পৃথিবীতে বিশ্বাস ও ধর্মজ্ঞান এর সূচনা ঘটে অ্যানিমিজম বাংলায় বললে প্রকৃতি পূজা থেকে। এই সর্বপ্রাণবাদ বা প্রকৃতিপূজার ধারনা এতোটাই প্রাচীন পুরাতন প্রস্তর যুগেও এর প্রমান পাওয়া যায়। তার অর্থ দাঁড়ায়, মানুষ কৃষি কাজ শেখার আগে, কলোনাইজ সোসাইটি সিস্টেম থেকেও প্রাচীন বিশ্বাস এই সর্বপ্রাণবাদ। বিলুপ্ত এই বিশ্বাস এখন টিকে আছে কিছু জাতিগোষ্ঠীর মাধ্যমে। বাংলাদেশেও এদের কিছু গোষ্ঠী বাস করে!
আমি নৃবিজ্ঞানের ছাত্র নই। কিন্তু মানুষের ধর্ম, বিশ্বাস, বিবর্তন, দর্শন, প্রকৃতি, পরিবেশ, অভিযোজন, শিল্প, সংস্কৃতি, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং এদের ক্রমবর্ধমান বিবর্তনের প্রতি আগ্রহ আছে। বিশ্বায়নের যুগে মানুষের নিজেদের মত ও দর্শন পরিবর্তন হয় সময়ের চাইতেও দ্রুত৷ সেটেলারদের দৌরাত্ম্য আর বিশ্বায়নের ক্যান্সারেও নিজেদের আইডেন্টিটি অক্ষুন্ন রেখে টিকে আছে কিছু সম্প্রদায়, ম্রো বা মুরং সেসব গোষ্ঠী একটা যারা এখনো এই পুরোনো অ্যানিমিজমের চর্চা করে!
অ্যানিমিজম বা প্রকৃতিবাদ কি? অ্যানিমিজম হলো এমন একটা বিশ্বাস যেখানে সকল ননহিউম্যান এক্সিস্ট্যান্সকে সপ্রাণ ভাবা হয়। মোদ্দা কথা একজন অ্যানিমিস্ট বিশ্বাস করে গাছ, লতা, পাথর, পানি, মাটি, পাহাড়, ঝিড়ি সকলের আলাদা আত্মা আছে, প্রাণ আছে। এ আত্মার আলাদা নামও থাকে। তবে ঈশ্বরের কোন কন্সেপ্ট সাধারনত এনিমিজমে থাকে না। তবে অনেকে বিশ্বাস করে এই সব আত্মা কারো অধীনস্থ। সাহায্য প্রার্থনা করে কোন নির্দিষ্ট আত্মার কাছে। ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকতে পূজা করে। অ্যানিমিজম আসলে একটা একক বা ঐক্যবদ্ধ বিশ্বাস ব্যবস্থা না, এটি একটা বৈচিত্র্যময় এবং গতিশীল বিশ্বাস যেটা সংস্কৃতি এবং প্রেক্ষাপট জুড়ে পরিবর্তিত হয়।
ম্রোদের প্রতি আমার আগ্রহ আছে। দেশের সবচেয়ে দূর্গম পরিবেশে প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নিজেদের মতো করে এডাপটেশন, স্কিল ডেভোলাপমেন্ট অভিভূতকর। নিজেদের কাপড় বোনার জন্য সূতা থেকে কাপড়, টারশিয়ারি যুগের অনুর্বর পাহাড়ি জমিতে হাড় ভাঙ্গুনি জুম চাষ, আর শিকার করে নিজেদের পুরো জীবন ক্ষয় করে ফেলে। শুধু সার্ভাইভাল ইন্সটিন্ক্ট নিয়ে জীবন পার করে দেয়াটাই গহীনের একমাত্র কাব্য। তীব্র খাদ্যাভাব, পানির অভাবের মাঝেও তারা কখনো বিনা কারনে কোন হত্যা করেনা৷ তারা জানে এই পাহাড়, জঙ্গল, ঝিরি কাল না থাকলে তাদের অস্তিত্ব সংকট দেখা দিবে। প্রাণ প্রকৃতির প্রতি এই অসীম সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই তাদের প্রতি আমার আগ্রহ বাড়িয়েছে।
শেষ বান্দরবান ভ্রমনে এক পাড়ায় মানুষের হাতে একটা মোবাইলের মতো যন্ত্র দেখি৷ ছবির যন্ত্রটাই। বেশ কাজের ও দরকারী। টর্চ লাইট, সাথে এফ এম রেডিও। চার্য দেয়ার জন্য বিদ্যুৎও লাগেনা। পুরোটাই সোলার পাওয়ারড! কিন্তু এতোকিছুর মাঝে যেইটা আমাকে ভাবিয়েছে সেটা হলো এর ভেতর রয়েছে গস্পেল। বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট আর কিছু ক্রিশ্চিয়ান ওয়াজ মাহফিল!
কোন এক মিশনারির ফাদার তাদের কাছে এই যন্ত্র তুলে দিয়ে গেছে। তাদের শত বছরের পালিত ধর্ম বিশ্বাস এখন কয়েক বছরেই বদলে যাবে৷ পাড়ায় স্কুলের আগে গীর্জা বসবে। "চিয়াছৎ প্লায়" বদলে "ক্রিসমাস" হয়ে যাবে। পোষাক পরিচ্ছেদ, খাদ্যাভ্যাস সব কিছুতেই আস্তে আস্তে পালটে যাবে। এতোদিন যারা প্রকৃতিতে একটা অংশ হিসেবেই বাস কতো ক্রমশ আরোও শক্তিশালী হয়ে উঠবে৷ যেই ভালোবাসায় নিজেদের বিশ্বাসে টিকিয়ে রেখেছিলো আমাদের এই সংরক্ষিত বনাঞ্চল। আরেকটা বিশ্বাসই ধ্বংস করে দিবে এই বন।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০২৪ সকাল ১১:৩১