আমাদের ব্যার্থতা নিয়ে এখন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন চলছে। অনেকে এই ব্যার্থতাকে আন্দোলনে ব্যার্থতা নাম দিয়ে আলোচনা করছেন। অনেক ভারী ভারি পত্রিকা যাদের ১০/১২ পিস একত্র করলে প্রায় কেজি'র কাছাকাছি পৌঁছে যায় তারাই এসব-ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের পুরোধা। এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন আমি পড়তে চাই না। মাঠের রাজনীতি করি, ব্যার্থতা কোথায় তা বুঝতে কারো বুদ্ধি ধার করা প্রয়োজন মনে করি না। ব্যার্থতা মাঠের রাজনীতিকদের চেয়ে কেউ ভালো বোঝে এটা কেবল অনভিজ্ঞরাই চিন্তা করতে পারে। তবে মুশকিল হচ্ছে এসব ওজনদার পত্রিকার প্রভাব এত বেশি যে না পড়লেও তারা কি বলতে চায় সেটা ঠিকই কানে পৌঁছে যায়। তাই বাধ্য হয়েই লিখতে হল। আন্দোলন কি, এর স্বরূপ কেমন এই সম্পর্কিত জ্ঞান তাদের মধ্যে কেমন তা জানা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে তারা কম জানেন অথবা পরিকল্পিত মিথ্যাচার করেন এটা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব। আমাদের পাড়া-মহল্লার বুদ্ধিজীবীরা আজকাল তাদের সমপর্যায়ের চিন্তাবিদ এটাও আজকাল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যাই হোক আমি জ্ঞান-বুদ্ধির পাইকার না, চিন্তাশীলতার কারখানাও না। তাই যুক্তির গভীরে আমি প্রবেশ করবো না। আমি সরলীকৃত কিছু কথা বলব, বলতে পারেন স্টেটমেন্ট টাইপের। সাথে কিছু বর্ধিতকরন অবশ্যই প্রয়োগ করা হবে।
আমরা সাধারন বাংলাদেশীদের উপর আমার আস্থা আছে, অল্প ধরিয়ে দিতে পারলেই তারা আসলটা বুঝতে পারে। এছাড়া প্রচুর কিন্তুযুক্ত কথা অনেক সময় মুখেই গুছিয়ে বলা যায় না, কি-বোর্ডের সাহায্যে সঠিক ভাবে প্রকাশ করা তো আরো কঠিন। তাই সেইভাবেই লেখাটাকে দেখবেন। প্রথমেই এটা স্বীকার করতে হয় যে আমাদের অবশ্যই বযার্থতা আছে। তবে আমার দৃষ্টিতে এটা আন্দোলনের ব্যার্থতা না, এটা শুধুমাত্র সরকার পতনের ব্যার্থতা। সফল গণআন্দোলনও নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্যপূরনে ব্যার্থ হতে পারে। জনগনের মধ্যে আবেদন সৃষ্টিতে আমাদের আন্দোলন পুরোপুরি সফল। সাধারন মানুষের মধ্যে আমাদের দাবীগুলোর প্রতি ১০০ ভাগ সমর্থন আছে। আমাদের দাবীগুলোর সারবস্তু এতই শক্তিশালী যে কিছু নির্লজ্জ, মূর্খ আর পাগল ছাড়া প্রতিপক্ষও প্রকাশ্যে এগুলোর বিরোধীতা করার সাহস করে না। গনসমাবেশগুলোতে ছিলো সর্বকালের সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি। হরতাল অবরোধগুলোতে মানুষ স্বেচ্ছায় ঘর থেকে বের হয় নি। এর চেয়ে সফল আন্দোলন আর কিভাবে সম্ভব? অনেকে এই আন্দোলনের মাত্রাকে ৬৯এর সাথে তুলনা করেছেন। গনমানুষের অবস্থানকে যদি সরকার সম্মান না করে তাহলে তা কি আন্দোলনের ব্যার্থতা? আন্দোলন সম্পর্কে সেই কাগজ ওয়ালাদের ধারনা কি তা পরিষ্কার হয়ে গেল। জঙ্গীবাদী