গত পর্বে আমরা দেখলাম, জামায়াতের ভোটব্যাংকের এবং সেই ভোট উঠানামার হিসাব। এই পর্বে আমরা দেখব, বিএনপির ভোটে জামায়াতের অবদান কতটুকু?
২০০১ এর নির্বাচনের পূর্বে গঠিত হয় ৪ দলীয় ঐক্যজোট। দলগুলো হল বিএনপি, জামায়াত, বিজেপি ও ইসলামি ঐক্যজোট। এই জোট মোট ২১৪ টি আসনে জয়লাভ করে যেখানে-
বিএনপি- ১৯৩ জামায়াত- ১৭ বিজেপি- ২ এবং ইসলামি ঐক্যজোট- ২ টি আসন লাভ করে।
অন্যান্য বড় দলগুলোর মধ্যে আওয়ামীলিগ ৬২ টি ও জাতীয় পার্টি ১৮ টি আসন পায়।
কেউ কেউ ভাবতে পারেন, বিএনপির এই বিপুল বিজয়ে জামায়াতের ভাল ভুমিকা আছে। কিন্তু পরিসংখ্যান বলে ভিন্ন কথা। জামায়াতের ইতিহাসে সবচেয়ে ভাল নির্বাচনী ফলাফল ছিল ১৯৯১ এর নির্বাচনে। তাঁর পরবর্তী প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে তাদের ভোট ধারাবাহিকভাবে কমেছে। উল্টোদিকে বিএনপির ভোট প্রতি নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে, শুধুমাত্র ২০০৮ এর ব্যতিক্রম ছাড়া।
১৯৯৬ এর নির্বাচনেই কেবল জামায়াত ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়। জয়লাভ করে মাত্র ৩ টি আসনে, পিরোজপুর- ১, নীলফামারী- ৩, সাতক্ষীরা- ২। ২০৭ টি আসনে জামায়াত মোট প্রদত্ত ভোটের ১০ শতাংশেরও কম পায়। বাকি ৯০ টি আসনে ১০% এর উপরে ভোট পায়। ২য় অথবা ৩য় স্থান লাভ করে ৬২ টি আসনে। সমগ্র বাংলাদেশে মোট প্রদত্ত ভোটের ৮.৬১% পায় জামায়াত, যা ২২২ আসন নিয়ে অংশ নেয়া ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ছিল ১২.১৩%।
মজার বিষয় হচ্ছে, ১৯৯৬ এ জামায়াত যে ৯০ টি আসনে ১০% এর অধিক ভোট পেয়েছে, তাঁর ৬০ টিতে বিএনপি এবং ৩০ টিতে আওয়ামীলীগ বিজয়ী হয়েছিল। অর্থাৎ জামায়াতের ভোট মূলত বিএনপির প্রাধান্য থাকা এলাকাগুলোতেই বেশি, যেখানে বিএনপি জয়ী হতে পারে জামায়াতের সহযোগিতা ছাড়াই।
২য় অথবা ৩য় অবস্থানে থেকে জামায়াত ১০% ভোট পেয়েছে এমন আসন ছিল ৬২ টি। ২০০১ সালে ঐ ৬২ আসনের ৪৯ টিতে জয়লাভ করে ৪ দলীয় জোট। মনে হতে পারে, এই জয়ে জামায়াতের ভোটের ব্যাপক ভূমিকা আছে। কিন্তু বাস্তবতা হল ঐ ৬২ আসনের ৩০ টিতে আওয়ামীলীগ ৯১,৯৬,০১ এর কোন নির্বাচনেই জিততে পারেনি। ২২ টি আসনে ৩ নির্বাচনেই বিএনপি অথবা জামায়াতের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। ২২ টির বাইরে ১৫ টি আসনে ৯৬ এর নির্বাচনেই বিএনপি বা জামায়াতের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন।
অর্থাৎ জামায়াতের সাথে জোট করে বিএনপির লাভ হয়েছে মাত্র ১২ টি আসন(৪৯-২২-১৫=১২)। ১৯৩ আসনের মধ্যে ১২ টি খুব বেশি নয়। এই আসনগুলোতেও জামায়াতের ভোটের কারণে নাকি বিএনপির জোয়ারের কারণে জয় এসেছে তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে।
২০০৮ এর ভরাডুবির নির্বাচনে ঐ ৬২ টি আসনের মাত্র ১৫ টি রক্ষা করতে সক্ষম হয় ৪ দলীয় জোট। এ নির্বাচন প্রমান করেছে যে “জামায়াত অন্যান্য দলের মত না, তাদের নিজস্ব সলিড ভোটব্যাংক আছে”- এ ধারণাটি কত বড় ভুল। ঢাকা, বরিশাল ও সিলেট বিভাগে তাদের ভোট পাওয়ার হার খুবই নগণ্য। তবে জেলাওয়ারি জামায়াতের কিছু ভোট আছে। এর বাইরেও কিছু জেলাতে তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামি ছাত্রশিবিরের শক্ত অবস্থান আছে, যেমনঃ রংপুর, কুমিল্লা, সিলেট, কুষ্টিয়া। জামায়াতের শক্ত ঘাঁটিগুলোর মধ্যে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পিরোজপুর, নীলফামারী, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, গাইবান্ধা, বগুড়া, খুলনা। এর বাইরে সেই অর্থে জামায়াতের ভোটব্যাংক নেই।
গত বছর অনুষ্ঠিত ৫ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা ৫৭% করে ভোট পেয়েছেন, যার ভেতরে গাজীপুর ও বরিশাল সিটিতে জামায়াতের ভোট খুবই কম। জামায়াতের ভোট ১৫% করে ধরলেও বিএনপির ৪২% ভোট থাকে যা ২০০১ এ প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে বেশি।
অনেকে হয়ত বলবেন, সাম্প্রতিক উপজেলা নির্বাচনে জামায়াতের আশাতীত ভাল ফলাফলের কথা( বিশেষ করে ভাইস চেয়ারম্যান পদে)।
আমার নিজের জেলা চাঁদপুরের (যেখানে জামায়াতের বেইল নাই!) সদর উপজেলা নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামায়াতের প্রার্থী বিজয়ী হওয়ার কারণ খুজতে গিয়ে জানলাম বিএনপির প্রার্থী ছিল সর্বজনস্বীকৃত অসৎ এবং দুর্নীতিবাজ। একারনেই মানুষ তাকে ভোট দেয় নাই। এখন যেখানে থাকি, অর্থাৎ সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থীর ৪ কোটি টাকা খরচ করে বিজয়ী হওয়ার কথা শুনলাম, যা রীতিমত অবিশ্বাস্য। এছাড়াও ব্যাপকভাবে ধর্মের ব্যাবহারের বিষয়টি তো রয়েছেই।
সবশেষে কোটি জাতীয়তাবাদীর আশা, জামায়াতকে ব্যাবহার করে ছুড়ে ফেলা হবে। সৌদি আরবে তারেক জিয়ার সাথে মাসুদ সাইদির ছবি হয়তো সেই আশায় জল ঢেলে দেয়। কিন্তু আশা ছাড়ি না, কারণ “মানুষ বাঁচে আশায় আর দেশ বাঁচে ভালবাসায়”।
বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ জিন্দাবাদ।।
জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।।