somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তুমি আমার পাশে বন্ধু হে বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো!

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১১ সকাল ১১:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু বকরের মৃত্যুর এক বছর পার হইয়া গেছে । এই এক বছরে আরো অনেক আবু বকর নাই হই গেছে।
আইজকা তারে নিয়া মহাত্না খোমেনী ইহসানের একখান লেখা পুনর্পাঠ করতেছি





ভোরে একবার জেগেছি। হৃদয় শান্ত করতে। ওজু করেছি। নামাজ পড়েছি। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছি। বারবার। অনেক পরিচিত মানুষকে দেখেছি ছুরি, চাপাতি হাতে খুন করতে যেতে। পরিচিত মানুষদের গলায় ওরা ছুরি, চাপাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ফিনকি দিয়ে বেরুচ্ছে তাজা নীল রক্ত। রক্ত আমার হাতে-মুখেও লাগছে। চিত্কার দিয়ে কয়েকবার জেগে উঠেছি। বুক ধড়ফড় করছিল। ঢক ঢক করে পানি গিলেছি। ভয় কাটেনি।

কেমন করে কাটবে? আগের রাতটা এত বীভত্স কেটেছে! আমার দেশ থেকে ফিরে প্রায়ই যে হলে আড্ডা দিতে যেতাম, সেখানেই খুনিরা তত্পর ছিল ওই রাতে। সারা রাত। ওরা ছাত্রলীগ, পুলিশ, প্রক্টর, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ইত্যাদি কত বিশেষণে যে বিশিষ্ট! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি শুভ জানাল, ওদের সম্মিলিত আক্রমণে ওই রাতে মারাত্মক আহত আবু বকর সিদ্দিক ও উজ্জ্বল মরণের পথে ধীরপায়ে হেঁটে যাচ্ছে।

পাঠকমেলার সহকারী পরিচালক আরীফের ফোনে আবারও ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে ৯টায়। জানাল আবু বকরের মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত করেছে চিকিত্সকরা। এতটুকু খবর! এতটুকুতেই আমার পৃথিবীটা কালো অন্ধকারে ঢেকে গেছে। আমি আবু বকরকে জানতাম। সংবাদপত্রগুলো, যারা খবর দিয়েছিল তার থেকেও বেশি জানতাম আমি ওকে। বলা হয়েছে, আবু বকর সাধারণ ছাত্র। রাজনীতি করত না।

কিন্তু আমি জানতাম আবু বকর উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী থেকে একটি ছাত্র সংগঠনের কর্মী ছিল। নিয়মিত ও নামাজ পড়তে যেত হলের মসজিদে। মাঝে মাঝে ওই মসজিদে ঘুমাত। এজন্য কতজন যে আড়চোখে ওর দিকে তাকাত! সেই সংগঠনের কোনো নেতা-কর্মীই কাপুরুষের মতো চুপ করে আছে। ওর জন্য একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি।

কিন্তু আমাকে করতে হচ্ছে। আবু বকর ২০০৮ সালের ১৪ আগস্ট আমার সঙ্গে সর্বশেষ মিছিল করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। জরুরি অবস্থার সময় আমি নির্যাতন প্রতিরোধ ছাত্র আন্দোলন নামের একটি সংগঠনের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেছি। যার মাধ্যমে রাজনৈতিক ও সাধারণ সব পর্যায়ের ছাত্রকে নিয়ে ফখরুদ্দীন-মইন উ’র পতন, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ রাজনীতিকদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করেছি।

সেই দিনগুলো আজ অতীত হয়ে গেছে। রাজনীতিকরা মুক্ত হয়েছেন। জরুরি অবস্থার অবসান হয়েছে। ফখরুদ্দীন-মইনও বিদায় নিয়েছে। রাজনৈতিক ছাত্রদের মধ্যে সরকারের গ্রুপ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে দখলদারিত্ব পেয়েছে বললে শেষ হয় না, খুন করার লাইসেন্স পেয়েছে। আর বিরোধী দলের গ্রুপটার ছাত্ররা পদ পেয়েছে, কোন্দল করার অধিকার পেয়েছে। কিন্তু সাধারণ ছাত্ররা কিছুই পায়নি। আমিও না।

আগের মতোই দু’মুঠো ভাতের জন্য সংবাদপত্রে শরীরের ঘাম বেচি। প্রতিদান যা পাওয়ার আবু বকরই পেল। পুলিশের ছোড়া থ্রি নট থ্রি রাইফেলের গুলির স্পর্শ পেয়েছে ও। ওই স্পর্শে আজ সে না ফেরার দেশে। এই দেশে, এই রাষ্ট্রে ও ছিল নিরীহ মেধাবী শিক্ষার্থী। এই অবমাননাকর সাধারণত্বের পরিচয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে অবহেলার সঙ্গে তিন রাত পার করে ও চিরবিদায় নিল। কেউ বলেনি আবু বকর এই দুঃসময়ের হানাদারিতে শহীদ হয়েছেন।

আমি ভেবে ভেবে পেরেশান হচ্ছি—আবু বকর তুমি যেখানে গিয়েছ, সেখানে কি শহীদের মর্যাদায় নীল প্রজাপতি হয়ে বেহেস্তের ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছ। নাকি সেখানেও রাজনীতির মাস্তানি আছে? বেহেস্তের কর্তৃপক্ষ হিসেবে দলীয় উপাচার্য, প্রক্টর ও খুনি পুলিশ বাহিনী আছে? আর এরা কি তোমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মতো করে বেহেস্তেও অবহেলার সঙ্গে ফেলে রেখেছে?