সংগঠন আওয়ামীলীগের যারা দালালী করে তাদের ধারনা অবশ্য এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সর্বোচ্চ ধাপ পর্যন্ত পৌঁছেছে বিএনপি। এর পর যা বাকি থাকে তা হল বিশৃংখলা। মানুষ যখন সিদ্ধান্ত নেবে বিশৃংখলাতেই তাদের মুক্তি তখন অবশ্যই তার চরম রূপটাও দেখাবে বিএনপি। অনেক মানুষই এখন এমনটা ভাবতে শুরু করেছেন। সাধারন মানুষ এখন আরো কঠোর অবস্থান বলতে কি বোঝাতে চাচ্ছেন তার মানে আমরা বুঝি। কিন্তু শুধু অনেক মানুষের অবস্থানই যথেষ্ঠ নয়। যখন অধিকাংশ মানুষ সুচিন্তিতভাবে এই সিদ্ধান্তে আসবে তখন তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। এই ব্যাপারে যারা সন্দিহান তারা প্রকৃতপক্ষে দোদ্যুল্যমান চরিত্র। সরকার যদি গনদাবীর বাস্তবতাকে অস্বীকার করে তবে তাকে যে কোন উপায়ে গদিচ্যুত করা স্থান ও কালের মাত্রা ছাড়িয়ে একটি বৈধ ব্যাপার। দেশে দেশে যুগে যুগে তা ঘটেছে।
তবে আপনারা জানেন এই সরকার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য তার মেয়াদকালের শুরু থেকেই উদ্যোগ গ্রহন করেছে, তা শুরু হয়েছিলো ৫৭ জন সেনা অফিসার হত্যার মধ্য দিয়ে। তার পর গত ৫ বছরে কত প্রকাশ্য চেষ্টা চালিয়ে গেছে তা নিশ্চই আপনাদের স্মরন করিয়ে দিতে হবে না। রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা এবং সমাজ থেকে শুরু করে জাতীয় সার্বভোমত্ব পর্যন্ত সবকিছুতেই সরকারের কালো হাত পরে আজ ধংস হয়েছে। মানুষের ভরসার প্রতিটি ক্ষেত্র নষ্ট করে দিয়েছে সরকার। এমন অবস্থায় বিরোধীদলের কি করনীয় ছিল তা এখন একটি মিমাংসার অযোগ্য প্রশ্ন। সরকারের বদ উদ্দেশ্যের কথা বিএনপি কি উপলব্ধি করতে পারে নি? পারলে কি পদক্ষেপ নিয়েছে? না পারলে তা কি একটি ব্যার্থতা নয়? এমন সব প্রশ্ন মাথায় নিয়ে যখন চিন্তা করতে বসি তখন ঘুরে ফিরে পালটা কিছু প্রশ্ন আসে মাথায়। র্যাব-পুলিশ-বিজিবি কে সরকার শক্তভাবে কব্জা করেছে তা সত্য, এর বিপরীতে বিএনপির একটা পরিকল্পনা থাকবে তাও বাস্তব। কিন্তু বাহিনীর অবস্থা যাই হোক মানুষগুলোও যে যুক্তিহীন, অপরিনামদর্শী ও বিবেকহীন হয়ে যাবে তা কি কোন দেশে কাম্য? এই ধরনের আশঙ্কার কথাও কি বিরোধী দলকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা করতে হবে? যদি তাই হয় তাহলে তো দেশ টিকে থাকার কোন আশাই নেই। এই অবস্থায় ও সাধারন মানুষ কি ঘরে বসে থাকে? আশা করি অগ্রীম এমন ভয়াবহ অবস্থার কথা ভাবতে না পারলে কোন দলকে দোষ দেওয়া যায় না। এমন অবস্থার সৃষ্টি হলে দায়টা যার তার পাপের পুরুত্ব বোঝতে গিয়েই প্রতিদিন পত্রিকার পাতা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু এমন সময় বিরোধীদলের ব্যার্থতার কথা লিখে কাগজ ভরা হচ্ছে কেন? সাধারন মানুষ কি শক্তভাবে সেই প্রশ্নটা তুলেছে? অবশ্য সাধারন মানুষকে কিছু ধরিয়ে দিলে তারা সেটা দ্রুতই বোঝে। অনেক খুচরা ব্যাপারী অবশ্য এই প্রশ্নটা