মীজান রহমান : শোভন প্রচ্ছদ
অপরাহ্ণ সুসমিতো
মানুষ কেমন করে লেখে ? কি করে লেখে ? লিখতে যাবার আগে করোটিতে নাকি রহস্যের বেলুন দিয়ে ঘেরা অন্তরের মাঝে স্পন্দন জাগে ? শব্দের পর শব্দ কোথা থেকে জড়ো হয় ? জীবনের সাথে লেখার সম্পর্ক কতটুকু ? যাপনের জন্য বিশাল শব্দ রাশি নাকি জীবনের জন্য শব্দ মালা ? একজন মানুষের ভেতর কতগুলোন মানুষ বাস করে ?
লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত মানুষ দায়বদ্ধতার কথা বলেন,নিজের ভেতরে আচানক অচেনা কন্ঠস্বরের কথা বলেন । কি করে বোঝেন এরকম বোধের গল্প ? মীজান রহমান প্রচলিত মানুষের মতো জীবন যাপন করতে গিয়ে যখন বলেন :
তারপর একদিন হঠাৎ করেই যেন একটা অচেনা কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম নিজের ভেতর । তীক্ষ্ণ একটা শূন্যবোধ স্নায়ুর শাখা বেয়ে উঠে এল চেতনার কেন্দ্রে । অন্য একটা মানুষ সজীব হয়ে উঠলো ভেতরে । জল বিল,বৃক্ষলতার কোমল খোলস ছাড়িয়ে দেশ আমার পরিনত হলো একটা নিবস্তুক আত্মিকতায় ।
মীজান রহমানের মাঝে ‘হঠাৎ করে’ অচেনা কন্ঠস্বর করাঘাত করলো ? কোথায় করাঘাত হলো ? বোধে ? এই করাঘাত কি মাতৃভাষার প্রতি,বাংলাদেশের প্রতি ঋণ শোধের তাগাদা ? প্রচলিত বসন,ভাষন-পদ্ধতির মাঝে কোথা থেকে এরকম তূণ নাজেল ? হঠাৎ করেই ? জীবন তো তার পার্থিব বস্তু সমাহার দিয়ে মীজান রহমানকে গ্রহীতা করেছে । কোথা থেকে এলো এই কৃপাময় বোধ ? “জীবন আমাকে অশেষ করেছে,ঋণী করেছে” এই সুনির্মল বোধ ? তাহলে কি মীজান রহমানের কাছে জাগতিক চেতনা পরাভূত হয়েছে অলীক বোধের কাছে ? যা কিছু পশ্চাদপদ,সেই অবোধকে । তিনি তো অংকের ছাত্র । শুধু মাত্র ‘শূন্য’ নিয়ে আস্ত একখানা বই লিখে ফেলছেন । আসলে এখানেই তীব্র মানবিক মীজান,দর্শনেরও । এখানে জয় হয়েছে জীবনের । মীজান রহমান নিমিত্ত মাত্র । ফলিত বিজ্ঞানের সাথে সাহিত্য-দর্শনের কোন দ্বন্দ নেই । জীবনের মমতায় বিজ্ঞান তাঁকে করেছে দার্শনিক,যা কিছু ইহলৌকিক তার কাছে ঋণী,যা কিছু কল্যানের তার কাছে তিনি ঋজু ।
আমাক সুখী করে তখনি যখন বিজ্ঞান একজন মানুষকে ঋণী করে তোলে লৌকিক ব্রাত্যতায়,মানব বন্ধনে । যা কিছু লৌকিক তা বোধের আর তাই অনুপম । আমি চমকে উঠি যখন দেখি পদার্থ বিদ্যা’র একজন ছাত্র কালো বিড়াল দেখে অমঙ্গলের আশংকায় চমকে ওঠে । আর এ কারনে মীজান রহমানের লেখার অনেক ‘সীমাবদ্ধতা’ আমাকে ব্যাথাতুর করে দিলেও আমি আপ্লুত হই তাঁর দর্শনে,তাঁর লেখায় মানুষের মুখ দেখে,আমার জননীর মতো অসহায় আমার মাতৃভূমিকে দেখে । শুধুমাত্র গ্রামকে তীর্থ বলার কারনে আমি তাঁকে তিনবার করতালি দেই । কৃতজ্ঞ মানুষের কৃতজ্ঞতাবোধকে কৃতজ্ঞভাবে অনুভব করি । এখানেই আমাদের স্বর্গের সর্গ । রবীন্দ্রনাথ থেকে খানিকটা উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে :
মহাকাল নবীনকে সম্মুখে প্রকাশ করে চলেছে । মহাকালের অন্তর্গত থেকে এইভাবে পুরাণ যখন কেবলিই নবীনকে প্রকাশ করে চলে তখন তা সত্য আর যখন তার অর্থ কেবল অতীতকে পিছনে বহন করে বেড়ানো তখন সে ঘোর মিথ্যে ।
এ কারনে তাঁর লেখায় স্বরূপ,আত্মচেতনা,দর্শন,লৌকিকতা,গতি,নবীনতা ও আধুনিকতা খুঁজি । কোনো পাঠক হয়তো গল্প খুঁজে বেড়াতে পারেন । পুরাণ তো তখনি পুরান হয়ে যায় যখন তা কেবলি ‘পুরান’ ধরে রাখে । সে কারনে মীজান রহমান পুরান নন । মেকি সভ্যতা তাকে আচানক শূন্য করে তোলে বলে যে সব প্রতিষ্ঠান তাঁকে প্রাতিষ্ঠানিক করে তোলে তার বাইরের দরোজায় এসে দাঁড়ান তিনি । ‘আত্মচেতনা’ র কাছে নিজেকে প্রকাশ করেন,বিনয়ী দ্রাবিড় মানুষের মতো । ‘আউট সাইডার’ এর বিচ্ছিন্ন নায়কের মতো কিন্তু হাতে তুলে নেন নন-সিনিক্যাল বেহালা,আপাত ইতিহাস-বিচ্ছিন্ন মানুষের জন্য । সন্তুষ্টির দাঁড়িপাল্লায় মাপামাপি করলে এই বা কম কি ।