এসব ভাবি আর স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে কান্না চেপে রাখতে পারি না। আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি—পুলিশ আবু বকরের কক্ষে ঢুকে বেধড়ক পেটাচ্ছে। রুমের ভেতরে চারটি টিয়ার শেল ছুড়ে মারল। ধোঁয়া থেকে বাঁচতে ও লেপ-কাঁথা মুড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল। কিন্তু ধোঁয়ার ঝাঁঝ সহ্য করতে না পেরে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। সেখানেই ঘাতক বুলেটটি ঢুকে পড়ল আবু বকরের খুলিতে।
এই দৃশ্য যখনই চোখে ভাসে নিজেকে শান্ত রাখতে পারি না। দ্রোহের আগুনে পুড়ে পুড়ে যাই। চোখের জলে লিখে ফেলি কিছু করতে না পারার গ্লানি। কষ্ট চেপে রাখতে না পেরেসামহোয়ারইন ব্লগে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম —‘আজ সুইসাইড বোম্বার হতে ইচ্ছে করে, পলায়নের গ্লানিতে পুড়তে না।’ ওই পোস্টে বলেছিলাম—‘কেন এখনও ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ও প্রক্টরের তখতে তাউস পুড়ে যায়নি। কেন শাহবাগ থানায় হামলা হলো না। কেন খুনি পুলিশকে থানা থেকে বের করে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে জুতাপেটা করা হচ্ছে না, থুঁথুঁ দেয়া হচ্ছে না। কেন হত্যার বদলে হত্যার দাবিতে শোকে মুহ্যমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশটা বিদীর্ণ হচ্ছে না। কেন আজ মিছিল হয় না, মিছিল যায় না খুনের বদলা নিতে। ....আজ আমার ইচ্ছে করে নিজেকে সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা দিতে। তামিল টাইগারদের মতো, হামাসের গেরিলাদের মতো সুইসাইড বোম্বার হতে ইচ্ছে করে। কারণ, আমি জানি আমাদের রাষ্ট্র, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকার, সরকারি ছাত্র সংগঠন একেকটি হানাদারি যন্ত্র। যারা খুন সংঘটনে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে, তাদের কাছে বিচার চাওয়া যায় না। তাদের রাষ্ট্রের বিচারকের মুখোমুখি হতে ঘেন্না লাগে...।’

তারপর? তারপর বসে থাকি। ব্যস্ত ঢাকায়, ব্যস্ততার পূজো করি। আর কিছু করা হয় না। কিন্তু অন্তরজুড়ে দাপাদাপি করে গত তিন বছর মাথায় নারকেল তেল না দেয়া আবু বকরের মা রাবেয়া খাতুনের আর্তি। দিনমজুর বাবা রুস্তম আলী, মুদি দোকানি বড় ভাই আব্বাস আলী, ছোট ভাই দশম শ্রেণীর ছাত্র ফারুক ও ছোট বোনটির চোখের পানি এত শীতল আর ভয়ঙ্কর! টাঙ্গাইলের মধুপুরের আকাশটায় শোকের মেঘ যেভাবে ঢেকে রেখেছে তার ফাঁক গলে সূর্যটা আর কোনোদিন রোদ বিলাতে পারবে বলে বিশ্বাস হয় না।

আমি আজ কাউকে দোষ দিই না। বিচারের দাবিতে মিছিলে স্লোগান তুলি না। কারণ, দরিদ্র পরিবারের আবু বকরকে যেন ঈশ্বরই ঈর্ষা করেছিল, ভীষণ। কারণ ও দারিদ্র্যকে উপেক্ষা করে ঈশ্বর হতে চেয়েছিল। বানাতে চেয়েছিল সুন্দর পৃথিবী। তাই ঈশ্বর তার শত্রু হয়েছিল। এ কারণেই পারেনি আবু বকর। তার অভিশাপেই তার প্রাণ উড়ে গেছে না ফেরার দেশে। অথচ ঈশ্বরের সময়ই হলো না ফিরে তাকাবার!

আমি যদি নিজেকে অস্বীকার না করি, আত্মার ডাককে উপেক্ষা না করি তাহলে আজ এতটুকুই প্রার্থনা করি, আবু বকর, ভাই আমার! দুঃসময়ের বন্ধু—‘তুমি আমার পাশে বন্ধু হে বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো!/আমি মেঘের দলে আছি, আমি ঘাসের দলে আছি,/তুমিও থাকো বন্ধু হে, বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো!/রোদের মধ্যে রোদ হয়ে যাই, জলের মধ্যে জল,/বুকের মধ্যে বন্ধু একটা নিঃশূন্য অঞ্চল! বুকের মধ্যে বন্ধু একটা নিঃশূন্য অঞ্চল!/তুমি আমার পাশে বন্ধু হে বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো!/আমি পাতার দলে আছি, আমি ডানার দলে আছি,/তুমিও থাকো বন্ধু হে, বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো! /মেঘের মধ্যে রোদ হয়ে যাই, ঘাসের মধ্যে ঘাস,/বুকের মধ্যে হলুদ একটা পাতার দীর্ঘশ্বাস! /বুকের মধ্যে হলুদ একটা পাতার দীর্ঘশ্বাস! /তুমি আমার পাশে বন্ধু হে বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো!/তুমি আমার পাশে বন্ধু হে বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো!
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১১ সকাল ১১:৪০
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

×