অন্যভাবে তুলেন। তারা বোঝাতে চান বিএনপির সাথে মানুষের সম্পৃক্ততা নেই তার প্রমান সাধারন মানুষ মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসছে না। আগের স্বৈরাচারেরা তো রাস্তায় নামলে গুলি করে মারত। এই ডিজিটাল স্বৈরাচার তো গ্রামে গ্রামে মানুষের ঘরে ঢুকে গুলি করে মারছে। মানুষের সামনে কোন পথ কি খোলা রাখা হয়েছে? তাছাড়া অন্য সময়ের সাথে বর্তমানের পার্থক্য আছে অন্য যায়গাতেও।
স্বাধীনতার পর থেকে সাধারন মানুষের অব্যাহত চেষ্টায় দেশ আজ উন্নয়েন এমন একটা ক্রিটিকাল স্টেজে আছে যে অবস্থান থেকে জনগনের কাছ থেকে এমন ভূমিকা আশা করা যায় না। মানুষ অভাব-অনটনের সাথে যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ মানুষ স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছে। ঠিক এই মুহূর্তে মানুষ প্রাচুর্যের সম্ভাবনা অথবা স্বপ্নের সামনে। এই মুহূর্তে একটা পরিবারের পতন মানে দীর্ঘ ভবিষ্যতের জন্য পিছিয়ে পড়া। স্থায়ীভাবে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি সামাজিক স্তর নির্ধারনের যুদ্ধে আছে সাধারন মানুষ। এই সময়ে কে মরতে চায়? এছাড়া মানুষের মনে এমন ধারনা তৈরি করা হয়েছে যে রাজনৈতিক সম্পর্কযুক্ত কোন কাজে অংশগ্রহণ করাটা একটা লজ্জার ব্যাপার। এই কাজে সুপরিকল্পিতভাবে অগ্রনী ভুমিকা রেখেছে প্রথম আলো। এখন বলুন আপনার বিবেক কি বলে বিরোধীদল ব্যার্থ হয়েছে? মানুষ যেদিন নিশ্চিত হয়ে যাবে যে তাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে সেদিন তারা গুলি বুকে পেতে নিতে কার্পন্য করবে না। একটি শক্ত সহায়ক গনমাধ্যম থাকলে অবশ্য মানুষ এতদিনে নিশ্চিত হয়ে যেত। মড়ার উপর খাড়ার ঘা এর মত একটি ফ্যাক্টরের কথা এখনও বলা হয় নি। ভারত ফ্যাক্টর। ভারত আওয়ামীলীগের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবে তা সকলেরই জানা। কিন্তু এই সর্বাত্মক কথাটারও একটা লিমিট আছে বিশ্ব রাজনীতীতে। ভারত সেই লিমিট অতিক্রম করবে সেটা অগ্রীম ধারনা করতে না পারাটা কি একটা ব্যার্থতা। অর্থ, শক্তি, কূটনীতি, গোয়েন্দা তৎপরতা থেকে শুরু করে অস্ত্র, সেল্টার এমনকি সামরিক বাহিনী দ্বারা পর্যন্ত তারা সাহায্য করেছে আওয়ামীলীগকে। এভাবে বহিঃশক্তির সার্বভৌমত্ব বিরোধী অসমর্থনযোগ্য তৎপরতায় যদি শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হয় তাহলে বিরোধীদলের ব্যার্থতার মুখরোচক কাহিনি প্রচার করাটার উদ্দ্যেশ্যটা কি? মানুষ জানে এবং আবারো প্রমানিত হল যে আওয়ামীলীগ এবং তার দোসর সুশীল-বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবী-শিল্পী-সাহিত্যিক-গনমাধ্যম সব স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব বিরোধী। আর একটা বিষয়, আমরা আন্দোলনে সফল হলেও সরকার পতনে ব্যর্থ হয়েছি তার একটা মুখ্য কারন হল সরকারপন্থী ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়াগুলো। বিরোধী