ইলম অর্থ জ্ঞান। সাধুর জ্ঞান না শয়তানের জ্ঞান নির্দিষ্ট নয়, যেকোনো জ্ঞান। তা হ’লে আলিম মানে তত্ত্বজ্ঞ; কোন তত্ত্বে -জ্ঞ, ধর্মতত্ত্ব হয়ে থাকলে তা ইসলাম না খ্রিস্ট নাকি অন্য কিছু, সেও নির্দিষ্ট নয়। কিন্তু এই ঘরানার শব্দ যারা বেশি ব্যবহার করে তারা এমনটা মনে করে না। ভাবে ইলম মানে কেবল ইসলামি বিদ্যা এবং আলিম মানে ইসলামধর্মজ্ঞ, এই শব্দগুলি কিছুতেই অন্যত্র প্রয়োগ করা যাবে না। আরবাগত ব’লে এগুলি তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি, বাঁধ দিয়ে এগুলিকে গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখতে চায়। কিন্তু শব্দ তো শব্দই, সে কি আর বাঁধ মানে? ঢেউ-ঢেউ মননে সে বেপরোয়া ভঙ্গিতে এগিয়ে চলে লঙ্ঘনের পথে। তবু এরা একটা দিক আগলে রাখতে চায়, এক মুসলিম শুধু আরেক মুসলিমের জন্যে এই শব্দগুলি বরাদ্দ রাখে। বলতে শোনা যায় যোগ্য আলিম, হক্কানি আলিম— এ থেকে বোঝা যায় আলিম অযোগ্য এবং বাতিলও হ’তে পারে, গায়ে লম্বা কোর্তা ও মুখে কয়েক টুকরো আধ্যাত্মিক কথা দেখে প্রাথমিকভাবে নির্বিশেষে সব ধর্মান্ধ মমিনকে আলিম ধরা হয়!
জ্ঞান বিমূর্ত জিনিস, আছে কি না ঝাঁকিয়ে দেখা যায় না, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কৃত আচরণ ও শাস্ত্রালোচনা থেকে অনুমেয়। ধারণাটি আপেক্ষিক ব’লে কাউকে জ্ঞানী ভেবে তার নামের আগে বিশেষণ জোড়া হীনতা। জগদ্বিখ্যাত দার্শনিকদের বেলায়ও এভাবে জ্ঞানী বলা হয় না, প্রকৃতই হয়ে থাকলে যার-যার মনে-মনে জানা থাকে। এদিকে, মুসলিমমাত্রই জানে ইলম চর্চার কেন্দ্র হল মক্তব-মসজিদ-মাদরাসা, পরে যোগ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, যা হোক এই ধাঁচের বাইরে নয়। পরম্পরায় ওরা এগুলির প্রতিনিধিত্ব করে। এসব প্রতিষ্ঠানের সিঁড়িতে-ধূলিতে পরতে-পরতে সংরক্ষিত থাকে ইলম আর ইলম, তাই প্রকৃতপক্ষে এগুলি হল গিয়ে ইলমের গুদাম। সময়-সময় ইলম গুদামজাত করা হয়, বণ্টন করা হয়, এই চক্রেই ঘুরপাক খায়। ওরা গুদামের একটা শ্রেণীর নাম দিয়েছে আলিম। সেই শ্রেণীর বাতাস যেসব তালিবের গায়ে লাগে তারা সবাই আলিম তাদের এই ইলমের রাজত্বে। ধর্মাক্রান্ত এই ব-দ্বীপে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়েছে অজস্র গুদাম, মুহুর্মুহু গজাচ্ছে, বছর-বছর চাষ হচ্ছে বেশুমার হাইব্রিড আলিম। সব মিলিয়ে তাদের এক আলাদা সমাজ, আলিম-সমাজ!
