somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রণেতা দীনেশচন্দ্র সেন এর ৮০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

২০ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শিক্ষাবিদ, গবেষক, লোক-সাহিত্যবিশারদ ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার দীনেশচন্দ্র সেন। তিনি ছিলেন বাঙালি সংস্কৃতির এক প্রকৃত সাধক। অখণ্ড বাংলার ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং জীবন নিয়েই ছিল তাঁর আমৃত্যু গবেষণার আরাধনা। এই অখণ্ডতাকে সামগ্রিক করে তোলার জন্য তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল এ অঞ্চলের ব্রাত্য জনগোষ্ঠীর ওপর। কারণ তারাই বাংলার আত্মাকে প্রকৃত অর্থে ধারণ করেছে। এই অনার্য ব্রাত্যদের অধিকাংশেরই বসবাস ছিল পূর্ববঙ্গে। ফলে পূর্ববঙ্গকে মন্থন করেই তিনি উদ্ধার করেছেন সেই অমৃত, যার মধ্যে সংগুপ্ত রয়েছে ইতিহাসের প্রকৃত সত্য। বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার বীজ। ফলে বাঙালিত্ব আর হিন্দুত্বকে তিনি কখনো এক করে দেখেননি।শাস্ত্রীয় সংকীর্ণতার পরিবর্তে ব্রাত্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে উদার মনোভঙ্গি সক্রিয়, তা তাকে জাতপাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত মানবিক ও সেক্যুলার হতে সহায়তা করেছে। ফলে এ অঞ্চলের অনার্য মানুষ বারবার ধর্মান্তরিত হলেও তার মধ্যে বজায় থেকেছে উদার মানবিক অসাম্প্রদায়িক চেতনা। পূর্ব্ববঙ্গ-গীতিকা সংকলন ও সম্পাদনার ক্ষেত্রে যে কৃতিত্বের পরিচয় তিনি দেন, তা এককথায় অসাধারণ। কিন্তু এর পেছনে তাঁর যে মনোভঙ্গি সক্রিয়, সেটি প্রায়ই অনালোচিত থেকে যায়। স্মরণীয় যে, ঔপনিবেশিক শাসন উপনিবেশিত মানুষের মধ্যে যে হীনম্মন্যতার জন্ম দিয়েছে, তা থেকে উত্তরণের জন্যই স্বাজাত্যবোধে উদ্বুদ্ধ এ দেশের শিক্ষিত মানস নিজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্বরূপ অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়। এই স্পৃহাই দীনেশচন্দ্র সেনকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় গ্রামাঞ্চল মন্থন করে প্রাচীন পুঁথি আবিষ্কারের কঠিন শ্রমে ব্রতী হওয়ার প্রেরণা জোগায়। ওই গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে তিনি এই সত্যে উপনীত হন যে, অখণ্ড বাংলার ভৌগোলিক পরিসরের মধ্যেও পূর্ববঙ্গের রয়েছে ভিন্নতর বৈশিষ্ট্য। বাংলার পূর্ব অঞ্চলে অধিক হারে নিম্নবর্গীয় অনার্য জনগোষ্ঠীর বসবাসসূত্রে এখানেই প্রকৃত প্রাণস্পন্দিত সাহিত্যের চর্চা অনেক বেশি বেগবান ছিল। এ অঞ্চলের মানুষের জীবন যেমন প্রতিনিয়ত সংগ্রামমুখর, তেমনি সহজ-সরল, জটিলতামুক্ত, উদার চেতনায় স্বচ্ছ ও ঋদ্ধ। ধর্মতান্ত্রিক সংকীর্ণতা তাদের জীবনকে কলুষিত কিংবা মানবিক আবেগশূন্য করেনি। ফলে মধ্যযুগীয় পটভূমিতেও এই অঞ্চলেই সৃষ্টি হতে পেরেছে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে ধর্মাচ্ছন্নতামুক্ত মানবিক প্রেমের আখ্যানমূলক গীতিকাসমূহ। সাহিত্য ও গবেষণায় অবদানের জন্য দীনেশচন্দ্র সেন ১৯২১ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ‘রায়বাহাদুর’ উপাধি পান। একই সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করে এবং ১৯৩১ সালে তিনি জগত্তারিণী স্বর্ণপদক লাভ করেন। আজ এই সাধকের ৮০তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৩৯ সালের আজকের দিনে তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।