মতবাদের গনমাধ্যমগুলো বন্ধ করে দেয়ায় মানুষের সামনে এগুলো ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিলো না। এমন পরিস্থিতিতে এদের মিথ্যাচার আর অপপ্রচার আন্দোলনকে ডিমোরালাইজড করেছে। বিশেষ করে প্রথম আলোর কৌশলী অপপ্রচারগুলো আন্দোলনকে ব্যার্থ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। সরকারের পতন হতে যাচ্ছে এই ধারনাটা মানুষের মধ্যে ঢুকার কোন সুযোগই খোলা রাখেনি এই পত্রিকাটি। এটা নিয়ে যতটুকু আলোচনা হওয়ার দরকার ছিলো বিরোধী শিবিরে তার কোন কার্যকর মাত্রা লক্ষ্য করা যায় নি। এখনও সময় আছে এটা নিয়ে কাজ করার। নাহলে আন্দোলন কোনদিনও ফল বয়ে আনবে না।
সর্বশেষ আরেকটা বিষয় নিয়ে কথা বললতে চাই। জামাত-শিবির নিয়ে। আমরা জানি জামায়াতের মত দল কোন এক সময় এককভাবে ক্ষমতায় যেতে চায়। সেই হিসাবে তারা আমাদের সাময়িক মিত্র হলেও শেষ বিচারে মিত্র হতে পারে না। আমরা নিজেদের ধ্বস করে তাদের জন্য রাস্তা করে দিতে পারি না। বিএনপির সাথে তাদের যুগপথ আন্দোলনে মূল যে সমস্যাটা ছিলো তা হল তারা এই বিশেষ পরিস্থিতিতেও তাদের সেই এজেন্ডার কথা ভুলে নাই। এক ঢিলে তারা দুই পাখি মারতে চেয়েছে। এই ব্যাপারগুলো মাঠে কাজ করতে যেয়ে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করেছি। আমাকে যদি বলা হয় এই বিষটা প্রমান করার জন্য তাহলে অন্তত ৩০ পৃষ্ঠার বর্ণনা লিখতে পারবো। এই অতি লোভ আন্দোলনের পথে একটা বড় বাধা ছিল। তারা নিজেদের ক্ষমতার তুলনায় সবসময় অতি কনফিডেন্সে ভোগে। তাই তারা সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আন্দোলন করতে পারে নাই। তারা সাময়িক সাফল্য হিসাবে সরকারের পতন ও দীর্ঘস্থায়ী সাফল্য হিসাবে বিএনপির পিঠে ছুরি মেরে নিজেদের সমর্থন বাড়ানোর চেষ্টা সবসময় করেছে। এছাড়া তাদের কারনে বিএনপির কর্মী সমর্থকেরা মাঠে নামতে পারে নাই। এই কথাটা শুনে হয়ত অবাক হচ্ছেন। নিজের ইউনিট দিয়ে একটা উদাহরন দেই। আমাদের ইউনিট স্বতন্ত্রভাবে ছাত্রধর্মঘটের পরিকল্পনা করেছিলো। আমাদের মধ্যে তাদের চরেরা এই খবরটা তাদের কাছে পৌছে দেয়। এই প্রেক্ষিতে তারা পরিকল্পনা করে আমাদের ধর্মঘট চলাকালীন সময়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যারেজে আগুন দিবে এবং ১০/১২ জন ছাত্রলীগ কর্মীকে কোপাবে। আমাদের আন্দোলনের নিয়ন্ত্রন যদি আমাদের হাতে না থাকে তাহলে কিভাবে আমরা আন্দোলন পরিচালনা করবো? যাই হোক এটা বিশেষভাবে জানার পর আমরা পরিকল্পনা বাতিল করি। খোঁজ নিয়ে দেখেন প্রত্যেকটা ইউনিটের পিছনে এমন প্রতিবন্ধকতা কাজ করেছে। তারা চেয়েছিলো আন্দোলন চলবে তাদের প্ল্যানের ধারাবাহিকতায় কিন্তু আমাদের ঘাড়ে চড়ে। আমাদের প্ল্যানকে তারা মূল্যায়ন করেনি।
হাবিবুর রহমান ফাহিম
সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক
শাবিপ্রবি শাখা ছাত্রদল
সিলেট।