জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস ঠিকই বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নোভেল করোনাভাইরাসই পৃথিবীর কাছে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এতো বড় যুদ্ধ, এতো কঠিন যুদ্ধ বোধহয় আগে কখনো মানুষকে লড়তে হয়নি। যে যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে চোখে দেখা যায় না। মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে টালমাটাল বিশ্ব। ধ্বসে পড়েছে অর্থনীতি। লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার। ক্ষুধায় কাঁদছে শিশু। করোনা ভাইরাসের চতুর্মুখী আঘাতে লণ্ডভণ্ড গোটা বিশ্ব। গেল ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনার অস্তিত্ব পাওয়ার পর গত কয়েক মাসে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত ও মৃত্যুর তালিকায় সবার উপরে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশাল এই দেশটিতে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৯ লাখ ৮৭ হাজার ৩২২ জন। এরমধ্যে মারা গেছে ৫৫ হাজার ৪১৫ জন। প্রতিদিনই দেশটিতে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। মৃত্যুর মিছিলও হচ্ছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সনাক্ত করা হয়। ১৮ মার্চ দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এর কয়েকদিন পর থেকেই করোনার বিস্তার ঠেকাতে সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। একে একে বন্ধ হয়ে যায়, স্কুল-কলেজ ও অফিস-আদালত সবকিছু। গোটা দেশে অঘোষিত লকডাউন আরম্ভ হয়। গোটা দেশ হয়ে যায় গৃহবন্দি। এরইমধ্যে দেখতে দেখতে বাড়ছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। আজ মঙ্গলবার ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪৬২ জনে। এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১৫৫ জন। আর সুস্থ হয়েছেন ১৩৯ জন। এই পরিস্থিতিতে সবার মুখে প্রশ্ন একটাই- কবে করোনামুক্ত হবে বাংলাদেশ? অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা মহামারী দীর্ঘমস্থায়ী হয়না। একটা নিদৃষ্ট সময় পরে তা বিদায় নেয়। মানুষ পাপ করতে করতে যখন পাপের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখনই আল্লাহর শাস্তি নাজিল হয়। যার প্রমাণ বিগত আটশত বছরের ইতিহাস। যেমনঃ
১। ১৩২০ সালের দ্য ব্ল্যাক ডেথ অব বুবোনিক প্লেগ।
২। ১৪২০ সালের দ্য এওইডেমিক অব ব্ল্যাক ডেথ প্লেগ (দ্বিতীয় প্লেগ প্রলয়)
৩। ১৫২০ সালের গুটি বসন্ত ও প্লেগ মহামারি।'
৪। ১৬২০ সালের মহামারির প্রলয়ে মূর্চ্ছা যায় রক্তিম ‘মে ফ্লাওয়ার।
৫। ১৭২০ সালের দ্য গ্রেট প্লেগ অব মার্শেই।
৬। ১৮২০ সালের ভারতবর্ষে কলেরা, যুক্তরাষ্ট্রে ইয়েলো ফিভার মহামারি।
৭। ১৯২০ সালের দ্য স্প্যানিশ ফ্লু।
৮। ২০২০ সালের কোবিড-১৯ করোনা ভাইরাস।
প্রকৃতির প্রতিশোধ বড়ই নির্মম। পাপের ভরা পূর্ণ হলেই শুরু হয় প্রকৃতির নির্মম প্রতিদান। প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানই কোনো-না-কোনো শৃঙ্খলের অন্তর্ভুক্ত। এরা একে অন্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এই উপাদানগুলোর কোনো একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে, নষ্ট হয় পরিবেশগত ভারসাম্য। এ ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার গুরুদায়িত্ব প্রকৃতিই নিজ কাঁধে তুলে নেয়। প্রতিটি কাজেই রয়েছে ‘প্রকৃতির প্রতিদান’ ভাল করলে ভাল পাবেন, মন্দ করলে মন্দ পাবেন। পরিবেশবিজ্ঞানের ভাষায়, করোনাভাইরাস প্রকৃতির প্রতিশোধ। প্রকৃতিকে নির্জীব, চলৎশক্তিহীন ও সর্বংসহা মনে হলেও আসলে তা নয়; বরং তা নির্মম প্রতিশোধ গ্রহণকারী। প্রকৃতি কারো অণু পরিমাণ অপরাধও সহ্য করে না। প্রতিশোধ হিসেবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, সুনামি, মহামারী ইত্যাদি প্রকৃতিরই প্রতিশোধের হাতিয়ার। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছে। জয়ীও হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে জয়ী হয়েছে বলা যায় না। প্রকৃতি প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু। এ মোকাবেলায় মানুষ বড়ই অসহায়। স্মরনতব্য সাত দশক আগে ১৯৪৯ সালে চীনের ঘটনা। কৃষিপ্রধান চীন। চড়ুইপাখি কৃষকের ধান খেয়ে দেশের ক্ষতি করে। নতুন চীনের জনক মাও সে তুং একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন, সময় হয়েছে চড়ুইপাখি বিলুপ্ত করার। সে আদেশ যথাযথভাবে পালন করা হয়েছিল। এমন নির্বোধ কর্মকাণ্ডের খেসারত দিতেও বেশি সময় লাগেনি। পরের বছরই ধেয়ে এসেছে প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ। কারণ, শস্যদানার পাশাপাশি চড়ুইপাখি নানা ধরনের পোকামাকড়ও খায়। এ পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় জ্যামিতিক হারে বেড়ে গেল পোকামাকড়ের সংখ্যা। এতে করে ফসলের ক্ষেত ছেয়ে যেতে থাকে ক্ষতিকর