগুলোকে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়,এ যে বড় চেনা মানুষের জলছবি । তখনি পাঠক লেখকের সাথে একাত্মবোধ করেন,মিশে যান । পাঠক মীজান রহমানকে আর দূরবর্তী মনে করেন না,আপন দলের মানুষ করে নেন । এটাই বোধ করি লেখক মীজান রহমানের কৃতিত্বের টুপিতে সবচেয়ে বড় পালক । আর এ কারণেই শোভন প্রচ্ছদের পালক সমৃদ্ধ মীজান রহমানকে পড়ি । বারবার পড়ি ।

Click This Link
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×