দীনেশচন্দ্র সেন ১৮৬৬ সালের ৩ নভেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ঢাকা জেলার সুয়াপুর গ্রামে। পিতা ঈশ্বরচন্দ্র সেন মানিকগঞ্জ আদালতের উকিল ছিলেন। তার মায়ের নাম রূপলতা দেবী। দীনেশচন্দ্র সেন জগন্নাথ স্কুল থেকে এনট্রান্স (১৮৮২), ঢাকা কলেজ থেকে এফ.এ (১৮৮৫) পাস করেন। এ সময় পিতা-মাতার মৃত্যুর কারণে তিনি বহিরাগত ছাত্র হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে ১৮৮৯ সালে বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় সিলেটের হবিগঞ্জ স্কুলে (১৮৮৭)। পরে তিনি কুমিল্লার শম্ভুনাথ ইনস্টিটিউশন (১৮৮৯) ও ভিক্টোরিয়া স্কুল (১৮৯০)-এর প্রধান শিক্ষকের পদে যোগদান করেন। কিশোর বয়স থেকে দীনেশচন্দ্র সেন সাহিত্য-অনুরাগী ছিলেন। কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ কুমার ভূপেন্দ্রসিংহ (১৮৯০)। এটি একটি আখ্যান কাব্য। দেশের সংস্কৃতির প্রতি ছিল তাঁর গভীর মমতা। এ মমতা তাঁকে দেশপ্রেম, কবিবন্দনা এবং অতীতের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। কুমিল্লায় অবস্থানকালে তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রাচীন বাংলার পুথি সংগ্রহ করেন। ব্যাপক শ্রমসাধ্য এ কাজে তিনি গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন এবং দীর্ঘ সময়ের গবেষণায় কুমিল্লা থেকে ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বঙ্গভাষা ও সাহিত্য শীর্ষক একটি আকরগ্রন্থ। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ওপর এটি একটি সুশৃঙ্খল ও ধারাবাহিক তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণাগ্রন্থ যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ সমকালের পন্ডিতদের প্রশংসা লাভ করে। এ অসাধারণ গ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় দীনেশচন্দ্র সেন এ বিষয়ে পথিকৃৎ-এর সম্মান ও পান্ডিত্যের স্বীকৃতি লাভ করেন। সৃজনশীল লেখক হিসেবেও দীনেশচন্দ্র সেন পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বাংলা সাহিত্য বিষয়ে গবেষণামূলক ও ইতিহাসধর্মী গ্রন্থ প্রণয়ন, পৌরাণিক আখ্যান রচনা, লোকসাহিত্য সম্পাদনা ও বাঙালির ইতিহাস প্রণয়নের পাশাপাশি তিনি রচনা করেন কবিতা, উপন্যাস ও গল্প। সব মিলে তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা ৬০। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থঃ বঙ্গ-সাহিত্য পরিচয় (দুই খন্ড, সম্পাদনা: ১৯১৪), The Vaisnava Literature of Medieval Bengal (১৯১৭), Chaitanya and his Companions (১৯১৭) The Folk Literature of Bengal (১৯২০), The Bengali Ramayana (১৯২০), Bengali Prose Style : ১৮০০-১৮৫৭ (১৯২১), সরল বাঙ্গালা সাহিত্য (১৯২২), ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য (১৯২২), Glimpses of Bengal Life (১৯২৫), বৃহৎ বঙ্গ (দুই খন্ড, ১৯৩৫), আশুতোষ-স্মৃতিকথা (১৯৩৬), বাংলার পুরনারী (১৯৩৯), প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান (১৯৪০)।


বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের লেখকরা হিন্দু-মুসলমান ব্যবহার করতেন। কিন্তু ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আসেন। তারা পরিকল্পিতভাবে বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু দীনেশচন্দ্র সেন ব্যতিক্রম । তিনি রেনেসাঁর পথ অবলম্বন করেছেন। তাই তিনি সাম্প্রদিকতা পথে না হেঁটে বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য খুঁজে বের করছেন।বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ও ভালোবাসার ফল বৃহৎ বঙ্গ। এটি বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস। ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য গ্রন্থটি দীনেশচন্দ্র সেনের আত্মজীবনী। বাংলা জীবনী সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর এ গ্রন্থের মূল্য স্বীকার্য। তিনি এ গ্রন্থে নিজের বেড়ে ওঠা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতসহ তাঁর সাহিত্যিক জীবনের কথা অত্যন্ত সরল ও মনোহর ভাষায় বিবৃত করেন।চিন্তা ও চেতনায় অনগ্রসর মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক অবদানকে দীনেশচন্দ্র সেন অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করেন তাঁর প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান শীর্ষক গ্রন্থটিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের অবদান অনেক ক্ষেত্রে অগ্রবর্তীর, ভুলে যাওয়া উচিত নয় এ সত্য-এ হচ্ছে তাঁর উল্লিখিত গ্রন্থটির প্রধান বক্তব্য। দীনেশচন্দ্র সেনের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। তিনি শুধু নিজে বাংলা সাহিত্যের শেকড়ের সন্ধানই করেননি অন্যদের দিয়েও সন্ধান চালিয়েয়েন। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান অপরিসীম। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করেছিলেন। ১৯৩৯ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার বেহালায় তাঁর মৃত্যু হয়। আজ এই সাধকের ৮০তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৩৯ সালের আজকের দিনে তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

নূর মোহাম্ম নুরু
গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:৩১
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অণু থ্রিলারঃ পরিচয়

লিখেছেন আমি তুমি আমরা, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত

১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো - ছবি ব্লগ

লিখেছেন শোভন শামস, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৯

"পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো", কিংবা "পোস্টকার্ড রো" বা "সেভেন সিস্টারস" নামে পরিচিত, বাড়িগুলো। এটা সান ফ্রান্সিসকোর আলামো স্কোয়ার, স্টেইনার স্ট্রিটে অবস্থিত রঙিন ভিক্টোরিয়ান বাড়ির একটি সারি। বহু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×