পোকামাকড়ে। ফলে, যে শস্য বাঁচানোর জন্য এত কিছু করা হলো, তা গেল পোকামাকড়ের পেটে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শস্যভাণ্ডার খালি হয়ে গেল। সাধারণ মানুষের মজুদ করা খাদ্যেও ঘাটতি দেখা দেয়। খাদ্যসঙ্কটের মুখে পড়ে যায় কোটি কোটি মানুষ। দেখা দিলো দুর্ভিক্ষ। ফলে পরবর্তী তিন বছরেই প্রাণহানির সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৪৫ মিলিয়নে। এ দুর্ভিক্ষ ‘দ্য গ্রেট ফেমিন’ নামে পরিচিত। এবারের করোনাভাইরাস্ও মানব জাতির ‘অহমিকা'র বিরুদ্ধে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ প্রকৃতির নিয়ম খুবই সুশৃঙ্খল। এর চিরন্তন নিয়মের কখনো ব্যত্যয় ঘটে না। সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে আর পশ্চিম দিকে অস্ত যায়- এই নিয়মে কোনো হেরফের নেই। তাই সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে থাকা যাবেনা, তার আদেশ নির্দেশ মানতে হবে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মুক্তি পেতে ঘরে বসে মহান আল্লাহর দরবারে বেশি বেশি দোয়া ও মোনাজাত করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও দেশের সংখ্যালঘু জনগণকে আল্লাহর কাছে করোনা মুক্ত ভারতের প্রার্থনা করার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি বলেন, রমজান মাসে আরও বেশি করে প্রার্থনা করুন। যাতে ঈদের আগেই করোনা মুক্ত হয় ভারত। ইতালীর প্রধানমন্ত্রী কন্টিও নিরুপায় হয়ে সৃষ্টিকতার দয়া ভিক্ষা করেছেন। যুক্তরাজ্যের এক অমুসলিম সংসদ সদস্য পল ব্রিস্টো মুসলিমদের মতো সব নিয়ম মেনে রোজা রাখছেন- এমন খবরই প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ। এবার যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশের মানুষদের করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করতে মহাসড়কের বিলবোর্ডগুলোতে ইসলাম ধর্মের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর বাণী প্রচার করছে। বিলবোর্ড স্থাপনকারী সংগঠন ইলিয়নস অঙ্গরাজ্যের গেইনপিস। গেইনপিসের পরিচালক ডাক্তার সাবিল আহমেদ গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘ইসলাম একটি সুন্দর ও বাস্তবসম্মত জীবনব্যবস্থা। তবে বর্তমানে কিছু বিপথগামী লোকের দ্বারা ইসলামের ভুল বাণী ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের কাজ গণমাধ্যমের নানা উপকরণ ব্যবহার করে মানুষের মাঝে সঠিক ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়া।’
বিশ্বজুড়ে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস নিয়ে দারুণ এক সুখবর দিয়েছেন ব্রিটিশ গবেষক অধ্যাপক অলিভার লিন্টন। লন্ডনের বিখ্যাত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যাপক এবং ট্রিনিটি কলেজের ফেলো ওই গবেষক বলেছেন, আগামী মে মাসের মধ্যেই কমতে শুরু করব করোনা যার লক্ষণ ইতিমধ্যে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। তার মতে, করোনা নামের এই মহাবিপদ অনেকটাই কেটে যাবে এবং নতুন সংক্রমণের সংখ্যা অনেক কমে যাবে। তখন এতে মfরাও যাবে অনেক কম সংখ্যক মানুষ। তিনি এটাকে সবার জন্য সুখবর হিসাবে উল্লেখ করেছেন। অপরদিকে সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইনের ডাটা ড্রাইভিং ইনোভেশন ল্যাবরেটরি এক পরিসংখ্যানে জানিয়েছে, বিশ্বের কোন দেশ কবে নাগাদ করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত হবে। গতকাল রবিবার প্রকাাশিত ওই পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, ১১ এপ্রিল থেকে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কমতে শুরু করেছে। আগামী ৩০ মে’র মধ্যে ৯৭ শতাংশ, ১৭ জুনের মধ্যে ৯৯ শতাংশ ও চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো বিশ্ব শতভাগ করোনামুক্ত হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ওই পরিসংখ্যানে গত ২৩ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কমতে শুরু করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একইসঙ্গে পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, আগামী ১৯ মে’র মধ্যে ৯৭ শতাংশ, ৩০ মে’র মধ্যে ৯৯ শতাংশ ও আগামী ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে বাংলাদেশ শতভাগ করোনামুক্ত হবে। সামনে গরমের মৌসুম আসতেছে, তখন তার তীব্রতা, তীক্ষ্ণতা ও প্রসার কমে যাবে। পৃথিবী থেকে সে বিদায় নেবে। যদিও আমাদের অনেক ক্ষতিও করবে।"হে ইমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।" (সূরা বাকারা আয়াত নং ১৫৩) আল্লাহ পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল। আল্লাহর কাছে কোনো কিছু চাইলে, আল্লাহ তা দান করেন। আসুন আমরা আল্লাহর কাছে বেশী বেশী দো/য়া করি। ইনশাআল্লাহ শিঘ্রই করোনার আক্রমন কমে আসবে আল্লাহর রহমতে।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক লিংক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৪:০৭