যে আরবি-উর্দুর অহমিকা নিয়ে তারা এত উচ্চকণ্ঠ, সেই আরবি-উর্দু সবাই বিস্তর জানে কি? ভাষার মারপ্যাঁচ না বুঝে অর্থ না জেনে বালিশের মতো পুরু একেকটা গ্রন্থ যন্ত্রের মতো শুধু মুখস্থ করে, মুখস্থ বাক্যসমবায়ের কী-বা মূল্য কী-বা মান! সৌদিতে গিয়ে সেরকম আরবি চালিয়ে পাণ্ডিত্য দেখাতে না পারলে এবং পাকিস্তানে গিয়ে সেখানকার পাকা বোয়ালদের সঙ্গে কথাবার্তায় ও লেখালিখিতে অনর্গল বিশুদ্ধ উর্দু চালাতে না পারলে তো এই জানাশোনা আন্তর্জাতিক মানের নয়। বিপুল লোকের এই প্রতুল আড়ম্বরের ফাঁকে হাতেগোনা কয়েকজন উজাতে পারলেও তা উল্লেখ্য কিছু নয়। গুদামের কামলারা যে কয় ছটাক জানে বাদবাকি মানুষ সেটুকুও জানে না ব’লে সিংহহীন বনে শেয়ালের রাজত্ব বিরাজ করে। তো এই ছটাকি বিদ্যার গরমিতে মহাজ্ঞানীরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে, আর তাদের বিপরীতে থাকা মানুষগুলি যারা কিনা তাদের ভাষায় মালাউন, উপযোগ না থাকায় আরবি-উর্দু চর্চা করে না ব’লে তাদেরকে নিতান্ত অজ্ঞ-অপদার্থ ভেবে উপহাস করে। যার যা জানা আবশ্যক সে তা জানবে, স্বাভাবিক। বাঙালির জন্যে আর যেকোনো ভাষার চেয়ে বাঙলা বেশি জানাটা একেবারে সহজাত। এই অঞ্চলের অধার্মিকদের জন্যে মরুর ভাষা জানা অনাবশ্যক, না জানলে তাই লজ্জার কিছু নেই, বরং জানলে সেটা বোনাস। এখানকার কেউ চৈনিক চেংচুং না জানা যেমন ব্যাপার না, অধার্মিকরা ইল্লাবিল্লা না জানাও তেমনি।
গুদামগুলি গ’ড়ে ওঠে ভিক্ষার পয়সায়। এই শিক্ষা, অবশ্য যদি প্রক্রিয়াটিকে শিক্ষা বলা যায়, পুরোপুরি ভিক্ষানির্ভর। চলতে-ফিরতে দেখা যায় পথেঘাটে “মুক্তহস্তে দান করুন” লেখা সাইনবোর্ড। রাস্তার পাশে নির্মাণাধীন কোনো গুদাম থেকে মাইকিং ক’রে যাত্রী ও পথচারীর কাছ থেকে সাহায্য তোলা হয়। অন্য ভিক্ষুকরা তবু খানিকটা লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে চায়, এরা জাতীয় ভিক্ষুক ব’লে চায় বড় গলায়। বড় অঙ্কের সাহায্য পেলে তালিকায় নামও তোলে, পরখালে নাকি উত্তম প্রতিদান মিলবে। গুদামের বেলেহাজ রক্ষকদের বেতন বের করার জন্যে প্রতি বছর দু-একটা জলসা করা হয়। এ উপলক্ষে বিত্তবানদের পিছু-পিছু হেঁটে চাঁদা তোলা হয়, সাধারণের দ্বারে-দ্বারে ঘুরে চাউল ও ঝাড়ে-ঝাড়ে ধন্না দিয়ে বাঁশ মাগা হয়। অগ্রহায়ণে ধান কাটার মৌসুমে খলায়-খলায় বস্তা নিয়ে ঘুরে জনে-জনে ধান মাগে। এমনি ক’রে ওদের মেরুদণ্ডই ভিক্ষার ওপর স্থিত।
সেসব আলিম, যাদের জাতীয় পরিচয়ের চেয়ে ধর্মীয় পরিচয় মুখ্য, ইংরেজি দূর কি বাত বাঙলাও জানে না ভালোমতো। ব্যতিক্রম স্বীকার্য, আপন চেষ্টায় বিবিধ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন ক’রে মূল স্রোতে অবগাহনের উপযোগী হ’তে দেখা যায় জনা কয়েককে, অবশ্য এই কয়েকজন গোবরে পদ্ম হয়ে ফোটার অপরাধে স্বগোত্রে বেশ বিতর্কিত হয়ে থাকে। আর সবাই থেকে যায় তিমিরে, বাঙলা একটা বানান পর্যন্ত জানে না। এই এরা যখন এক-আধটা বাইরের বই পড়ে, কেচ্ছার মতো জানতে পায় সাহিত্য ব’লে আছে এক বিশাল জগৎ, অনেকে ওমুখো হ’তে চায়, খিচুড়িভাষায় প্রার্থনাসর্বস্ব আবর্জনা রচনা ক’রে এর নাম দেয় ইসলামি সাহিত্য— সাহিত্যেও ধর্মভাগ, দূষণ, দুধের মধ্যে মুত মিশিয়ে মগজে লালিত দলাদলি উগরে দেওয়া! সাহিত্যে যেকোনো অনুষঙ্গ আসতে পারে, কিন্তু কোনো বিশেষ অনুষঙ্গ দিয়ে আলাদা সাহিত্য হ’তে পারে না— এটুকু বোঝার মতো উদার ঘিলুও নেই, তবু তেলাপোকা পাখির সঙ্গে আকাশে ওড়ার বাসনা রাখে! শেখ সাদীকে যেমন সেই আপ্যায়ক স্রেফ পোশাকের জন্যে সমাদর করেছিল, এই ফানুসগুলিকেও তেমনি স্বগোত্রীয় নির্বোধরা বায়বীয় সমীহ করে, কেউ আবার করুণ দশা দেখে করুণা করে। নির্প্রশ্নে মেনে নেওয়া আর আগল টেনে দেওয়া একই কথা; জ্ঞান বিস্তারিত হয় বিতর্কে। অথচ এরা প্রশ্ন শুনতে চায় না, বিতর্কের মুখোমুখি হ’তে যায় না, নিজেদের নিন্দার্হ ইতিহাস ঘাঁটতে দিতে চায় না। মৌলিক কুয়োকে ঘিরে আবর্তিত হয়। এবং শেষতক অসহিষ্ণু ধার্মিক হয়, মানুষ আর হয় না।
অনুপম হক
০৬. ১২. ১৬
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ ভোর ৬:৪৩