‘মানুষ’ যেখানে প্রিয় বিষয় হয়ে ওঠে,সেখানে নতুন করে কৃতিত্ব দেয়া জরুরী নয়,প্রাসঙ্গিকও নয় । লেখকের কাছে মানুষের সমতুল্য প্রধান আর কি হতে পারে ? তিনি তো আর কবিদের মতো প্রতিভার রহস্যে বসে থাকেননি । তাঁকে সামাজিক স্তর একটার পর একটা কলমের শব্দে খুলতে হয়েছে,একটু বিশদ ভাবে,ক্রমাগত ভঙ্গিতে । সাধারন মানুষের গল্প,নিজের বিনয়ী প্রকাশ তাঁকে জনপ্রিয় করেছে,পাঠকপ্রিয় করেছে সন্দেহ নেই । বিপুল অর্থে সামাজিকও করে তুলেছে,কারনে অকারনে দায়বদ্ধতা বাড়িয়েছে । বয়স এবং লেখা মীজান রহমানকে প্রাতিষ্ঠানিক করেছে ।
সারাজীবনের অর্জিত সাফল্য,নিজের ব্যক্তিগত অর্জন,প্রাপ্তি,নিজের রেওয়াজ ভাঙ্গতে তাঁর মায়া আছে । জীবনের পিঠাপিঠি কতকতে,প্যাঁচপ্যাঁচে,ধকধকে বাঁকগুলো নির্ণয়ে দ্বন্দ আছে সীমাহীন । সমস্যার আদিতে কিংবা বিকাশ প্রকরণে তাঁর সমীকরণ ভিন্ন । অফুরান সদিচ্ছা আছে বলেই তাঁর লেখায় নীতিবাদিতার সহজিয়া প্রকাশ,অনুপম প্রকাশ তাঁকে আলাদা করেছে । তিনি নিজেই তাঁর উপকরণ সৃষ্টি করেছেন । পাঠকদের পথ দেখিয়ে অভ্যস্ত নিরাপদ কাঠামো দিয়েছেন,সে কারনে হয়তো কোন মহাচরিত্র সৃষ্টি করেননি,কিন্তু সৃষ্ট বিদ্যমান চরিত্রের মানবিক অমানবিক সূত্র নিয়ে গাথা রচনা করেছেন । পাঠক হাত বাড়িয়ে দেখেছেন-এ চরিত্রকে ছুঁয়ে দেখা যায়,আয়নায় অপরের অপরূপা ছবি দেখা যায় । বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত,নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা সুবিধাভোগী মানুষের গল্প বলেছেন তিনি চেনা কায়দায়,সহজ ঢঙ্গে । সারাজীবন নিজের ব্যক্তিগত অর্জনেও শিকড়ের কাছে তাঁর ঋণ তাঁকে ব্যাকুল করেছে,তাঁর লেখার চরিত্রগুলো তাঁকে কখনো সুখী করেছে কখনো বা দু:খী । হতে পারে এর কারন তাঁর ব্যক্তি জীবনের সভ্যতা,বিনয় ও উচ্চশিক্ষা ।
মীজান রহমানের লেখায় ফল ভারে নতমুখী ব্যাপারটা আছে,অহংকার নেই,স্বেচ্ছাবাদ নেই,যথেচ্ছার নেই,শ্রেনী সংগ্রামের দ্বন্দ নেই,যৌনতা নেই । ব্যক্তি-উচ্চারণ শত ফুলে গ্রথিত হয়েছে,সামাজিক উদ্যম,আদি দ্বন্দ,মধ্যবর্তী বিকাশ ও পরিণয় কিংবা বিকিরণ অনেক সময় দমিত হয়েছে । স্বদেশের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাঁর ফ্ল্যাশব্যাক স্বত্তেও তিনি দেশ নির্বাচন করেন তাঁর লেখায়,দেশের মানুষগুলো । একেবারে আটপৌরে তাঁর মানুষগুলো,মানচিত্রগুলো । ‘বিবি’ , ‘বাবার চিঠি’ ইত্যাদি থেকে পুরানো ঢাকার সড়ক,ঘিঞ্জি গলিগুলো,বাবার পেশা থেকে পরিবারবর্গে ঘিরে থাকা মানুষগুলো-এ সবই বড্ড চেনা মানুষ আমাদের । ওদের না পাওয়ার যন্ত্রণা,উপরের সিঁড়ি পাবার বাসনা পাঠকের বাসনা যন্ত্রনার সাথে বিলীন হয়ে গেছে । মিশেল ফুকো’র ‘লিমিট য়্যাটিচিউড’ এর মতো পাঠক পাঠ করেন আর দেখেন যে চরিত্রগুলোকে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়,এ যে বড় চেনা মানুষের জলছবি । তখনি পাঠক লেখকের সাথে একাত্মবোধ করেন,মিশে যান । পাঠক মীজান রহমানকে আর দূরবর্তী মনে করেন না,আপন দলের মানুষ করে নেন । এটাই বোধ করি লেখক মীজান রহমানের কৃতিত্বের টুপিতে সবচেয়ে বড় পালক । আর এ কারণেই শোভন প্রচ্ছদের পালক সমৃদ্ধ মীজান রহমানকে পড়ি । বারবার পড়ি ।
Click This Link